পটের রকমসকম
ছবি ও লেখা-বর্ণালী রায়
লেখিকার পায়ের তলায় সর্ষে।আজ পুরুলিয়ার এই মেলাতে তো কাল ইতিহাসের হাত ধরে পৌঁছে যায় মুর্শিদাবাদের প্রাচীন রাজারাজড়ার কোনও অলিন্দে।”গরীবের ঘোরা রোগ” বারবার তাঁর তথ্য তত্ত্ব ও ভিন্ন দর্শনের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর সম্প্রতি এই ছোট ছোট ভ্রমণের চোরাকুঠরির সমন্বয়ে বর্ণিক প্রকাশন থেকে সম্প্রতি “ভ্রমণ-যাপন১”
শিরোনামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।পাঠকরা সংগ্রহে রাখতে পারেন।চেনা পৃথিবীর অচেনা দর্শন।বর্ণালী বাইফোকালিজমের একজন অন্যতম সদস্যাও।
আমাদের লোককৃষ্টিতে এক অসাধারণ চিত্র শিল্প হচ্ছে পটচিত্র, যা আমাদের প্রাচীন শিল্প কে যুগ যুগ ধরে কালের প্রবাহে ধারণ করে চলেছে l
প্রাচীন বাংলায় যখন কোন দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি তখন পটচিত্রই ছিল বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক, পটচিত্রের পেছনে রয়েছে বিশাল ইতিহাস, আর এ চিত্র যারা অঙ্কন করতেন বা এখনও করছেন তাঁদের বলা হয় পটুয়া। বিষয়বৈচিত্র অনুসারে পটচিত্র বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে; যেমন- চক্ষুদানপট, যমপট, সাহেবপট, কালিঘাটপট, গাজিপট, সত্যপীড়েরপট, পাবুজীপট, পৌরাণিক পট,ঐতিহাসিক পট ইত্যাদি ।
কালীঘাট পটচিত্রঃ
প্রাথমিকভাবে কালীঘাট মন্দিরের বাজার ধরেই এই পটের ব্যবসা শুরু হয় তীর্থপণ্য হিসেবে। তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে এলে তীর্থের স্মারক হিসেবে এই পট কিনে নিয়ে যেতেন। সেই চাহিদা অনুসারে আঁকা হত ছবি। শিব, কালী, রাম-সীতা, ইত্যাদিই ছিল পটের বিষয়। বালির মিলে তৈরি কাগজে (চৌকো আকৃতির) আঁকা হত এই পট। তাই এই পটকে কালীঘাটের ভাষায় বলা হত ‘চৌকশ’। পরিবর্তে পটুয়া পায় চাল, ডাল, সবজি, কিছু পয়সা। এটাই সেকালের রীতি ছিল। পরিবর্তে কালীঘাট পট বিক্রি করা হত স্মারক হিসেবে। দ্বিতীয়ত, জড়ানো পট মানে লম্বা একটা স্ক্রোলে একটা কাহিনির লম্বা বিস্তার। কালীঘাট পট অপরদিকে এক ফালি পটে কাহিনির একটি খন্ডাংশ। তৃতীয়ত, জড়ানো পট স্মারক নয়।
কালীঘাটে পটচিত্রের রমরমা ১৯ শতকে বেশী ছিল। তবে এর উদ্ভব ঠিক কবে হযেছিল বলা যায়না। শিল্পী মুকুল দে ও অন্যান্য আলোচকদের ধারণা এই শতকের গোড়ায় বা তার কিছু আগে কালীঘাটের পটের উদ্ভব হয়েছিল। কালীঘাটের পট চৌকো প্রকৃতির। কেউ কেউ মনে করেন চৌকো পটের জন্ম ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এবং তা বিস্তৃত হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক শোভন সোম এর মতানুযায়ী কলকাতায় কোম্পানী চিত্রকলার (উদ্ভব ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে) সঙ্গে সমান্তরালভাবে কালীঘাটেও পটচর্চা চলেছিল,তবে কালীঘাটের পটের সূচনা বহু আগেই হয়েছিল এক্ষেত্রে প্রামান্য যুক্তি হল এরকম-ভারতের প্রায় সকল মন্দিরে যেমন কাশীর বিশ্বনাথ, পুরীর জগন্নাথদেবে মন্দিরে, কন্যাকুমারিকা, তাঞ্জোর প্রভৃতি মন্দির সংলগ্ন বাজারের মত কালীঘাটের মন্দির বাজার যেখানে পটচিত্র বেশ কম দামে সহজলভ্য ছিল। এখান থেকে সস্তা দামে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তরা ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ ছবি কিনে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের পট যখন আঁকা হয়েছিল তখন এদেশের তৎকালীন ভদ্র শিল্প রসিকেরা পটের রস উপভোগ করেনি এমনকি পটশিল্পকে বাঙালী নিম্নমানের চিত্ররূপে অবহেলা করত। তখন ধর্মীয় ও লোকায়ত দুধরনের পটই পাওয়া যেত।