পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর লেখা একটি ছোটগল্প।
গৌ ত ম ম ণ্ড ল -র ছোটগল্প
মুখতারউল্লার হাসি
ফিক করে হেসে উঠল মুখতারউল্লা। আর তার আকস্মিক হাসিতে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সন্দীপ ও আন্নুর। রিক্সার গড়গড় শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই দুপুর রোদের ঢাকা শহরে। সকালের নাস্তা করে সন্দীপ আর আন্নুর হাঁটতে হাঁটতে যাত্রাবাড়ী রোড থেকে দোয়েল চত্বর অব্দি এসেছিল, কার্জন হাউসের পাশে বসে গল্পে গল্পে অন্তত প্যাকেট খানেক কিং সাইজ সিগারেট উড়ে গেছে। তারপর এই দুপুর রোদে রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছে পুরানো পল্টন যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তা, সন্দীপের যা হাঁটার বাতিক, ওই অব্দি হেঁটে যেতেও পারতো। দু’ একবার বলেওছে আন্নুরকে ” আরে ব্রাদার, আমরা যাচ্ছি দাবাত রক্ষা করতে, ফজলুল সাহেবকে বলে দিয়েছি যেন কম মশলাপাতি দিয়ে গোস্ত রাঁধেন, যাতে দুপুর বেলা এই গরমে পেট পুরে খেতে পারি। ও হ্যাঁ, পাঁকাল মাছের ঝালও হচ্ছে। তা, না হাঁটলে পেট দুটো প্রস্তুত হবে ক্যামনে ব্রাদার?” আন্নুর সশব্দে প্রতিবাদ করে বলেছিল ” দোহাই সন্দীপ দা, আর হাঁটিওনা আমারে, আমার ইন্তেকাল হয়ে যাবে।” সত্যি কথা, সন্দীপ মনে হয় হেঁটে বিশ্বজয় করতে চায়। এই তো সকাল সকাল গুলিস্তান অব্দি হেঁটে গিয়ে চা খেয়ে এসেছে। বলে কিনা ” আহ, চা যদি পৃথিবীর কোথাও খেতে হয় তো গুলিস্তানেই খাবো। হে ঈশ্বর, হে আল্লা, হে সদাপ্রভু, বিশ্বের সব জায়গায় একটা করে গুলিস্তান বানিয়ে দাও।”
আন্নুরের জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে রিক্সা ধরতে হোলো সন্দীপকে। সিগারেট টানতে টানতে কার্জন হাউসের সামনে বসে যে আলোচনা হচ্ছিল, তারই বাকী অংশ আবার শুরু হলো রিক্সায় উঠে।
“জানো, আন্নুর, আমার তো মনে হয় ধর্মকে বাদ না দিলে আর এ সভ্যতা এগোনো দূরে থাক, বাঁচবেনা। নিজেরাই খুনখারাবি করে শেষ হয়ে যাবে।” সন্দীপের আশঙ্কাকে পুরো মাত্রায় সমর্থন করে আন্নুর। “একদম ঠিক, না তোমার দেশ, না আমার দেশ, না পৃথিবীর কোনো দেশ ভালো আছে। কেউ ভালো নেই। আর ভালো থাকবেনা কেউ। শুধু ধর্ম ধর্ম করে শেষ হয়ে গেল।”
“ঠিক বলেছো, ধর্ম এতটাই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে যে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে” সন্দীপ এবার একটু ঘন হয়ে ওঠে। “সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিভেদ না জিইয়ে রাখতে পারলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকবে না, তাই এত উদ্যোগ, এত রাজনীতি ধর্ম নিয়ে।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ। আবার কথা শুরু হয়। আন্নুর খুব আবেগঘন হয়ে বলে, ” তাই যদি পৃথিবীটা একটা ধর্মে চলে যেত, এই ধরো, পুরো বিশ্ব মুসলিম হয়ে গেল, কিংবা হিন্দু… অন্তত তাহলে রক্তপাত তো হতোনা। অন্তত মুসলিম তো মুসলিমের খুন দেখার জন্য…”
হঠাৎ ফিক করে হেসে ওঠে রিক্সাওয়ালা মুখতারউল্লা। সন্দীপ, আন্নুর দু’জনেই থেমে যায়। দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুজনের মুখেই জিজ্ঞাসা। মনে হয় দুজনেই মুখতারউল্লার মুখটা দেখার চেষ্টা করে,দেখা যায়না। শেষে মুখ খোলে আন্নুর।
“ওই মিঁঞা, হাসলে ক্যানো? কথাগুলা ঠিক লাগতেছে না? ভুল তো লাগবেই, সারাক্ষণ নিশ্চই ধর্ম ধর্ম করে বুঁদ হয়ে আছো?” মুখতারউল্লার মুখের ভাবের কোনো পরিবর্তন হয়না। সে আবার একবার ফিক করে হেঁসে ওঠে। এবার আন্নুর রাগে গরগর করে বলে ওঠে ” আরে মিঁঞা, থামাও রিক্সা। হাসতেছো ক্যানো?” সন্দীপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারপর সম্বিত ফিরলে বলে ” দাঁড়াও, দাঁড়াও আন্নুর… তা ভাই আপনার হাসির কারণখানা বলবেন?” মুখতার গলায় ঝোলানো গামছা দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে নিয়ে পিছন ঘুরে একবার দ্যাখে, তারপর বলে “ক্ষমা করবেন মিঁঞা, পৃথিবীর সব মানুষ এক ধর্মে চলে গেলেও দাঙ্গা হতো, খুনখারাবিও হতো। ধর্ম না থাকলে মানুষ দাঙ্গা করার অন্য যেকোনো একটা কারণ ঠিক খুঁজে বের করতোই।”
“দ্যাখেন মিঁঞা, এটা তো মুখে বল্লেই মানবোনা, সাবুদ লাগবে” সন্দীপ একটা মোক্ষম চাল দেয়। ” ধর্ম না থাকলে মানুষ রক্তপাত করার জন্য, বুকে ছুরি বসানোর জন্য অন্য কোনো কারণ খুঁজে নিত, এইটা আপনার কল্পনা, এর কোনো প্রমাণ সাবুদ নেই।”
মুখতারউল্লা নির্বিকার, রিক্সার প্যাডল পা দিয়ে ঠেলে, দুই ঠোঁটের মাঝে সামান্য চিড়। সম্ভবত কিছুটা অধৈর্য হয়ে সন্দীপ বলে ” আরে কী হলো মিঁঞা,কথা বলেন।” মুখতারউল্লা হাসি হাসি মুখে আঙ্গুল নির্দেশ করে দেখায় “ফজলুল সাহেবের বাড়ি এসে গেছে, আসেন।” সন্দীপ রিক্সা থেকে নামতে নামতে পকেটে হাত ভরে। “আরে এখন না মিঁঞা, সন্ধার সময় ধানমণ্ডিতে থাকবো, তখন ভাড়া দিবেন।” সন্দীপ, আন্নুর দুজনেই একটু অবাক হয়। “আরে মিঁঞা, অবাক হচ্ছেন কেন? সাবুদ চাইলেন তো? আসেন সন্ধাবেলা। অনেক কথা হবে” সেই নির্বিকার হাসি মুখতারউল্লার মুখে।
★★
বড় রাস্তা থেকে মুজিবুর রহমানের সেই অভিশপ্ত বাড়িতে যেতে গেলে বাম হাতে এক দুই তিনটে চায়ের দোকান। সন্ধার সময় চপ সিঙাড়াও পাওয়া যায়।তারই একটা আধ-ভাঙা বেঞ্চির মধ্যেখানে বসে আছে মুখতারউল্লা, বাম হাতের তালুতে খৈনি দলছে, তার রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উল্টো ফুটে। মুখতারের ডান দিকে বসে সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে সন্দীপ। বাঁ দিকে আন্নুর বসে অস্থির হচ্ছে। সে চায় এখনই কিছু বলুক মুখতার। কিন্তু মুখতারের মুখ থেকে সহজে কিছু বেরোতে চায়না। সে তার স্বভাবজাত কৌশলে খৈনি দলে, বাম হাত থেকে ডান হাত করে, ফু দিয়ে চুনের ধূলো উড়িয়ে দেয়, তারপর পরম যত্নে দু আঙ্গুলে ধরে গালের ডান দিকে পুরে দেয়। একবার বাঁ দিক, একবার ডান দিক ঘুরে, একটা লম্বা শ্বাস নেয়। তারপর বলতে শুরু করে।
আমার আব্বু থাকতো এখনকার ইণ্ডিয়াতে। বিহারের লখীসরাই আমার আব্বুদের জিলা ছিল। আমরা উর্দুভাষি সুন্নি মুসলমান। শুনেছি আব্বুদের টাকা পয়সার অভাব ছিলনা। বোঝেন তো, বিহারী মুসলিমদের ক্যামন দৌলত থাকতো সেকালে। গল্প টল্প তো শুনেছেন।
হুম- মাথা নাড়ে সন্দীপ।
