ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাসঃ “চোরাবালি”(পর্ব-৪)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস  ‘চোরাবালি‘-র চতুর্থ পর্ব।

 

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-৪)

 

(★★সতর্কবার্তাঃ এই উপন্যাস একটি কাল্পনিক কাহিনী। এর চরিত্ররাও কাল্পনিক। শুধু কিছু ভৌগলিক স্থান, কাল ও প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে কাহিনীর প্রয়োজনে। যদি কোনো চরিত্র, ঘটনা বা স্থানের সামঞ্জস্য পাওয়া যায় তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।★★)

ভোরবেলা বেড়াতে বেরিয়ে কাঠগোলার খাদানে একবার ঘুরে যাওয়া গত কয়েক বছরে অভ্যাসে পরিণত করেছে গদাই ঘোষ। রক্তের চিনি এমনিতেই বেশী, তার সঙ্গে রয়েছে বিগড়ে যাওয়া কোলোস্টরেল। ঢোলা সাদা পায়জামা আর হাফহাতা ফতুয়া পরে বাঁধের উপর থেকে নীচে চরের দিকে দেখার চেষ্টা করে গদাই ঘোষ। এসময়টায় মেজাজটা বেশ সরিফ থাকে, নাঃ বোট ছাকনির হারামজাদারা এখনও আসেনি মনে হচ্ছে। ডানদিকে ঠাকুরতলার পাশে নদীর গায়ে গোটা চারেক ট্রাক চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গদাই ঘোষ সাবধানে বাঁধের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে থাকে। ওঃ শালা কি দুর্গন্ধ! নাকে রুমাল দেয় গদাই ঘোষ। ওপাশের কিছু বস্তির ছেলে-পিলে আর যে ট্রাকগুলো রাতে রয়ে যায় তাদের ড্রাইভার–খালাসি গুলো নদীর পাড় জুড়ে হেগে রেখেছে! সরু পায়ে চলা রাস্তাটা বেয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় গদাই ঘোষ খাদানের দর্মা টিনের নদীর পাড়ের তার অস্থায়ী অফিসঘরের আস্তানার দিকে। এবার একটু বসতে হবে গাড়িটা রাখা আছে সেই আঁজিরবাগানের বিহারীপট্টির মুখে, ওখান থেকে এতটা ইচ্ছে করেই হেঁটে আসা, হাঁটার জন্যই ,ডাক্তার বলেছে। দরমার ঘুপচি ঘরটার ভিতর রাখা চেয়ারে গিয়ে ধপ করে বসে শরীরটা একটু এলিয়ে দেয় , এখুনি বুধুয়া, মানে এই অফিসের বিহারী কেয়ার টেকার ফ্লাক্সে চা নিয়ে আসবে। দরমার ঘরটা বাইরে থেকে যাই মনে হোক ভিতরে বেশ ভালো ব্যবস্থাই রয়েছে। একটা ছোট্ট টেবল, তিনটে প্লাস্টিকের চেয়ার, এক কোনে একটা এক চিলতে তক্তোপোশ। একটা টেবল পাখাও। বাঁধের উপর দিয়ে যাওয়া সরকারি ইলেক্ট্রিকের পোল থেকে লম্বা তার দিয়ে হুকিং মারা আছে, সন্ধ্যায় আলোও জ্বলে যে!