কালীঘাট পটশৈলী রেখাঙ্কনে, বর্ণপ্রয়োগে, রূপবিন্যাসে স্বতন্ত্র, প্রাচীনতা ও নবীনতার মেলবন্ধন ঘটেছে। মুক্ত উদারতার সঙ্গে কিউবিস্টিক, রিয়ালিস্টিক, ইম্প্রেশানিস্টিক ইত্যাদি শিল্পরীতিসুলভ বৈশিষ্ট্য খুব কম শিল্পধারাতে চোখে পড়ে। কালীঘাট পটে তা বর্তমান। কালীঘাটের পটে যে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হত তা লৌকিক ধর্মেরই প্রতিচ্ছবি।লক্ষী, সরস্বতী, কালী, দুর্গা, রামলীলা, কৃষ্ণলীলা নিয়ে কালীঘাটের পটুয়ারা যে ছবি আঁকতেন তা অনেক বেশী মানবিক করে আঁকা হত যেমন পায়ে বুট পরা রাবণ হনুমানের সাথে যুদ্ধ করছেন, হনুমানও চড়- লাথি- গুঁতো মারছেন আবার দেবী ষষ্ঠী বাঙালী ঘরের বধূর মত, পারিপার্শ্বিকের ছোঁয়া ছিল আকারে পোশাকে পরিচ্ছদে।কালীঘাটের শিল্পীদের তৎকালীন সামাজিক ঘটনার সমালোচক-শিল্পী ও বলা চলে। সামাজিক পটের অধিকাংশই আঁকা হযেছিল ১৮৬০-১৯০০ এর মধ্যে। প্রাচীন পরম্পরাকে সাথে রেখে নতুন পরম্পরায় এঁরা ছবি আঁকতেন, এই রীতি ভারতের অন্যন্য তীর্থস্থানের শিল্পীদের মধ্যে দেখা যায়না। কালীঘাটের ধর্মনিরপেক্ষ পটচিত্রগুলি ১৯ শতকে “বাবু” সমাজের চিত্র উপহার দিয়েছে।কালীঘাটের লোকায়ত পটচিত্রগুলিতে উচ্চতর সমাজের উজ্জ্বল ছবি ফুটিয়ে তোলা হত। সে সময় যেসকল বাঙালীরা অর্থবান ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন তারা কেউ ছিলেন সরকার, মুৎসুদ্দী, দেওয়ান বা চাকুরে ছিলেন। এঁরা বাবু সম্প্রদাযের আদি পুরুষ, চূড়ান্ত বিলাসিতায় জীবন কাটাতেন, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত “বাবু” দের চেহারা বিচিত্র! নক্সা করা কোর্তা, ধুতি লম্বা কোঁচা, টানা টানা লম্বা চোখ, নাগরাই জুতো, বাবরি চুল ইত্যাদি। বাবুদের সাথে বিবিদের ছবিও দেখা গেছিল, এমনকি বারবনিতারাও ছিল এসব পটচিত্রে; গোলাপ হাতে গোলাপ সুন্দরী, আলবোলা হাতে তামাকসেবিনী। কেউ আবার প্রসাধনরতা; কেউ বীণাবাদনরতা; কেউ ফিরিঙ্গি কেতায় অভ্যস্ত। আসলে সবটাই বিদ্রুপরস মাখানো কিন্তু ব্যাঙ্গচিত্র উপভোগ্য। অবশ্য কিছু উচ্চস্তরের রমণী মূর্তি আঁকা হয়েছে। এই বিদ্রুপের জ্বালায় বা হয়ত পটের মর্যাদাহানীকর স্বল্পমূল্যের জন্য সম্পন্ন গৃহস্থরা সাজসজ্জার উপকরণ থেকে কালীঘাটের পটকে বর্জন করেছিলেন। কালীঘাট শৈলী আজ জীবিত না হলেও অনুভবে আসে,তৎকালীন মানুষের ধর্মীয় আকর্ষণ,সামাজিক রুচি স্প্ষ্ট হয়। পটশিল্প যামিনী রায়ের মত শিল্পীর চিন্তায়,কর্মে প্রভাব ফেলেছিল, এই ঐতিহ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়। কলকাতার কালীঘাটের পট চিত্রকলা ভারতীয় শিল্পের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা। কালীঘাট মন্দিরের কাছে উনিশ শতকে এই চিত্রশিল্প বিকাশ লাভ করেছিল। সেই সময় তীর্থযাত্রীরা স্মারক হিসেবে এই ছবিগুলি কিনে নিয়ে যেত। হিন্দু দেবদেবী, পৌরাণিক ঘটনাবলি ও সমসাময়িক নানা ঘটনাকে এক বিশেষ ধরনের ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাই ছিল এই ঘরানার বৈশিষ্ট্য।
