শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী–র
চন্দ্রকোনার হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ইতিহাস নিয়ে
মেদিনীপুরের ভুলে যাওয়া ইতিকথা
পর্ব-২৭
শ্রী মহাপ্রভুর পদধূলি ধন্য
চন্দ্রকোণা।
খন্ড ৩
দু:খের বিষয়, বর্ত্তমানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাজনীতির প্রভাব পড়িয়া আমাদের সনাতন
ভারতবর্ষ ক্রমশ: নিজ অস্তিত্ব হারায় ফেলিতেছে।
কিন্তু অতীতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাতেই প্রকৃত
প্রীতি, শান্তি ও সংহতি ছিল, আর ছিল সর্ব্বোপরি ত্যাগ। এক কথায় স্বল্পে সন্তুষ্ট আর উচ্চ চিন্তায়
রত থাকা। সুতরাং আত্মবিস্মৃত না হইয়া আমাদের সর্ব্বক্ষেত্রে অতীত ভারতকে অনুস্মরণ
করাই উচিৎ। ইহাতে দেশে পুণশ্চ শান্তি স্থাপিত
হইবে। আসুরিক ভাব ও নৈরাজ্য আসিবে না। তাহাতে সকলেই খাইয়া পটিয়া সুখে থাকিতে পারিবেন।
আমাদের দর্শন :- সত্য যুগে সত্যনারায়ণ, ত্রেতা
যুগে ‘রাম রাজা’, দ্বাপরে ‘রাস লীলা’, আর কলি
যুগে শ্রী মন্মাহাপ্রভু প্রবর্ত্তিত শ্রী শ্রীহরি নাম যজ্ঞের
ভোগপাতনের ‘ভোগ দর্শন’।
প্রসঙ্গ ক্রমে আরও উল্লেখ করি:-পরবর্ত্তী কালে
পণ্ডিতাগ্রগণ্য শ্রী শ্রী গৌরচন্দ্রের প্রভাবে নবদ্বীপ
ধামে প্রেমের বন্যা ডাকে। আর সেই বন্যার জল
প্লাবিত করে হিমাচল হইতে কন্যাকূমারী, সিন্ধু
হইতে ব্রহ্মদেশ ব্যাপি সমগ্র ভারত ভূমিকে।
অধুনা বিশ্বের অনেক সুসভ্য জাতির মধ্যেই এই
বৈষ্ণব ভাবধারা বিস্তার লাভ করিতেছে। লেখকের
দৃঢ় বিশ্বাস, “এই প্রেমের বন্যাই একদিন সারা বিশ্ব -কে প্লাবিত করিবে।” কারণ শ্রী মন্মাহাপ্রভুই একমাত্র সাম্যবাদী যিনি সর্ব প্রথম জগৎবাসীকে
শ্রী শ্রীহরিনাম যজ্ঞের শোভাযাত্রা বা মিছিল
বাহির করিয়া জগৎ সমক্ষে ভারতীয় সাম্যবাদ
প্রচার করিয়াছেন।
ভারতের সমাজবাদ ও সাম্যবাদে একের সঙ্গে
অন্যের জীবনের মধুর সম্পর্ক আছে। যদি আমরা
মূঢ়তা বশত প্রেমাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের
সাম্যবাদ পরিত্যাগ করতে: অন্য জাতির সাম্যবাদ গ্রহণ করি তাহা হইলে এই জাতির ঐতিহ্য নষ্ট
হইয়া যাইবে।
আরও উল্লেখ করি:- আমাদের দেব-ভাষা সংস্কৃত।
এই সংস্কৃত ভাষাতেই যাবতীয় শাস্ত্রানুসারে লিখিত
আছে। সুতরাং রাজনীতির চাপে পড়িয়া দেবভাষা
সংস্কৃত, ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ নীতিতে বিস্মৃত হইলে দেশের ভয়ানক বিষাদ উপস্থিত হইবে, তাহাতে হয়ত একদিন এই সোনার ভারত
ধ্বংস হইয়া যাইবে। অতএব এই দু:সময় ভারতবাসী সকলেরই পরমদার্শনিক শ্রী শ্রী পঞ্চতত্ত্বের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই উচিৎ। উচিৎ
গৌরবময় অতীতকে বর্ত্তমানের উপর রূপায়ন
করা।
মহাপ্রভু বলিয়াছেন:-
চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ ভজে।
বিপ্র নহে বিপ্র যদি কৃষ্ণ ত্যজে।।
তিনি শেষ খণ্ডে সন্ন্যাসীরূপে নীলাচল গমনকালে
শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভুর হস্তে গৌড় দেশের প্রচারের
ভার অর্পণ করেন।
” শেষ খণ্ডে সন্ন্যাসীরূপে নীলাচলে স্থিতি
নিত্যানন্দ স্থানে সমর্পিয়া গৌড় ক্ষিতি।”
চৈ: চ:
এক্ষণে তিনি নবদ্বীপ হইতে কোন্ পথে নীলাচল
গমন করেন তৎ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মধ্যে নানান
মত-বিরোধ আছে। লেখক গবেষণা করিয়া দেখি -য়াছে যে, অতি প্রাচীন কাল হইতেই একটা সুপ্রশস্ত রাজপথ শ্রীধাম নবদ্বীপ হইতে কাটোয়া,
বর্দ্ধমান শহর, সেয়ারা বাজার, গড় মান্নান, যুগোল
কিশোরের মাঠ, শ্যামদেবের মাঠ, তারা জুলির খাল, কেঠো নদীর গৌরাঙ্গ ঘাট, শিলাবতী নদীর
শ্মশান ঘাট, ঝাঁঝরা, কুঁয়াই(নেড়াদেউল বাজার),
মেদিনীপুর, নারায়ণগড় দাঁতন ও জলেশ্বর প্রভৃতি
স্থানের উপর দিয়া শ্রী ক্ষেত্রে উপনীত হইয়াছে।
খন্ড ৪
শ্রীক্ষেত্র যাবার পথের আর একটি শাখা পথ তারাজুলি খাল হইতে রামজীবনপুর, শ্রীনগর
চৌকান, পলাশচাবড়ী ঘাট, ছত্রগঞ্জ(ছত্র ভোগ),
চন্দ্রকোণা শহর, কুঁয়াপুর,প্রভৃতি স্থানের মধ্য দিয়া
কুঁয়াই উপকণ্ঠে পূর্বোক্ত পথের সহিত মিশিয়াছে।
পূর্বোক্ত পথটাকে শাহী সড়ক ও অহল্লাবাঈয়ের
সড়ক বলে। তৎকালে উত্তরাঞ্চল হইতে তীর্থ যাত্রীরা এই পথেই শ্রীক্ষেত্রে গমণ করিতেন।
এবং দক্ষিণাঞ্চল হইতে তীর্থ যাত্রীগণ এই পথ
ধরিয়াই নবদ্বীপাদি তীর্থ ক্ষেত্রে গমন করিতেন।
চন্দ্রকোণার বৃহত্তম মঠ মন্দিরের অতিথিশালা গুলি তাঁহাদিগের পথে সরাইখানার কার্য করিত।
আমরা বঙ্গ সাহিত্যে মেদিনীপুর’ও’মেদিনীপুরের
ইতিহাস’ নামক গ্রন্থের লেখক যোগেশ চন্দ্র বসু ও
‘মেদিনীপুর ইতিহাস’ নামক গ্রন্থের লেখক ত্রৈলোক্যনাথ পাল মহাশয়ের পুস্তক হইতে জানিতে
পারি যে, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এই পথ ধরিয়ে সশিষ্যে
নীলাচল গমন করেন। গোবিন্দ দাসের কড়চায় এই
কথা লিখিত আছে যে” শ্রীচৈতন্যদেব মেদিনীপুর, নারায়ণগড়, দাঁতন ও জলেশ্বর প্রভৃতি নগরের উপর দিয়া পুরী গমণ করেন। স্বর্গীয় ত্রৈলোক্য নাথ
পাল মহাশয়ের মেদিনীপুর ইতিহাসে ছত্রগঞ্জকে
ছত্রভোগ বলা হইয়ছে।
শ্রী শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বিরোধিতা শ্রী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের অ ৬/১৮৭ ও ২৪৭ তরঙ্গ হইতে জানা যায় যে, শিবানন্দ সেন মহাশয়
দেশ হইতে ভক্তগণকে লইয়া ঝাঁকরার উপর দিয়া
শ্রী ধাম পুরীতে উপনীত হইয়া ছিলেন এবং তথায়
তিনি রঘুনাথদাস গোস্বামীকে বলিয়াছিলেন যে,
“তোমার বাবা তোমাকে ধরিয়া পাঠাবার জন্য
আমাকে পত্র দিয়া ছিলেন কিন্তু তাঁহারা ঝাঁকরা
পর্যন্ত আসিয়া তোমাকে না পাইয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। “
সে যাহাই হউক, মহাপ্রভু যে এই রাজপথ দিয়াই
শ্রীক্ষেত্রে গমণ করিয়াছিলেন তাহার সাক্ষী আজও
কেঠোনদীর বক্ষে গৌরাঙ্গ ঘাট। ক্ষীরপাই শহরে
প্রভু ক্ষীর ভক্ষণ করেন বলিয়া ক্ষীরপাইবাসীরা
বলিয়া থাকেন। সেই হেতু’ ক্ষীরপাই ‘শহরের নামকরণ হইয়াছে।
ক্রমশ…