এটা গদাই ঘোষের দু নম্বর খাদান। প্রথমটা সদরঘাটে। ওখানেই জেসিবি গুলো থাকে। কিন্তু এটা দুনম্বর হলে কি হবে! এক নম্বর বালি এই খাদান থেকেই বেশী ওঠে! তাই এটার আদর গদাই ঘোষের কাছে একটু অন্যরকম। এখানে বোট ছাকনির কাজ বেশী, সকাল সকাল নৌকো নিয়ে নিয়ামত, রসুল, বিনোদরা বেরিয়ে যায় নদীর জলে, নদীর জলের নিচে বেড থেকে চেঁচে–ছেনে নিয়ে আসে বালি। সদরঘাটে একটা মেশিন ছাঁকনি রয়েছে, এখানেও একটা বসাবার ইচ্ছে আছে। ঘাটে যা মালিক হিসেবে গাড়ি পিছু কালেকশান রয়েছে রয়েছে, নিজেরও কিছু সাপ্লাই রয়েছে।
দরমার ঘরের একফালি জানালা দিয়ে নদীর বিস্তীর্ণ চর দেখা যাচ্ছে, এখান থেকে বিশাল দা্মদরের জলের ক্ষীণ ধারাটুকু নজরে আসছে না। বছরের এসময় কাজের চাপ বেশী, বর্ষা এসে গেলে নদীর জল বেড়ে যাবে তখন বালি তোলা কমে যাবে। যদিও এখন আর সে জল হয় কোথায় নদীতে! বাঁধে বাঁধে, রিজার্ভারে রিজার্ভারে দামোদর এখন রুগ্ন। চরে এখন হোগলার বন গজিয়ে উঠেছে। অনেকেই নদীর গাবায় অল্পসল্প শাক সব্জিও চাষ করছে। গদাই ঘোষ মনে করার চেষ্টা করে এই কারবারে আসার আগে যখন চালের ব্যবসা করত, তখনো দামোদরের সেই ভয়ংকর চেহারা! তখন কটাই বা চালকল! রোজ বেলসর থেকে বাদামতলার গদিতে যাতায়াত করত গদাই ঘোষ তার সেই এম এইট্টিটা নিয়ে, বড় লক্ষীগাড়ি, এখনও রেখে দিয়েছে সেটা নবাব বেড়ের নতুন বাড়িতে। এখন কোথায় সে নদী! তখন মেশিন ছাকনি ছিলনা, জেসিবিও ছিলোনা। এক জায়গায় পাহাড় করে বালি জমিয়ে তারপর হাতে করে ছাঁকা হতো। এখন কেমন সুবিধা দেখো! কনভেয়ার বেল্টে করে বালি উঠে যাচ্ছে টঙে ছেঁকে বেড়িয়ে আসছে, বালি একদিকে জল একদিকে। এখন বালির পার্টিও বেড়েছে। পুরানোরা যারা রয়েছে তাদের সঙ্গে জুড়েছে নতুন কিছু চ্যাংড়া। কয়েক হাজার লোক জড়িয়ে রয়েছে সেই কাঞ্চন নগর থেকে সদরঘাট। গোটা দামোদর জুড়েই… নতুন গুলোর বড় দোষ, ব্যাটারা যেখান সেখান থেকে কেটে নিচ্ছে বালি! পাড়ের কাছে যেখান সেখান দশ-বারো ফুটের গর্ত করে দিয়েছে! এইতো গতবারেই পাল্লার দিকে ঘাটে বর্ষার টাইমে বুঝতে না পেরে একটা বছর দশের ছেলে ডুবে গেলো বালি তোলা গর্তে! সে কি হুজ্জুতি! পাড়ের বস্তি , গ্রামের লোক সব বিরাট ঝামেলা করল। শেষে ক্লাব ধরে,পার্টি ধরে ছেলেটার বাপ-মাকে হাতে কিছু দিয়ে তবে ‘সেটিং’ হল।
দূরে বালির চড় পেরিয়ে নদীর মাঝ বরাবর যে কাঠের সাঁকোটা রয়েছে নদীর একেবারে মাঝ থেকে চরের বালি তুলে আনার জন্য ট্রাকটার-ট্রলি, লরি যাতায়াতের জন্য । নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রুগ্ন দুস্থ ,দুবলা দামোদর। প্রবল–প্রচন্ড দামোদর নদের এখন ভিখিরির হাল।