এই কালীঘাটের পটের বিশিষ্টতা হল –
এই পটের শৈলী প্রাধানত রেখাভিত্তিক। তাই এই পটে রঙের প্রসঙ্গ প্রথমদিকে আসেনি।
এমন সুডৌল বলিষ্ট মূর্তি আমরা কালীঘাট পটে দেখতে পাই যা আর অন্য কোনও শিল্প ধারায় নজরে পড়ে না।
আলতানুটি ও গোলেলর জাদু কালিঘাট পট শৈলীকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। আলতানুটি হল তুলি যা দিয়ে আলতা পরানো হত। তাই রেখার বৈশিষ্ট্য কালীঘাটে অন্যরকম। আর গোলেল হল ডৌলতার পর্দা বা টোন।
সামাজিক চিত্রে শিল্পীর যে রসিক মনের পরিচয় মেলে তা অন্যত্র সুলভ নয়। চরম উৎকর্ষের সময় কাল ১৮৫০ থেকে ১৯১৫।
তীর্থক্ষত্র হিসাবে যেমন কালীঘাটের খ্যাতি যেমন সর্বত্র তেমনি কালিঘাটের পট ও সর্বত্র সমাদৃত এবং দেশ বিদেশে তার শিল্পগুনের জন্য সুপরিচিত। কালীঘাটের পটের শিল্পশৈলী অভিনব ও কৌতূহলদ্দীপক।উনিশ শত্কে কোলকাতায় তিনটি উন্নতমানের চিত্র্পদ্ধতি ছিল-
(১)কালীঘাট পটচিত্র (২)বটতলার ছবি বা পটচিত্র
(৩)কোম্পানি চিত্রপদ্ধতি
বাংলাদেশের গাজীর পটচিত্রঃ
আমাদের গাজীর পট আজ আমাদের কাছে নেই। পটচিত্রটি আজ ব্রিটিশ জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। ব্রিটিশরা বিশ শতকের প্রথম দিকে সেটি লন্ডনে নিয়ে যায়। এছাড়াও আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি এবং দুটির বেশি গাজীর পট গুরুসদয় দত্ত যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। গাজীর পটের কথা বলতে গেলে, আমাদের জানতে হবে, কে এই গাজী? গাজী আমাদের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া লোকজ গল্পের নায়ক গাজী। এখানে গাজীর ওপর চিত্র আঁকা হয়েছে। যা সঙ্গীতের সাথে পটুয়ারা দেখান। গাজী পীর ইসলামের একজন সেবক ছিলেন। তিনি সত্যপীর ও জিন্দাপীর নামেও পরিচিত। তিনি বাঘের পিঠে চড়ে সুন্দরবন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। জানামতে, বৈরাগ নগরের শাসক ছিলেন সিকান্দার। তার ছিল তিন ছেলে। তার প্রথম ছেলে জুলহাস শিকার করতে গিয়ে হারিয়ে যান। তার দ্বিতীয় ছেলে ছিলেন গাজী। কালু ছিলেন তাদের পালিত ছেলে। কালু গাজীর সঙ্গী ও কালু দেওয়ান নামে পরিচিত। রাজা সিকান্দার যখন গাজীকে রাজ্য চালানোর ভার দেন, তখন গাজী কালুকে সাথে নিয়ে সুন্দরবনে পালিয়ে যান। ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, তেরশতকে বারোবাজার এলাকায় যেসব সূফি, পীর ইসলাম প্রচারে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে গাজীই ছিলেন প্রধান। তারা ফকির বেশে বহু এলাকা ভ্রমণ করে ব্রাহ্মণনগরে আসেন। ব্রাহ্মণনগরের রাজা ছিলেন মুকুট রায়। তাঁর মেয়ে চম্পাবতী। চম্পাবতীকে প্রথম দেখায় গাজীর ভালো লেগে যায়। সে চম্পাবতীকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু বাঁধা হয় ধর্ম। শুরু হয় যুদ্ধ। গল্পে আছে, মুকুট রায়ের কুমির বাহিনি আর গাজীর বাঘ বাহিনির মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। যাকে বাংলায় বলে, বাঘে-কুমিরের যুদ্ধ। যুদ্ধে গাজী মুকুট রায়কে পরাজিত করে এবং চম্পাবতীকে বিয়ে করেন। তারপর তারা ঝিনাইদহের জেলার বারোবাজারে বসবাস শুরু করে। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। ঐ এলাকার শ্রীরাম রাজার বীর দিঘির দক্ষিণ দিকে তাদের কবর রয়েছে। বর্তমানে সেটি গাজী-কালু-চম্পাবতীর মাযার নামে পরিচিত। এইসব গল্প থেকেই গাজী-কালু গীতিকা, পাঁচালী, নাটক, পালা ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে সেসব কাহিনী সুপরিচিত।
