ছবিঃ গৌতম মাহাতো
কবি মিশ্র–এর দুটি অণুগল্প__
মূলত গল্পকার, গদ্য ও কবিতাতেও তার অবাধ বিচরণ।ইনি নিজেও একটি ওয়েবপোর্টালেরও কর্ণধার।দীর্ঘদিন নানান লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন ও লিখছেন
প্রতিবাদ
খুব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল অন্তরা। তীব্র এক শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। এত সরগোল কিসের ? কেন ? কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। চোখ কচলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল।
কিছু মানুষ প্রতিবাদ করছে। অনেকেই পরিচিত,অনেকে অপরিচিত। বিভিন্ন প্লাক্যারে লেখা বিচার চাই। ধর্ষকের ফাঁসি চাই। নির্যাতিতার সঠিক তদন্ত চেয়ে শীঘ্র রায় ঘোষণা করতে হবে।
এই ১৪ বছর বয়সেই অন্তরা বুঝে গিয়েছে এই সব প্রতিবাদের অর্থ। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। পাশেই কিছুটা দুরে একটা মঞ্চে সভা হচ্ছে। দিব্যি দিবা লোকে ঘুরে বেরাচ্ছে সেই সব ধর্ষক। কেউ কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যেতে চায়।
আমরা গরীব, আমাদের কোন বিচার হয় না। মাস কাল বছর কেটে যাবে।
তুমি এত রোদে বসে থাকলে কষ্ট হবে। ওরা কেউ তোমাদের কথা শুনবে না। এখানে শুধু আমি না ,আমার মতো অনেকে আছে, আসিফা, রবিনা, মৌসুমী, শান্তা পিসি, রমা দিদু।আরও ছোট ছোট অনেক বোন ও আছে। আমারা ভালো আছি। আমাদের আর কেউ যন্ত্রণা দিতে পারবে না। তুমি কেঁদো না বাবা।
চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বাবাকে জানানোর চেষ্টা করছে অন্তরা। কিন্তু বাবা যে তাকে দেখতে পাচ্ছে না। প্রাণপনে বলছে, তুমি একবার আমার ছবির দিকে তাকাও, দেখ আমি ভালো আছি।
যেদিনের ঘটনা মনে হলে আজ ও ঘুমের মধ্যে কঁকিয়ে ওঠে অন্তরা। কি দোষ ছিল ওর। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। পাড়াই এক দাদা কয় দিন ধরে বিরক্ত করছিল । পাত্তা দেয়নি। বাড়িতে মাকে বলেছিল। মা সাবধানে থাকতে বলেছিল। অন্য দিন বন্ধুরা থাকে। সেদিন একাই ছিল। গ্রামের রাস্তা , পা চালিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ পথ আটকে পাড়ার সেই দাদা। কিছু বোঝার আগেই মুখ চেপে টানতে টানতে পাশের ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়েছিল। তার পর আর কিছু জানে না। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তার পর আর বাবা মায়ের কাছে ফেরা হয়নি। পরে জেনে ছিল রফিকুল ওর উপর নির্মম অত্যাচার করেছিল। রক্তে ভেসে গিয়েছিল সারা শরীর। শরীরে একটাও সুতো ছিল না। চিনতে পেরেছি, সেই ভয়েই নাকি খুন ও করেছে।
বাবা তুমি কাঁদছো কেন ? মা কে বোঝাও আমি ভালো আছি। আমরা ভালো আছি… আমাদের উপর আর কেউ অত্যাচার করতে পারবে না…
মানবিক
ওকে দেখে কেউ হাসছে , কেউ এড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ অবাক হচ্ছে, কেউ ফিসফাস করছে। বাস স্ট্যান্ডে বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে পারমিতা। অপেক্ষা করছে প্রভাকরের জন্য। সামনেই ওদের বিয়ে। কিছু সপিং এখন ও বাকি।
বিগবাজারে যাবে, ভালো সিনেমা এসেছে, ঋত্বিক , ঋদ্ধি, আছে। তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে, দেখতে যাবে। কিন্তু প্রভাকরের দেরি হচ্ছে কেন বুজতেও পারছে না , ফোন লাগছে না, নট রিচেবেল বলছে। একা দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। সকলের চোখ যেন ওর উপর।
অনির্বাণের সঙ্গে পরিচয় কলেজ জীবনে। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি অনির্বাণ ড্রাগ অ্যাডেকটেড। সুন্দর দেখতে , হ্যান্ডসাম, টিকালো নাক, দরাজ গলা, গান করেও সুন্দর। যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে। পারমিতার খুব ভালো বন্ধু ছিল।