পার্টিশনের সময় দেশ জুড়ে যখন দাঙ্গা লাগল। হঠাৎ করে মানুষগুলো মানুষখেকো জানোয়ার হয়ে উঠলো। দিনে রাতে রক্ত ছাড়া কারুর মন ভালো থাকে না। শুনেছিলাম, লখীসরাইতে আব্বুদের পাশের বাড়ির হিন্দুরাও তখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এত দিনের প্রতিবেশী, এত দিনের আলাপ, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা, সব তখন ভুলে গেছে। তারাও নাকি চাইছিল সব মোল্লা ভেগে যাক লখীসরাই থেকে। আমার আব্বু আর আম্মু এ পারে চলে এল। সব দৌলত ফেলে শুধু জানের দায়ে চলে এল। এপারেও তখন হিন্দুদের তাড়াচ্ছে, খুন করছে, রক্তের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করছে একদল পশু। পরিস্থিতি কিছুটা হাতের মধ্যে যখন এল, আব্বু ঢাকার হাজারিবাগে ট্যানারিতে কাজে ঢুকলো। আমার জন্ম ওই ট্যানারিপট্টিতেই। যাইহোক, অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার ফলে যে সকাল হবে আশা করেছিল সবাই, তা কিন্তু হলো না। ভারত স্বাধীন হলো, কিন্তু সেই স্বাধীনতার দিনটা এপারের বাঙালীদের কাছে জাতীয় শোকের দিন হয়ে গ্যালো।
তারপর? আন্নুর তার নীরবতা ভাঙলো। কৌতূহল চেপে ধরলে যেমনটা হয়।
হুম, বলছি। তারপর পুব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন শুরু হলো। পাকিস্তানি পুলিসের গুলি খেয়ে মরেও গেল ছাত্র যুবকেরা। আমার তখন জ্ঞান পড়েনা, আব্বুর মুখে শুনেছিলাম। আম্মুও বলতো। আম্নু যত দিন বেঁচে ছিল সারাক্ষণ একটা দ্যাশ খুঁজতো, বিশ্বাস করেন, একটা দ্যাশ। মানুষের দ্যাশ না থাকলে যে কী হয়, সে আপনারা বুঝবেন না মিঁঞা।
দেশ- সন্দীপের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল।।
হুম, দ্যাশ। ভাষা আন্দোলন চলছে, বাংলা ভাষার জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছে যুবক ছেলেরা। পাকিস্তানি পুলিস গুলি চালাচ্ছে, পাকিস্তানি উর্দু শাসকেরা আঙ্গুল তুলে গুলি করার আদেশ দিচ্ছে, আর পুব পাকিস্তানের হতভাগ্য বিহারি মুসলিমদের তারা কাজে লাগাচ্ছে। হতভাগ্য সেই প্রাণীগুলোও তখন পাকিস্তানিদের হয়ে কাজ করছে। তারা তো উর্দুভাষি। সেনাবাহিনীর লোকেরা সাহায্য করার জন্য তাদেরকেই বেছে নিচ্ছে, তারাও করছে। মোদ্দা কথা বাঙালি লড়ছে বাঙলা ভাষার জন্য আর উর্দু মোল্লারা পক্ষ নিয়েছে উর্দু শাসকের। আচ্ছা, এতে কি আপনি অন্যায় দেখেন, মিঁঞা?
হঠাৎ দুম করে বুকে যেন শেল পড়লো। একমনে শুনছিল সন্দীপ আর আন্নুর। মুখতারের প্রশ্নটা যেন একটা বল্লমের মতো খোঁচা দিল। সন্দীপ আর আন্নুর দুজনেই বোধ হয় সেই খোঁচাটা খেল। সন্দীপ সিগারেট বের করলো, আন্নুর চাএর অর্ডার দিল।
সন্দীপ মুখ খোলে, “অন্যায় নয়? বাঙালিদের জায়গায় এসে আপনি বাস করবেন, আবার তাদের অত্যাচারীদেরই সাহায্য করবেন?
মুখতারের ঠোঁটের ফাঁকে আলতো হাসি। ” ভালোই বলেছেন, বাঙালিদের জমি, তা মিঁঞা, তাহলে আমাদের জমি কোথায়?”
আন্নুর সপাটে উত্তর দেয় ” আরে মিঁঞা আপনের জমি তো ইণ্ডিয়ার বিহার প্রদেশে, সে তো আপনিই বল্লেন।”
“তাহলে আমাদের জমিতে আমরা থাকতে পারলাম না কেন?” মুখতারের প্রশ্ন।
“সে তো বল্লেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আরে মিঁঞা, সেই জন্যই তো দুপুরে বলছিলাম, ধর্মই যত নষ্টের গোড়া।” আন্নুর একটু উত্তেজিত।
মুখতারের ঠোঁটে আবার হাসি। ” কী যে বলেন মিঁঞা, ধর্মই যদি সব নষ্টের গোড়া, তো এ দেশে এত মুসলমানের মধ্যে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম কীভাবে?”