জলের ধারে এসে নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল নিয়ামত। আজও ভালো মাল টানতে পারেনি, বালতি মারলে দু এক বালতির সঙ্গে পাথর উঠছে, ‘শালা হবে না! চেঁচে চেঁচে দামোদরের পেটও খালি করে দিয়েছে সব… বালি উঠবে কি! বোট ছাকনির কাজে কাঠগোলা ঘাটের কয়েকজন ওস্তাদের অন্যতম নিয়ামত। ওরই এই হাল হলে বাকিদের কি হবে কে জানে! আবার বর্ষা পেরলে যদি কিছু হয়। মেজাজ খিঁচড়ে আছে নিয়ামতের, কোমর জলে দাঁড়িয়ে নৌকাটা খুঁটে বাঁধতে থাকে ও। পাড়ে নদীর বালির উপর একটা ট্রলি লাগানো আছে, মুখ গুঁজে পড়ে আছে নদীর চরে, মনে হয় লোডিং হবে। আগে চার পাঁচ খেপেই ট্রলি ভর্তি করে দিত নিয়ামত, নৌকার বিলাল, ঘাটের জমা সব মিটিয়ে শ পাঁচেক ফি দিন পকেটে থাকত। এখন গোটা বেলা ঠান্ডা জলে হাত পা সাদা করেও ঠিক ঠাক লোডিং দিতে পারছে না। নৌকার পাটাতন থেকে গেঞ্জী আর লুঙ্গিটা নিয়ে ভিজে হাফ প্যান্টটা ছেড়ে চরের বালিতেই মেলে দেয় নিয়ামত। শুকিয়ে যাবে ঘন্টাখানেক রোদ পেলেই , পরে তুলে নিলেই হবে। একটা পাথর চাপা দিয়ে প্যান্টটা শুকোতে দিয়ে ঘাট অফিসের দিকে হাঁটা দেয় নিয়ামত। বালিতে পা ফেলতেই টের পায় বাঁ পায়ের হাজাটা বেশ টাটাচ্ছে। জলে থেকে থেকে পায়ে হাজা হয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়, নাঃ ঠান্ডা ওদের লাগেনা, ডিসেম্বরের ঠান্ডাতেও ঘন্টার পর ঘন্টা ছাঁকনি মারে নিয়ামতরা ভোর থেকে, শীতও ওদের ডরায়। সারাদিন খাটুনির পর দু পোয়া ‘ক্যাপ্টেন’ মেরে নেয় বাড়ি যাওয়ার আগে, ব্যাস বডি ফিট! গা গরম।
সূর্যটা বেশ কিছুটা চড়েছে। কটা হবে এখন ? আটটা বাজবে বড়জোর। ঘাট অফিস খোলা রয়েছে নিয়ামত লক্ষ্য করে। মনে হচ্ছে গাদাই বাবু চলে এসছে , এই গদাই ঘোষ ডেঞ্জার মাল! ঠিক খবর রাখে ঘাটে কি হচ্ছে না হচ্ছে, জমা ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। ম্যানেজার বুধোকে ফিট করে জমার হেরাফেরি করাও খুব মুশকিল। তবে বিপদে আপদে হাত টেনে নেয় না, এটা একটা কথা স্বীকার করতেই হবে।
“কিরে ! নিয়ামত সকাল সকাল উঠে পড়লি যে জল থেকে? কাজ ফিনিশ!” নিয়ামতকে ঘাট অফিসের দিকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে গদাই ঘোষ।
“ধুর… চেঁচে চেঁচে মাল উঠছে না… নদীর পেট খালি গো বড়বাবু!”
“দুর ব্যাটা আরও দক্ষিনে যেতে হতো ! তবেনা…”
“ ও বাবা! ওদিকে গেলে আবার সুরিন্দারের লোক ঝামেলা করবে… ওদের এলাকা যে…”
“হুম…সুরিন্দারের আবার খুব র‍্যালা হয়েছে আজকাল…”
বুধুয়া ফ্লাক্সে চা রেখে গেছে। ফ্লাক্স খুলে কিছুটা ঢালে গদাই ঘোষ বড় কাপটায়, চিনি ছাড়া লিকার। এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে ঘাট অফিসের সামনে গাছপালার ফাঁক দিয়ে। নিয়ামত সেই রোদে বসে বাঁ পাটা নিয়ে কি করছে। এ ব্যাটাদের লেগেই আছে , নির্ঘাৎ হেজিয়েছে! সারাদিন জলে থাকে, ঠিক মত পরিষ্কার করেনা হবেনা!
“আরে এই উজবুক! ওটা ন্যাকড়া দিয়ে বাঁধছিস কেন! আরও হেজে যাবে যে! ভালো করে শুকনো করে মুছে বোরিক পাউডার লাগা, এখানে আছে একটা…দাঁড়া বুধুয়া আসুক, কোথায় রেখেছে ওই জানে…”
“আরে না বাবু…ও ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওঃ…ঠিক হয়ে যাবে ! …তারপর পা হেজেছে বলে আতাক্যালানের মতো কদিন ডুব দিবি… যা বলছি শোন।”
কিছুক্ষন পর বুধুয়া এসে নিয়ামতকে বোরিক পাউডার বের করে দেয় দরমা-টিনের অফিস ঘরের সিলিং থেকে। বাঁশের ফাঁকে গোঁজা ছিল।
গদাই ঘোষ ভাবতে থাকে সুরিন্দরের কথা। এই সেই সুরিন্দার, ক’বছর আগেও গদাই ঘোষের জেসিবি চালাত। বেশ চটপটে ছিলো প্রথম থেকেই , বেশীদিন টেকেনি। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল ,তারপর একদিন গদাই ঘোষ শুনল সুরিন্দার নাকি খাদান করেছে। এলেম আছে ছেলেটার।
আজকে কাজের যেন গতি নেই, এতক্ষনে মাত্র পাঁচ ট্রলি মাল পেরল। বুধুয়া টোকেন কাটছে। কিছু ট্রলির টোকেন কাটা হবে না, মুলত অনুপাতে বেশীরভাগ ট্রলির টোকেন কাটা হয়না। ক্যাশ কারবার চলে যার হিসেব সরকারকে দেয় না খাদান মালিক। টোকেনের এন্ট্রি থাকে একনম্বর খাতায় আর বিনা টোকেনের হিসেব থাকে দু’নম্বর খাতায়। এমন নয় যে সরকারি নজরদারী নেই, আছে পুলিশ বুথও, রয়েছে সেচ দপ্তরের লোকেরাও। কিন্তু সবাই মিলেই গড়ে তুলেছে একটা বিকল্প পরিকাঠামো, যাতে খাদান মালিক, পুলিশ, সেচ দপ্তরের কর্তাদের সবার স্বার্থ রক্ষিত হয়।
অনেক বেলা হল, এবার যেতে হবে। গদাই ঘোষ বেরিয়ে এল খাদান অফিসের দর্মার আস্তানা থেকে। এবার একবার বাড়ি যেতে হবে তারপর স্নান–খাওয়া সেরা মিলে যেতে হবে । ‘মাতৃ উদ্যোগ রাইস মিল’ এর গদাই ঘোষ আট আনার অংশীদার, বাকি আট আনার মালিকের নাম গোপনই রয়েছে। মিল মূলত গদাই ঘোষই চালায়।
বুধুয়াকে সারাদিনের নির্দেশ দিয়ে বাঁধের উপর ধীর পায়ে উঠতে থাকে গদাই ঘোষ। নিয়ামতকে দেখা যাচ্ছে না , আবার বোধ হয় নৌকায় ফিরে গেছে। প্রচন্ড খাটতে পারে এরা, শীত–গ্রীষ্ম কিছুতেই এদের আটকায় না। সারাদিনে খারাপ রোজগার নয় , সাত-আটশো হয়েই যায়। টাকাটা ভাগ হয়ে যায় মাঝি ,নৌক মালিক, আর যে বোট ছাকনির কাজ করে তাদের মধ্যে। নিজের নৌকা হলে লাভ বেশী। নিয়ামত এখনও নিজের নৌকা করতে পারেনি।
ধুসর রুপোলি রঙের গদাই ঘোষের সুইফট গাড়িটা এসে নীলপুরের বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই বারান্দায় বাঁধা পোষ্য কুচকুচে কালো ল্যাব্রাডার ‘ঝিমলি’ বারান্দার গ্রীলে সামনের দু’পা তুলে ঘন ঘন পাড়া কাঁপিয়ে ডাকতে লাগল। বাড়ির লোক বোঝার আগেই পোষ্যরা বোধহয় টের পেয়ে যায় মালিক এসেছে! গ্রীলের গেট খুলে ঢুকে আগে কিছুক্ষণ মাথায় হাত না বুলানো অবধি সে শান্ত হবে না গাদাই ঘোষ জানে। ঝিমলি নামটা তার মেয়ে রুমকিরই দেওয়া। তা বছর চার বয়স হয়ে গেল ঝিমলির , এই এত্তটুকু নিয়ে এসেছিল গদাই ঘোষ আসানসোল থেকে।
“আঃ হয়েছে হয়েছে নে… ”ঝিমলি ঢুকে থেকেই কুঁই কুঁই করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে গদাই ঘোষের পায়ে মাথা ঘষছে আহ্লাদে। বার দুই গদাই ঘোষের হাতটাও চেটে দিয়েছে। পোষ্য কুকুর মানেই আদরের কাঙাল!
