ছবিঃ গৌতম মাহাতো
আমরা
বিপর্যয়ের আভাস সারল্যকেই প্রথম অনুধাবনের সুযোগ দ্যায়।তা সে প্রাকৃতিক, অতিপ্রাকৃতিক,সামাজিক বা সাংসারিক যাই হোক।আসলে সৃষ্টি নিয়মেই তাই।মা তার দুর্বল সন্তানেরই বেশি খেয়াল রাখে।অবলা, অবোধরা তাই বিপর্যয়েরই মাপ কাঠি।কিন্তু এই সব সময়ই আমাদের আত্মবিস্মৃতি ঘটে।আর এটা ঘটে জেনে বুঝেই।কারণ আমরা ভাবতে চেষ্টা করি আত্মবৈভব থেকে।এমনই একটা আড়ম্বরতা ও আত্মবিস্মৃতি ঘটেছিল সে বছর।যা দিয়ে আমিত্বের সুচনা।সময়টা যদ্দুর মনে পড়ে বৈশাখ।
বাবানের যখন দশ এগারো বছর,তখন বড় জেঠু মানে বাবানের বাবা মারা যায়।কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা শুধু দিয়েই যায়,চাওয়া পাওয়ার হিসেব সেখানে বাতুলতা মাত্র।বড় জেঠু তাদেরই দলের।বাকিরা সেখানে শুধুই কিছুর একটা তাগিদে বড় কিছু ধরে রাখার সাধ্যাধিক চেষ্টা করে।তখন অতসব বুঝতাম না কিন্তু এখন অনুভব করতে পারি বড় জেঠু মারা যেতেই একান্নবর্তী পরিবারটার হাড় পাজরা কেলিয়ে উঠেছিল। আমরা ছােটরা বুঝে গেছলাম সবাই যে যার ভালো থাকার জন্য আমাদের হাতে একাকিত্বগুলোকে ভাগ করে দিচ্ছে।
বৈশাখের প্রথমের দিকে বাড়িতে বড়দের রূদ্ধদ্বার বৈঠক। আমরা খুড়তুতাে জ্যাঠতুতাে পিঠোপিঠি পাঁচ জন আমবাগানে তখন হৈ হৈ করে আম পাড়ছি। হঠাৎ পাশের বাড়ির বিষ্ণুদা এলো। আমাদের চেয়ে একটু বড়। লতায় পাতায় ওর মা কেমন এক সম্পর্কে পিসি হন। পরে পাশের বাড়ির দীনু কাকুর সাথে বিয়ে হয় | ওদের বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির সে কারণেই ঘনিষ্ঠতাও বেশ অম্ল-মধুর।মাঝে মধ্যে ছােট কাকুর ছেলে তাতান ওর মাকে ‘কাকিমা’ বলে ছুট লাগত আর বিষ্ণুদার মা উদোম গাল দিতে দিতে পাড়া মাথায় করত।এটা ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। সে কারণে বিষ্ণুদার মাকে আমরা একটু সমঝেই চলতাম ।বিষ্ণুদা আম বাগানে আসতেই আমরা একটু তটস্থ বোধ করছিলাম বোধহয়।এই বিষ্ণুদা নামক কালটি ভীষণ বােকা বানাতাে আমাদের। বিষ্ণুদা বলল – কি রে আম পাড়ছিস বুঝি? তা পাড়। আমি নিচ থেকে পাকাগুলাে দেখিয়ে দিচ্ছি।
তাতান সঙ্গে সঙ্গে সাবধানবাণী উচ্চারণের সুরে বলল- না, না ওকে দলে নিস না। ও নিশ্চই কোন বুদ্ধি ফেঁদেছে।
কিন্তু শেষ বেশ নিজেদের সুবিধার্থে ওকে দলে রাখতেই হল। আমরা | একটা একটা করে মগডালে গিয়ে আম পেড়ে ওকে দিচ্ছি আর বিষ্ণুদা গামছা পেতে তাতে সাজিয়ে রাখছে। আমের সংখ্যা বেড়েই চলেছে আর আমাদেরও জেদ চেপে বসছে। হঠাৎ একসময় চেঁচিয়ে বলে উঠল- আসছি গো মা…
তাতান বলল -কি হল?
-মা ডাকছে আমি চলি রে।তোরা আম পাড়,আর পাড়া হলে সোজা বাড়ি চলে যাস।অনেক ব্যালা হল কিনা!
বলেই গামছাতে আমগুলো পুঁটলি বেঁধে সোজা ঘরের দিকে চোঁ চোঁ করে হাঁটা লাগাল।
আমি বললাম আর আম!
-ও,ও বেলা বাড়িতে এসে নিয়ে যাস।চলি রে।দেরী হলে মা আবার খুঁজতে খুঁজতে এখানেই না চলে আসে।তখন সব কটার কি দুর্গতি হবে বুঝতে পারছিস?
আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম আর কেউ কোনও কথা বাড়ালাম না।তাছাড়া বাড়িয়েও বিশেষ লাভ হত না কারণ আমরা তখন আম গাছের ডালে ডালে রাজপুত্র হয়ে ঝুলছি,মানে কিস্কিন্ধার রাজপুত্র।আর জুল জুল চোখে দেখছি বিষ্ণুদার চলে যাওয়া। আমরাও জুগনি ধরা মানুষের মত গাছ থেকে নেমে ঝাপসা চোখে চেয়ে আছি ব্যাঙাচির মতো মুখ করে। একটু পরেই বুঝলাম ওকে কেউই ডাকে নি। কিন্তু ততক্ষণে বহু দেরী হয়ে গেছে। তাতান শুধু একটাই কথা বলল – শালা!
আমরা যথাবিধি পূর্বক একে অপরের ঘাড়ে দোষ থোপে দিতে দিতে বাড়ি ফিরে সােজা রান্না ঘরে।খুব খিদে পেয়েছে। আমরা সারি করে বসেছি। হঠাৎ গ্রুপ লিভার ছোট পিসি হাজির।- কি রে তোরা এখানে ? তাতান বলল, মাকে বল না তাড়াতাড়ি খেতে দিতে,খুব খিদে লেগেছে ছোট পিসি। ছােট পিসি বলল – আজ থেকে যে যার ঘরে খাবি, আলাদা হয়ে গেছে। শুধু রান্নাই নয়, সব আলাদা। শােওয়া থাকা সব আলাদা আলাদা। এখানে আর রান্না হবে না। বাবাই আমার দিকে, আমি বাবাই-এর দিকে, বাবান তাতানের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। আসলে তা না আমরা খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম এই আলাদ শব্দটার ঐকান্তিক গভীরতা আর তার ব্যবহারিক মানে। কিছুতেই বুঝে পারলাম না। তবে এটুকু বুঝেছিলাম আমাদের শৈশবের বাটোয়ারা হয়ে গ্যাছে।আমাদের চিলেকোঠার ভেতর গজিয়ে উঠছিল ছোট ছোট কয়েকটি চোরাকুঠরি।যার কোনও হৃদয় নেই শৈশব নেই,নেই কোনও একান্নবর্তী।দন্ত-বিকশিত করে যে দাঁড়িয়ে আছে সে হল “আলাদা” নামক এক শব্দের বৈভব।
★★★