কিন্তু বুঝতে পারতো না কলেজের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলে বন্ধুত্ব করে, সিগারেটের মধ্যে ড্রাগ ভরে বন্ধুদের দেয় । বোঝার উপায় থাকে না । এইভাবে ড্রাগের নেশা ধরাতো। পারমিতাকেও এইভাবেই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি, উল্টে প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দেবে বলে জানিয়েছিল। ততদিনে ওদের সম্পর্ক ও অনেক দুর এগিয়েছে। কিন্তু অনির্বাণের যে ওটা অভিনয় ছিল বুজতে পারেনি।
প্রিন্সিপালকে না জানানোর জন্য চাপ দেয় পারমিতাকে। তখন পারমিতা সব বন্ধ করে এই ট্রাপ থেকে বেরিয়ে আসতে বলে অনির্বাণকে । সে যে সব কিছু জেনে গেছে, স্যার কে জানিয়ে দেবে এই খবর দলের ছেলেরা সবাই জানতে পেরে গিয়েছিল । পারমিতার মুখ বন্ধ করার জন্য প্রথমে সবাই মানা করে প্রিন্সিপাল কে না জানানোর জন্য। কিন্তু যখন দেখলো কাজ নাও হতে পারে। তখন প্ল্যান করে একদিন কলেজ ফেরত ফাঁকা রাস্তায় সুযোগ পেয়ে মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে।যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে ওখানেই পড়ে যায়। সেদিন প্রভাকর উল্টো দিক থেকে এসে ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে না গেলে এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়।
প্রভাকর পেশায় ডাক্তার। কাছাকাছি হসপিটালে ভর্তি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বাড়িতে জানায় । পুরো মুখের একপাশ পুড়ে গিয়েছে । তিন মাস হসপিটালে ছিল। প্রায় প্রতিটি দিন বাড়ির লোকের সাথে প্রভাকর ও আসতো। কখন যে দুজনে দুজনের মনের কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারেনি। হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে কলেজে আবার যাওয়া শুরু করে । প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হতো। প্রভাকরই সাহস দিত। ততদিনে সবাই জেনে গিয়েছে অ্যাসিড আক্রমণ এর ঘটনা, টিভি, সংবাদ পত্রে ফলাও করে খবর তৈরি হয়। পারমিতার ছবি সহ খবর সম্প্রচার হয়। পরে পুরো গ্যাংকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অনির্বাণের জেল হয়।
অনেক গুলো অপারেশন করে , স্কিন ড্রাফটিং করে এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে মুখ। কিন্তু চোখের কাছে, গালের নীচের চামড়া এখন কুঁচকে আছে। আয়নায় নিজেকে দেখলে এখন ও চমকে উঠে , কান্নায় দুচোখ ভিজে যায়। যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, রং যদিও খুব ফর্সা নয়। মাথায় একঢাল চুল, চোখ দুটো টানা টানা, নাকটা ছোট্ট টিকালো, সহজেই নজরে পড়তো। যেমন পড়েছিল অনির্বানের নজরে। পড়াশোনাতেও খারাপ ছিল না।
প্রভাকর সাহস না দিলে কলেজটাও পাস হোতো না। তাই ওর উপর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। প্রভাকর বলেছে বিয়ের পর বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে প্রভাকর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। এতটাই আনমনা ছিল মোটর সাইকেলের শব্দ ও কানে ঢোকেনি। অগত্যা প্রভাকর মোবাইলে কল করে। মোবাইলের ভাইব্রেশনে হুঁস আসে। চমকে দেখে প্রভাকর পাশে। গাড়িতে ছিল, নেটওয়ার্ক পাচ্ছিল না।
রাস্তায় জ্যাম, তাই দেরি হয়েছে।
দুজনে মোটর গাড়ি করে হুশ করে বেরিয়ে যায়। যারা এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল, তারা আরও অবাক হয় প্রভাকরের মতো হ্যান্ডসাম সুস্থ মানুষ এক অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া মেয়েকে কিভাবে মেনে নেয়। এখন ও এমন মানুষ আছে।
★★★