গদাই ঘোষ ঝিমলিকে ছেড়ে সুদৃশ্য কাঠের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। কাজের লোক বাসন্তী এর মধ্যেই দরজা খুলে দিয়েছে। এখন সামনের হল ঘরটায় কেউ থাকার কথা নয়। গদাই ঘোষের স্ত্রী এই সময় পুজোর ঘরেই থাকেন সাধারনত , আর একমাত্র মেয়ে রুমকি হয় তার ঘরে নয়ত টিউশানি ক্লাসে গেছে। বাড়ির ভিতর বিরাজ করছে একটা নিস্তব্ধতা। গদাই ঘোষ হল ঘরের সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ, একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে ভিতর থেকে। নাঃ এ কোন দুশ্চিন্তার দীর্ঘশ্বাস নয় , কোন কিছুরই অভাব নেই তার! সবকিছুর প্রয়োজনীয়তার উর্দ্ধে থাকলেও এক রকম বিষাদ আসে– এও বোধহয় সেরকমই। সেই বাইশ বছর বয়স থেকেই পয়সার পিছনে অক্লান্ত ছুটছে গদাই ঘোষ। কে-ই বা চিনত তখন তাকে! তিল তিল করে বড় হয়েছে তার উপার্জন, যার ফল এই সাড়ে তিন কাঠার উপর বাড়ি, বাড়ির বাইরে দু দুটো গাড়ি। একটা বাড়িতেই থাকে যখন গদাই ঘোষ অন্যটি নিয়ে কাজে বের হয়। মেয়ের টিউশানি ,কলেজ ,গিন্নির মন্দির, বাজার যাওয়ার কাজে লাগবার জন্য। গ্রামের ছেলেবেলার কথা মনে পড়লে ভেসে ওঠে কিছু বালকবেলার অনাবিল আনন্দের মাঠ ঘাটময় দিন, দস্যিপনা আর নিতান্ত নিম্নবিত্ততার কথাই। যে নিম্নবিত্ততা চিরকাল যন্ত্রণা দিয়ে এসেছে গদাই ঘোষকে, তাই বোধহয় সাবালক চেতনার প্রথম দিন থেকেই দৌড় শুরু তার, ছুটতে ছুটতে পেরিয়ে যেতে চেয়েছে তার যাবতীয় বিত্তাভাব , সমস্ত অপ্রাচুর্য। সামান্য কয়েক বিঘের মালিক গদাই ঘোষের বাবা যা যা পারেননি, এমনকি কল্পনাও হয়তো করেননি, সেই সবই গদাই ঘোষের আয়ত্তে এখন। এ সম্পুর্নতা প্রায়ই বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে গদাই ঘোষ। আবার কখনও বা এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরে অকারনে, এই যেমন এখন…
“দাদাবাবু চা দিই এককাপ?” বাসন্তির প্রশ্নে চিন্তার ঘোর কেটে যায় তার… নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ইচ্ছা প্রকাশ করে টেবলে রাখা আজকের আনকোরা খবরের কাগজের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে জিজ্ঞেস করেন “তোর বৌদির হলো ? এতক্ষণ ধরে ভগবানকে ডাকাডাকি করলে তিনিও যে বোর হয়ে যাবেন ! উঃ… পারেও বটে !”
“হ্যাঁ দাদাবাবু… এই হলো, বৌদি এখন রান্না ঘরে…” বলেই একটু মুচকি হেসে বাসন্তি চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
গিন্নির এই এক রোগ মারাত্মক! সকালে ঘন্টা খানেক, সন্ধাতেও প্রায় আধ ঘন্টা ঠাকুর ঘরে দিব্যি কাটিয়ে দেন! এছাড়া তিথি,উপবাস, মানসিকেরও অন্ত নেই। কবে থেকে যে ও কিভাবে উর্মিলা এরকম হয়ে গেল! মনে করতে পারে না গদাই ঘোষ। মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হলেও একটু আধটু মস্করা করা ছাড়া কিছু তেমন বলে না, থাকুক না এসব নিয়ে! মন্দ কি? আর করার জন্য আছেই বা কি? তবে গিন্নির আর একটা নেশা হচ্ছে বাগান! খুব যত্ন করে গাছপালা লাগায়, ফুল ফোটায়। ড্রাইভার রমেশকে দিয়ে কি কি সব চারা গাছ এনে এই সেদিনও লাগাল বাড়ির একচিলতে বাগানে। একধারে রয়েছে কিছু মরশুমী শাক-সব্জি গাছও। এছাড়া একমাত্র সন্তান রুমকি আর সন্তানবৎ পোষ্য ঝিমলিকে নিয়ে তার অন্তহীন চিন্তা দেখে দেখে অভ্যস্ত গদাই ঘোষ।
নাঃ এবার স্নান করা দরকার, উঠে পড়ে গদাই ঘোষ। নিজের একতলার ঘরে গিয়ে সকালের জামাকাপড় ছেড়ে তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। ঝর্ণা খুলতেই ঠান্ডা জল নামতে থাকে শরীর বেয়ে। বাথরুমের একধারে একটা বেশ বড় আয়না লাগানো রয়েছে, তাতে প্রায় কোমরের নীচ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। স্নান করতে করতে সেদিকে চোখ যায় গদাই ঘোষের, নিজেকে সম্পূর্ন দেখতে পায়… আদি, অকৃত্রিম! নিজেকে বড় বীভৎস লাগছে আয়নায়! এতগুলো বছরে এ কি চেহারা হয়েছে তার! অথচ বেশ সুঠাম ছিল তার গঠন, গ্রামে ফুটবল টিমে রেগুলার হাফ ব্যাকের গদাই ঘোষ এখন কেমন থল থলে পর্যাপ্ত চর্বিযুক্ত বিরল কেশ এক মাঝবয়সী মানুষ! নিজেই নিজের মুখ দেখে চমকে ওঠে, কেমন দুর্নীতিগ্রস্থ মুখ রয়েছে তার… কেমন ভোগের চিহ্ন থরে থরে জমে উঠেছে শরীরের আনাচে কানাচে।
প্রসাদেও সুগার ফ্রি সন্দেশ আসে এ বাড়িতে। কারন কর্তা-গিন্নি দুজনারই রক্তে শর্করার মাত্রা সাধারণের মাত্রা থেকে বেশ কিছুটা উপরে। খেতে বসার আগে এক প্রস্থ ধূপ দর্শনসহ বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্রচ্চারণ করে গদাই ঘোষ ভিজে তোয়ালে জড়িয়েই, দেওয়ালে সুসজ্জিত গনেশের উদ্দেশ্যে , বড় ফ্রেমে বাঁধানো তারাপিঠের তারামার সামনে এবং সব শেষে পারিবারিক গুরুদেব বিপুলাকায়,স্ফীত উদর, উর্দ্ধাঙ্গ আনবৃত, স্মিত হাস্য ‘শ্রী অনাদিনন্দ মহারাজ’ এর বিশাল ছবির সম্মুখে। সারাদিনে এই তাঁর আস্তিকতা। দৈনিক পুজোর মাঝেই উর্মিলা এসে একটি সন্দেশ নিজে হাতে মুখে দিয়ে দেয়।
কাচা , মাড়ভাঙা পায়াজামা পাঞ্জাবী পরে খেতে বসলেই বিপত্তি, কিছুনা কিছু পড়ে দাগ লাগবেই। তাই গেঞ্জী আর লুঙ্গী পরেই খেতে বসে গদাই ঘোষ। আহার নেহাতই মার্জিত। এমনিতেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলাদা কোন উৎসাহ নেই তার আজকাল, বাঁচতে গেলে খেতে হবে–এরকম একটা চিন্তা থেকেই খেতে বসা। ছুটতে ছুটতে কখন খাওয়া দাওয়ায় উৎসাহ হারিয়েছে কে জানে! অথচ একটা সময় ছিল তার অনেক স্বপ্নের একটা ছিলো রোজ মোগলাই খানা খাওয়ার, যা তার ছেলে বেলায় জোটেনি। যেদিন অনেক রোজগার করব, সেদিন দুবেলা কালিয়া কোপ্তা, মটন , রাবড়ি খাব!– এই ছিল চিন্তা। আর এখন যখন এসব তার কাছে নেহাতই সুলভ বস্তু তখন বিধাতা রক্তে চিনি বাড়িয়ে দিলেন! এসব ভেবে আপন মনেই হাসে গদাই ঘোষ। উর্মিলা তাও জিজ্ঞেস করে রোজকার অভ্যাসে…
“মাছের ঝোলটা ঠিক আছে? একি… এঁচোড়ের কোপ্তাটা তো ছুঁলেই না ! …”

ক্রমশ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৩) “চোরাবালি”

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *