শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী-র
চন্দ্রকোনার হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ইতিহাস নিয়ে
মেদিনীপুরের ভুলে যাওয়া ইতিকথা
ছবিঃ গৌতম মাহাতো
শালফুল উপন্যাস, টুসুগান ও সাহেব পটে নায়েক বিদ্রোহ; চন্দ্রকোণার ফাঁসী ডাঙ্গা, গণগণির নায়েক শিবির ও মেদিনীপুরের পুরাতন জেল খানায় ফাঁসী দেওয়ার অশ্রু সজল কাহিনী।ঃ
শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী
পর্ব-১৭
এই মর্মস্পর্শী গণবিদ্রোহের সমসাময়িক সত্য ঘটনা আমরা শালফুল’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস জানতে পারি। উপন্যাসটি রচনা করেন
চন্দ্রকোণা অধিবাসী প্রবোধ চন্দ্র সরকার মহাশয়।
অগ্রহায়ণ ১৩০৪ সাল অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এই বইটি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের
মূল কাহিনী হল :-
মেদিনীপুরের কাছাকাছি জনৈক পাঠশালার শিক্ষক (সরকার) মথুরা নাথ দাসের কন্যা,’কমলার ‘বিয়ে হয়েছিল বিষ্ণুপুর পরগণার অন্তর্গত সুন্দরপুর সাকিমের শশীশেখর রায়ের
সহিত। তখন শশীশেখর ছিল বিষ্ণুপুর রাজ্যের
গোমস্তা। তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বৎসর । একদিন
মথুরানাথ পাল্কিতে করে তার কন্যা কমলাকে বিষ্ণুপুর থেকে গড়বেতার পথ ধরে মেদিনীপুরে
আনয়ন করছিলেন। পথি মধ্যে বগড়ীর অরণ্যে
নায়েকগণ তাঁদের আটক করে নিকটস্থ গণগণির
ডাঙ্গার নায়েক শিবিরে নিয়ে যায় এবং তথায় নায়েক সর্দার অচল সিংহের বিচারে স্থির হয় যে,
” মুথুনাথ কমলার মুক্তিপণ স্বরূপ ২০০ (দুই শত) টাকা এবং পরিচারিকা রামার মার মুক্তিপণ স্বরূপ ২৫্ অর্থাৎ একুশে ২২৫্ টাকা দিলে তারা ওঁদের ছেড়ে দিবেন। ” এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় বিদ্রোহীগণ ছিলেন ধর্মপরায়ণ, দৃঢ়চেতা ও দেশভক্ত। কারণ সপ্তদশ বর্ষীয়া, বিবাহিতা, সালংকারা, নবযৌবনা, অপরূপ রূপসী কমলা দীর্ঘদিন নায়েক শিবিরে বন্দিনী থাকা সত্ত্বেও
নায়েকগণ তার কোন চরিত্র হননি করেননি। এছাড়া সভাস্থলে মথুরা নাথের মুখে রামায়ণ
পাঠ শ্রবণে মুগ্ধ হয়েছিলেন নায়েক বীররাএবং
নিম্নমধ্যবিত্ত হেতু তাঁর পণের টাকা কম হয়।
সে যা হোক, মথুরা নাথ বাড়ী থেকে মুক্তি পণের
টাকা আনয়ন করতে গেলে ইতিমধ্যে ইংরেজ
সৈন্য গড়বেতার নায়েক শিবির আক্রমণ করে।
বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, এই সুবিখ্যাত নায়েক
বিদ্রোহের শেষ ইতিহাস অত্যন্ত হৃদয় বিদারক।
সম্মুখসমরে ইংরেজ সৈন্যের নিকট নায়েক বীরগণ
পরাজিত হলে বিজয়ী ইংরেজ সৈন্য গড়বেতার
নায়েক শিবির ভস্মীভূত করে দেয় আর অগনিত
বিদ্রোহীকে গাছে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসী দেয়।
এসময় বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে বহু নায়েক বীর গড়বেতার গণগণির ডাঙ্গার যুদ্ধ ক্ষেত্রেই প্রাণ বিসর্জন করেন। ইতিপূর্বে আঠারো কাহান ডাকাতের সর্দার যুগল ও কিশোর দুই ভাই ধরা
পড়েন। বর্তমান কেশপুর থানার অন্তর্গত শ্যামচাঁদ
-পুর অঞ্চলের প্রতিষ্ঠাতা নিত্যানন্দ সিংহ (নিতাই
সিং) তখন চন্দ্রকোণা ও বগড়ীর অঞ্চলের দারোগা ছিলেন। ইনিই ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রকোণা
শহরের উত্তর দিকে অবস্থিত পূর্বোক্ত ফাঁসী ডাঙ্গা য় এই দুই ভাইয়ের ফাঁসী দিয়েছিলেন।এঁদের ফাঁসীর সময় কাঠ ডমুকের বাজনা বাজানো হয়েছিল অর্থাৎ ঢাকা ঢোল বাজিয়ে তদানীন্তন
সরকার ইংরেজ বীরত্বের খ্যাতি জাহির করেছিল।
ঈশান চিত্র করের নিকট প্রাপ্ত সাহেব পটের গানে
এই ফাঁসীর কাহিনী উল্লেখ আছে। পরে সাহেব পট
সম্মন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে। এখন ব্রিটিশ
সৈন্যের সঙ্গে এতদ্দেশীয় দেশভক্ত বীর গণের সরাসরি যুদ্ধের যে টুসুগান গুলি লেখক স্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন, সেগুলি পাঠক বর্গের
সুগোচরার্থে প্রামানিক তথ্য হিসাবে প্রদত্ত হ’ল।
টুসুগান
ছোট ছোট সাহেবগুলি
মাথায় তাদের লাল পাগড়ী
আঁটুগেড়ে বন্দুক ছুড়ে
পাহাড় গুঁড়ো করেছে;
এই পাহাড়ে নেইকো মধু
ভ্রমর নাই যে খায় চুষে।
ক্রমশঃ…