কবি মিশ্র-র ছোটগল্প

 ছোটগল্প

                                                                                                ছবিঃ গৌতম মাহাতো

কবি মিশ্রর ছোটগল্প 

                        


গদ্যের মাধ্যমই তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয়।তবে কবিতাও লেখেন।নিজে “দেশ মানুষ” নামের নিউজ পোর্টালের সম্পাদিকা।সংসারের মাঝেই তিনি যাবতীয় বৃত্ত তাঁর।আর তাঁর মুক্তি গদ্যে।আজকের ছোটগল্পে হাত খুললেন তিনি।ইনিও বাইফোকালিজম এর একজন অন্যতম সদস্যা।

                          দোল
               ******


        দুপুরের রূপালী রোদ এসে পড়ছে চোখে মুখে। কিছু কুচো চুল ও এসে উড়ে পড়েছে কপালে।একটু চাপা রং হলেও, চোখে মুখে একটা শ্রী আছে। খুব আনমনা আজ মাধবীলতা। দক্ষিণের বারান্দায় একাই বসে আছে অনেকক্ষণ। এখন ও কিছুটা শীত শীত ভাব আছে ।এবারে যেন একটু বেশি দিন ঠান্ডা থাকলো।

বাড়ির পাশে রাস্তায় ছোট বড় সবাই হৈচৈ করছে। আজ দোল। রঙে রঙে রঙিন বাড়ির উঠোন, ঘর দুয়ার সব। কিন্তু মাধু মানে মাধবীলতার মনে  এসবের কোন আঁচ লাগেনি। 

এই দিনটা সেভাবে কেউ বিরক্ত ও করে না। কত স্মৃতি , কত কথা মনের কোনে ভিড় করে। 
-কাম্মা,তুমি রং মাখবে না ?
-তিন বছরের মংপু, কখন এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি মাধু। মংপুর ডাকে ঘুরে দেখে রং মেখে ভুত হয়ে তার সামনে। ওর মা শেফালী ছুট্টে এসে ওকে ধরে নিয়ে গেল। মাধুর কিন্তু বেশ ভালোই লাগছিল। 
বাড়ির বড়রা অবশ্যই কেউ রং মাখেনি।কিন্তু ছোটদের আর কত ধরে রাখবে। খুব ভালোবাসে ছেলেটাকে , ওরই মতো বয়স হতো নিজেরটার।

মাধু আবার নিজের জগতে ডুবে যায়। মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। ওরা দুই জা উঠোনে বসে পুকুরের ধরা মাছ কাটাকাটি করছে। সেদিনও ছিল এমনই এক দোলের দিন। ওরা দুভাই পুকুরের মাছ ধরে সকালের টিফিন খেয়ে বেরিয়ে যায় বন্ধুদের সঙ্গে রং খেলবে বলে। বড়ো সুশান্তর একছেলে, একমেয়ে।  আর প্রশান্ত ছোট ভাই। 

বাড়িতে মেয়ে নেই, তাই শ্বশুর মশায় বৌমাদের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। ওর তিন বছর বিয়ে হলেও কোন বাচ্চা হয়নি। নিজেরাই নেয়নি। তাছাড়া ট্রান্সফার এর চাকরি প্রশান্তর। তাই একটু থিতু না হলে বাচ্চা নিতে ও আগ্রহী নয়।কিন্তু বাড়ির বড়রা সে সব শুনবে কেন।

 সেই বছরই বাড়ির কাছাকাছি ট্রান্সফার হয়ে আসে প্রশান্ত। বাড়ি থেকে ঘন্টা দুয়েক লাগে। ওরাও বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। সেই সময় মাস দুয়েকের পেগনান্ট ছিল মাধবীলতা। কেউ জানত না। ভেবে ছিল মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পেয়ে ওই দিনই জানাবে । কিন্তু সব কিছু যে এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে, মাধু বুঝতে পারেনি। কতবার বলে ছিল রিপোর্টটা আগে আনতে ..কিন্তু প্রশান্তের জেদ ওই দিনই আনবে। 

রং খেলে রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মোটরবাইক আ্যাক্সিডেন্ট হয়। বন্ধুরা স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়িতে খবর দেয়। বাড়ির সবাই ছুটে যায়। অবস্থার অবনতি হলে বড় নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করে ওরা। বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে কিছু বলতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ। 

এদিকে মাধুর শরীর ও খারাপ হচ্ছে। এত টেনশন আঘাত, আর নিতে পারছে না। ভেতরে নড়াচড়া ও অনুভব হচ্ছে। ভাবতেই পারেনি প্রশান্তের খারাপ কিছু হবে। কিন্তু বাহাত্তর ঘন্টা পরে যখন নার্সিংহোম থেকে জানালো আর কিছুই করার নেই। খবরটা মাধু বিশ্বাস করতে পারেনি প্রথমে । যখন বাপের বাড়ির সবাই আসতে লাগলো তখন বুঝতে পারলো সব শেষ। 

সেই যে অজ্ঞান হয়ে ছিল, তার পর কি কি ঘটেছে কিছুই জানে না। শ্বশুর বাড়ির সবাই ভেবেছিল প্রশান্তকে বাড়িতে আনলে হয়তো মাধুর জ্ঞান আসবে।কিন্তু তাতেও কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি মাধুর মধ্যে। আরও অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাড়াতাড়ি করে ওকে ও হাসপাতালে ভর্তি করে । যখন জ্ঞান ফেরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে। পাশে দিদি , বৌদি দাদা সবাই অপেক্ষা করছে । কয়দিন পর হাসপাতাল থেকে বাবার বাড়ি ফিরে একটু সুস্থ হয়ে শ্বশুর বাড়ি আসে। পেটের বাচ্চাটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই কেউ সেই আগের মতো ওর সঙ্গে ব‍্যবহার করে না । মনে হয় ও সব কিছুর জন্য দায়ী। এই ভাবে একা যন্ত্রণা বহন করা যে কতটা কষ্ট কেউ বুঝতে চায়না । 

ছেলে চলে যাওয়ার পর শ্বশুর শাশুড়ি ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। আজ সেই দিন। কতগুলো দিন কেটে গেল। সময় কাটানোর জন্য স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ানোর জন্য ঢুকেছে। বাড়িতে মংপুর সঙ্গে অনেকটা সময় কেটে যায়। কিন্তু দিনের শেষে রাতটুকু যেন রাক্ষসের মতো গিলে খেতে আসে। সমস্ত আশা , আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণা যেন চিৎকার করে বেড়িয়ে আসতে চায়। 

কখন যে চোখের জল তার সীমা অতিক্রম করেছে বুজতে পারেনি মাধু।
 পেছন থেকে মংপু গলা জড়িয়ে বলে,
–কাম্মা কাঁদছো কেন ?
— মংপুকে জড়িয়ে ধরে আরোও কাঁদতে থাকে মাধবীলতা…কোন উত্তর দিতে পারেনি …
উত্তর যে হয় না …

                                ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *