জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(পঞ্চদশ পর্ব)
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা (পঞ্চদশ পর্ব)
অবশ্য প্রতীকী লেখাও অনেক লেখা হয়েছে নেকড়েকে নিয়ে। বাইবেলে লেখা আছেঃ “ভণ্ড ভাববাদীদের থেকে সাবধান৷ তারা তোমাদের কাছে নিরীহ মেষের ছদ্মবেশে আসে অথচ ভেতরে তারা হিংস্র নেকড়ে বাঘ” (Beware of false prophets, which come to you in sheep’s clothing, but inwardly they are ravening wolves)। প্রাক-বিপ্লবযুগে ফ্রান্সের জনসাধারণ অত্যাচারী রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের বর্বর ব্যবহারের জন্য ‘অর্থলোলুপ নেকড়ে’ বলত।
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ‘নেকড়ে অরণ্য’ (১৯৭৩) উপন্যাসটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। এই সংগ্রাম চলাকালে পাকসেনাদের পাশববৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কতিপয় বন্দিনী বাঙালী রমণীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের এক করুণ ও মর্মন্তুদ আলেখ্য। প্রায় অন্ধকার একটি সিভিল সাপ্লাইয়ের গোডাউনের মধ্যে বিভিন্ন বয়সের প্রায় একশজন নারীকে ধরে এনে পাকিস্তানি সৈন্যরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে রেখে দিয়েছিল। খান সেনাদের একেক জনের একেক রকমের মেয়ে পছন্দ। কারও কচি মেয়ে লাগে, কারও বা বয়স্ক। কেউ পাতলা মেয়ে পছন্দ করে, কেউ একটু মোটাসোটা, কেউ আবার একটু কুৎসিত পছন্দ করে।
বাংলার সবুজ অরণ্যে ধরে আনা নারী হরিণী সদৃশ আর পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা হিংস্র ‘নেকড়ে’ বাঘের মতোই ভয়ঙ্কর। এই চিত্রকল্প থেকে উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘নেকড়ে অরণ্য’। পাকসেনারা এভাবেই বন্দী করেছে বাংলাকে, নেকড়ে অরণ্য উপন্যাস নারীদের ওপর বন্দিশালায় খানদের অত্যাচারের ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নারীদের এ-নিগ্রহ হানাদারদের কাছে ফুর্তির বিষয় ছিল। কিন্তু এই বন্দীশালাতেও মাঝে মাঝে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের বার্তা। এ অরণ্য থেকে বাঙালী মুক্ত হয়েছে অনেক রক্ত ঝরিয়ে। এ উপন্যাসে পাকসেনার হাতে নির্যাতিত নারীদের লেখক যে বর্ণনা দিয়েছেন তার একটি খন্ডচিত্র:
গুদামের পোস্তার ওপর শত শত বস্তা সারি সারি থাকে থাকে সাজানো থাকত কদিন পূর্বে। আজ সারি সারি মানুষ শুয়ে আছে। অবশ্যি স্তর অনুপস্থিত। কারণ কারও ওপর কেউ শুয়ে নেই। একদম সিমেন্টের ওপর, যাদের মানুষ বললাম, তারা শুয়ে আছে, মানুষের মধ্যে যাদের মানবী বলা হয়। কেউ সটান কেউ কুকড়ে গেছে, শীতের রাত্রের কুকুরের মত।‘
তানিমা, জায়েদা, বালীদা, সখিনা, চাষি বউ আমোদিনী এরা সব এই উপন্যাসের নারীচরিত্র। এরা নেকড়ে অরণ্যে বন্দী, মুক্তির প্রত্যাশা এদের চেতনা থেকে লুপ্ত। এদের জীবনের মূল্যবান সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছে। এরা ক্যাপ্টেন রেজা খান কিংবা আলী খানের কাছে অপহৃতা-ধর্ষিতা।
এই বাঙালী হারামজাদলোগ পাকিস্তান কো বরবাদ করনে মাংতা। শালা লোগ হিন্দু হ্যায়। এ লোগ কা নসল (জন্ম) বদল দেনা চাহিয়ে। মুসলমান হোতা ত এ্যয়সা নেহি করতা।
মুসলমানের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য কিংবা ধর্ম রক্ষার জন্য যে পাকিস্তান সেখানে ‘নেকড়ে অরণ্য’ বানিয়ে বন্দি মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কী? প্রৌঢ় চাষির বউয়ের অনুরোধে তানিমারা আল্লারে ডাকলেই কি শত্রুদের হাত থেকে মুক্তি পাবে, কিংবা মুক্তি পেলেও আবার কি তারা ফিরতে পারবে পূর্বের স্বপ্নময় সোনালি জীবনে? সখিনা যখন প্রৌঢ় চাষির বউয়ের কাছে প্রশ্ন করে – ‘আল্লারে ডাকতে কও। আল্লা থাকে ইসলামী রাষ্ট্রে? ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লা থাকে? কও-কও।’ প্রতিপক্ষের চিৎকার যখন তীক্ষ্ণ হতে থাকে প্রৌঢ়ার কাছে স্বীকৃতি মেলে ‘আর শুধাইয়েন না বু, জান। ঠিগ কইছেন। এই বুড়া বয়সে… আমার জোওয়ান জোওয়ান পোলা… এই বেইজ্জতির লাইগ্যা বাঁইচ্যা ছিলাম…’। নেকড়ে অরণ্যে বন্দি তানিমাদের জীবন ছিল, সুন্দর সোনালি স্বপ্ন ছিল– নূর আহসানের কথা মনে পড়ে তানিমার। দু’সন্তানের আহাজারি ভেসে আসে। সওদাগরি ফার্মের অফিসার নূর হোসেন সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে বরাবর বিরোধী ছিল। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করত সে। একাত্তরের মাঝামাঝি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যখন গ্রামান্তরের ফেরারি, তখন ধরা পড়ে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে। বিবস্ত্র তানিমার এই মুহূর্তে আর কিছুই মনে নেই, চৈতন্য ফিরে পেলে তার সন্তান স্বামীর খবর জানে না ‘স্মৃতি কল্পনা। জীবন উদ্যানের বিটপীবৃক্ষের সঞ্জীবনী রস। এই সরসতার স্পর্শ ছাড়া সব মরুভূমি হয়ে যায়।’ তানিমাকে জীবন দিতে হয়েছে আলী খানের বুলেটে; একইভাবে জায়েদা ও আমোদিনী ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছে, সখিনা নিজেই মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে। ক্যাপ্টেন, মেজর, কর্নেলদের লোলুপদৃষ্টির নিশানায় মৃত্যুই তাদের শেষ পরিণতি হয়েছে। ইসলামের জিম্মাদার সেজে, ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিভূ হয়ে তারা বাঙালি নারীদের নির্যাতনের যে বীভৎস দৃশ্যের সূচনা করেছিল তা ইতিহাসে বিরল।
উজীর আলী ধরা পড়ে নেকড়ে খানসেনাদের হাতে, সে সেবা পায় বন্দিদের হাতে, কিন্তু আলী খানের বয়ানে “মুক্তিফৌজের ওই ছোকরাকে চার দিন ধরে ‘তিন ডিগ্রি’ দাওয়াই দিয়েছে অনেকে মিলে, অনেকক্ষণ ধরে। এমনকি সে নিজের হাতে কম্বল ধোলাই চালিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা কেউ বের করতে পারেনি।“ স্বদেশের উপকারে নিগৃহীত নারীরা সর্বোচ্চ সম্পদ বিকিয়েছে, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে জীবন দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচিয়েছে, সেবা দান করেছে – উজীর আলীরা বন্দিশালায় বন্দিত্বকে মেনে নিয়েছে; কিন্তু তবু গোপন সংবাদ প্রকাশ করেনি। ঔপন্যাসিক জায়েদা ও আমোদিনীর ক্ষেত্রে একটি হিন্দু ও মুসলমান রমণীর একই সঙ্গে একদড়িতে মৃত্যু দেখিয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক স্বদেশের জন্য যে-কথা বলেছিল তানিমার স্বামী নূর আহসান – ‘আমার তোমার মঙ্গল দিয়ে ত সারা দেশের বিচার হয় না। কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমানের কী হয়েছে? সব মিলিয়ে দ্যাখো। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুহারা, জীবজন্তুর মতো এদেশ ওদেশ আর কেন?’ এ প্রশ্নের দিকেই ইঙ্গিত করেন লেখক। পাকিস্তানি নেকড়েদের নির্যাতনের একটি অংশের প্রতিচ্ছবি এই উপন্যাস। কিন্তু সমালোচক বলেছেন : ‘নেকড়ে অরণ্যকে উপন্যাস বলা চলে না। কারণ এর মধ্যে চরিত্রসমূহের বিকাশ নেই এই গ্রন্থ একটি ডায়েরী বা স্মৃতিচিত্র, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি বিশেষ দিকের উদ্ঘাটন হয়েছে এই গ্রন্থে, কিন্তু নেকড়ে অরণ্যতে মুক্তিও নেই যুদ্ধও নেই।’ তানিমা, সখিনা, আমোদিনীরা উজ্জ্বল তাদের নারীত্বের মহিমায়, বন্দিশালায় তারা সোচ্চার প্রতিবাদী। হানাদারের উর্দু সংলাপের প্রতাপ তারা সহ্য করেছে। অবসন্নতার শেষ পর্যায়ে মৃত্যুকেই তারা বেছে নেয়। সখিনার মৃত্যুর পর হানাদারদের অট্টহাসির মধ্য দিয়ে উপন্যাস শেষ হয় – ‘শওকত ওসমানের প্রতিনিধিত্বশীল সকল সাহিত্যকর্মেরই মূল চারিত্র্য ‘ঘৃণা’। সে ঘৃণা বর্বরতার প্রতি সভ্যতার, অমানবিকতার প্রতি মানবিকতার, নিপীড়কের প্রতি নিপীড়িতের। এ ঘৃণার প্রণোদনাতেই তাঁর নেকড়ে অরণ্য নামক উপন্যাসটিও রচিত।’
আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-