কেন্দ্রীয় প্যানেলে অঙ্কিত হয় বাঘের পিঠে উপবিষ্ট গাজী এবং তার দুপাশে থাকে মানিক পীর ও কালু পীর। ওপর থেকে দ্বিতীয় সারির মাঝে থাকে নাকাড়া বাদনরত ছাওয়াল ফকির এবং তৃতীয় সারির মাঝের প্যানেলে থাকে কেরামতি শিমুল গাছ ও তার ডানে আসা হাতে গাজীর গুণকীর্তনরত দুই মহিলা। কেন্দ্রীয় প্যানেলের নিচের সারির মাঝে অঙ্কিত হয় গাজী পীরের ভগ্নী লক্ষ্মী ও তার বাহন পেঁচা। দ্বিতীয় সারির ডান দিকের প্যানেলে থাকে মকর মাছের পিঠে উপবিষ্ট গঙ্গা দেবী এবং সর্বনিম্ন সারির বামে থাকে যমদূত, ডানে কালদূত ও মাঝে মানুষের মাথা রন্ধনরত যমরাজের মা। প্রতিটি ফ্রেমের চারপাশে সাদার ওপর খয়েরি রঙের শেকল নকশাকৃত বর্ডার থাকে। গাজীর পটের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো রঙের ব্যবহার ও বর্তনা-সৃষ্টি সম্পর্কে অনীহা।
একসময় গাজীর পট বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। আগেকার বায়োস্কোপের মত। আজকে আমরা সাংস্কৃতিক দৈন্যদশায় ভুগছি। শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের সম্পদ হারানোর কারণে। তুর্কি-আফগান আমলে বারোবাজার মুসলিম শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল। আসলে ইসলাম যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন পীর-সুফিরা ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তাদের উদার কথা ও বাণী অন্যদের ইসলাম গ্রহণে আকর্ষন করে। গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প ইসলামের উদারনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমান করে। এই গল্প থেকে এটাও আমরা দেখতে পাই যে, গাজী ও চম্পাবতী দুজন আলাদা ধর্মের হয়েও তাদের মিলন ও সম্পর্ক। পূর্ববঙ্গে মুসলমান জনসমষ্টির সংখ্যা গরিষ্ঠতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফিরা যে সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছিল তার উদাহরন হচ্ছে এই গাজীর গল্প। সকলকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল ইসলামের। জাত নিয়ে কোন বাঁধা ছিল না। মুসলমানদের গাজীর পটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী কিংবা গাজী পীরের বীরত্বব্যঞ্জক বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকান্ড অঙ্কিত হয়।এতে গাজীকে কখনও দেখা যায় সুন্দরবনের রাজার সঙ্গে লড়াই করতে; কখনও ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে সমাসীন; কখনও মাথায় টুপি অথবা রাজমুকুট, পরনে রঙিন পাজামা কিংবা ধুতি, এক হাতে চামর বা ত্রিকোণ পতাকা এবং অন্য হাতে তলোয়ার বা মুষ্টিঘেরা জ্যোতি। গাজীর পটে মানিকপীর, মাদারপীর, সত্যপীর, কালুফকির, বনবিবি প্রভৃতি সম্পর্কে নানা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ছবিও প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশে এক সময় গাজীর পট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টির সুধীর আচার্য ছিলেন একজন খ্যাতনামা পটুয়া। তিনি ১´ × ৮´ আয়তনের গামছার ওপর ইটের গুঁড়া ও তেঁতুলের বিচির আঠায় তৈরি জমিনে লাল, কালো, হলুদ, সবুজ প্রভৃতি রঙে একটি বড় প্যানেলে বাঘের পিঠে গাজী এবং চবিবশটি ছোট ছবির খোপ অাঁকেন। এসব খোপে আছে মকরবাহিনী গঙ্গা, গাজীর আসা, খান্দুয়া বাঘ, যমদূত প্রভৃতি।বর্তমানে চারুকলার ছাত্ররা পহেলা বৈশাখ উৎসবে বিভিন্ন দেয়ালে এবং সরাতে গাজীর পটের চিত্র আঁকেন। যার মাধ্যমে তারা কিছুটা হলেও আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনছে।
জাদুপট বা যমপট বা চক্ষুদান পটঃ
পটচিত্রের একটি অনন্য ধারা এই যম পট বা জাদু পট। বাঁকুড়া জেলার ভরতপুর গ্ৰামে এর দেখা মেলে , এগুলি প্রচলিত সাধারণত প্রান্তিক সমাজে, যখন কেউ মারা যান তখন এই জাদু পটিয়ারা মৃতের বাড়ী গিয়ে মৃতের উদ্দেশ্যে গান করে বিভিন্ন কথা বলে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে। তারপর এই জাদু পট বার করে তার চক্ষু দান করে(প্রাণ প্রতিষ্ঠা) তাই এই পটের আরেক নাম চক্ষু দান পট। তারপর পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির বাড়ী থেকে মৃতের ব্যবহারিত জিনিস পত্র টাকা প্রভৃতি দাবী করে এবং উক্ত পটটিকে নদীতে প্রবাহিত করে মৃত ব্যক্তির আত্মাকে পরপারে পাঠিয়ে দেয় ।
চক্ষুদান পট সাধারণত সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের শ্রাদ্ধবাড়িতে প্রদর্শিত হয় মৃতের আত্মার শান্তি কামনায়।বাঁকুড়ার ভরতপুরের একশ্রেণীর পটুয়ারা এখনও এই পট দেখিয়ে ও গান শুনিয়ে জীবিকার্জন করেন।শ্রাদ্ধবাড়িতে উপস্থত হয়ে তিনি এই পটের গান পরিবেশন করেন।
বিনিময়ে গৃহস্থরা থালা বাটি উপহার দেন।চক্ষুদান পটের নিয়ম হলো গান শোনানোর পর নদীতে এই পট বিসর্জন দিতে হয়।পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার ‘জাদু-পটুয়া’-রা ছোট্ট ছোট্ট (মোটামুটি ৭.৫ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ১০ সেন্টিমিটার লম্বা) একধরণের পটচিত্র আঁকেন…তার নাম ‘ঘটান পট’…অনেকে একে চক্ষুদান পট’ও বলেন…ঘটান পটের ব্যবহার এখন’ও গ্রামীন সাঁওতালদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বা পারলৌকিক রীতি-রেওয়াজের মধ্যে দেখা যায়…কোনো সাঁওতাল পরিবারে কারুর মৃত্যু হলে ঘটান পট নিয়ে জাদু-পটুয়া হাজির হ’ন সেই বাড়িতে…ঘটান পট সম্বন্ধে Stella Kramrisch লিখেছেন:
“…the Jadu-patuas practice magic (jadu) through some of their paintings. These they paint for the tribal Santal. The painter comes with his ready-made schematic portraits of which one or the other is bound to fit the type of the recently dead among the tribal Santal whose house he visits. The dead are believed to wonder blindly in the other world until jadu-patua gives them eyesight by painting the eyes in the “portrait.” These “portraits” painted for the Santal are distinguished from the work of the chitrakars by their economy of colors.”
এই পটে তারা নানা ধরনের প্রাকৃতিক রং ব্যবহৃত করেন যেমন- ইঁটের গুঁডো , পাথরের গুঁড়ো, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি, তুলি বানান কঞ্চির ডগায় পশুর লোম বা পাখির পালক দিয়ে । এই পেশা তাদের পরিবারে বংশানুক্রমিক ভাবে চলে আসছে।
পৌরানিক পট
পৌরানিক বিভিন্ন গল্প ও গাথা এই পটের উপজীব্য। সেগুলি হল রাবন বধ, সীতা হরণ, রাজা হরিশ্চন্দ্র, কৃষ্ণলীলা, দুর্গালীলা, সাবিত্রী-সত্যবান, মনসা মঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, আনন্দ মঙ্গল, শিব পার্বতীর বিয়ে,মাছের বিয়ে ইত্যাদির মতো পৌরাণিক গাঁথার উপর নির্ভরক করে তৈরি হয় ।
ঐতিহাসিক পটঃ
ঐতিহাসিক পটের উপজীব্য যা এর নাম থেকেই প্রকাশিত তা হল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আজাদ্ হিন্দ্ বাহিনী ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আণবিক বোমাবর্ষণ,স্বাধীনতা যুদ্ধ,গান্ধীজির অসহোযোগ আন্দোলন ইত্যাদির মতো ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উপর নির্ভর করে এই পটগুলো তৈরি হয় ।
এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি নানা কৌতুক, রঙ্গরসসম্বলিত কাহিনী, ব্যঙ্গচিত্র এবং সামাজিক দুরবস্থার চিত্রও অঙ্কিত হয়। কখনও কখনও প্যাঁচা, বানর, গরু, বাঘ, সাপ, কুমির এবং গাছপালাও স্থান পায়। লোকধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ অনেক সময় পটুয়া এবং পটচিত্রকে ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। অনেকে গৃহে পটচিত্র সংরক্ষণ করাকে কল্যাণ এবং দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলেও মনে করে।
বারো-তেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার পটুয়ারা এ শিল্পকর্ম নির্মাণে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের ঢাকা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি ও মেদিনীপুর ছিল এ শিল্পের প্রধান ক্ষেত্র। মানচিত্রের মতো জড়িয়ে একটি বংশদন্ডের মাথায় ঝুলিয়ে পটুয়া সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র প্রদর্শন করা হতো। এগুলি ছিল তখন সাধারণ মানুষের ধর্মতৃষ্ণা নিবারণ ও চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। পটচিত্রের সঙ্গে পটুয়া সঙ্গীতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে; পটে যা অঙ্কিত হয়, গানের বাণীতে তাই বর্ণিত হয়। এ গান পাঁচালির ঢঙে গাওয়া হয়।বিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে “বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট” চিত্রশিল্পের বিশেষ এক ঘরানার জন্ম হয়। এই শিল্পকলার পুরোধাপুরুষ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টের প্রভাবে মুঘল চিত্রকলা ও পাশ্চাত্য শিল্পীরীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা চিত্রকলার এই নিজস্ব ঘরানাটির জন্ম দেন।পরবর্তীকালে যামিনী রায়ের চিত্রকলাতেও এইসব প্রাচীন লোক শিল্পের ছাঁপ দেখা যায়। তাঁর মৌলিক শিল্প কীর্তিতে পটশিল্প রীতিকে তিনি অন্য মাত্রা দিয়েছিলে।
বর্তমানেও বিভিন্ন সামাজিক বিপর্যয় যেমন আয়লা,বা ভূমিকম্প এর ভয়াবহতাই বা অতি সম্প্রতির করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে সচেতনতার বার্তাই হোক শিল্পী তাঁর পটের ছবিতে ও গানে তাঁর অনুভব প্রকাশ করে চলেন।
★★★