“সে তো ভাষার ফারাকে” আন্নুরের তড়িৎ জবাব।
“তাহলে মানছেন, ভাষাও অত্যাচারের কারণ হতে পারে?” মুখতারের মুখে আবার হাসি।
“ঠিক তা নয়, কিন্তু… আচ্ছা, তার পর কী হলো বলেন। ” এতক্ষণ পর সন্দীপ মুখ খুল্ল।
মুখতার বোধ হয় একটা লম্বা শ্বাস নেয়। আবার বলতে শুরু করে।
আমার বয়স বাড়ছিল, পুব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন তখন মুক্তি আন্দোলন হয়ে গেছে। মুক্তি যুদ্ধের বছরে আমার বয়স বিশ। বাঙালিদের হাতে দেশ চলে এলো, তখন আমরা যাই কোথায়! বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, আমার আব্বু, আমি কখনো পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যও করিনি আর মুক্তি যুদ্ধেও যাইনি। আমার এক চাচা ছিল আস্ত উন্মাদ। পার্টিশনের দাঙ্গার সময় কোথায় হারিয়ে গেছিল বেচারা ৷আব্বু আম্মু পুব পাকিস্তানে চলে এসেছিল, কিন্তু চাচাকে আনতে পারেনি। আমার আব্বু এ পারে এসে সারাক্ষণ গোঁ মেরে বসে থাকতো। সারাক্ষণ ‘ভাইজান ভাইজান’ করতো। রাতের অন্ধকারে আমাদের ট্যানারিপট্টির পিছনের সড়কে গিয়ে বসে থাকতো। প্রায় অর্ধেক পাগল বলতে যেমন হয়, তেমন। সেই লোক কি আর পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করবে? আর বাকি রইলাম আমি। চির রুগী আম্মুকে নিয়ে পড়ে থাকতাম ঝুপড়িতে। মাঝে কধ্যে আব্বুর জায়গায় কাজে যেতাম। এই ছিল আমাদের হালচাল।কিন্তু পালে পড়লে যা হয়, বাঙালিদের হাতে যখন স্বাধীন বাংলাদেশ চলে এলো, তখন উর্দু মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলতে লাগলো। আমরাও বাদ পড়লাম না। বিস্তর লোক খুন অব্দি হয়ে গেল। আমাদের হাজারিবাগ ট্যানারিপট্টিতে এক দিন ঘোরতর হামলা হলো। যে যেদিকে পারলো, প্রাণের দায়ে দৌড়ালো। তখন কে আপন, কে পর চেনার সময় নেই। বিহারি মুসলমানদের পালানোর ইতিহাস আছে। আমার আব্বু আর আম্মুকে নিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম মসজিদে। থরথর করে তখন কাঁপছি আমি। আব্বু আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল ” চিন্তা করিস না, মুখতার। আমরা আগেও তো পালিয়ে বেঁচেছি, আমি আর তোর আম্মু। আবার বেঁচে যাবো।” আম্মুর চোখে জল দেখেছিলাম।
মুখতার থামে। দম নেয়। বেশ কিছুক্ষণ সন্দীপ আর আন্নুরও চুপ থাকে। যেন চুপ থাকাটাই এখন নিয়ম। যেন একটা বিষাদময় অন্ধকার চারদিকে। সন্দীপ সিগারেট ধরায়। বন্ধ মুখের আগল খুলে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলে,” তারপর?”
একটা বিষাদ সিন্ধু উথলে উঠে আপাত মিতভাষী মুখতারের মুখমণ্ডলে। অন্ধকারেও সে মুখের জ্যামিতিক বলিরেখায় স্পষ্ট ধরা পড়ে পালানোর গল্প, পালাতে থাকার গল্প, দৌড়ানোর গল্প।
“বলছিলাম না মিঁঞা, ধর্ম ছাড়াও অনেক কিছু আছে, মানুষকে রক্তপিপাসু করে দেয়।” মুখতার দার্শনিক হয়ে ওঠে।
নইলে মুসলমানের উপর মুসলমান খুনখারাবি করে? সবই নসিব। এই যে দেখেন না, আমি মানুষ, কিন্তু আমার দ্যাশ নেই। একাত্তরের পর বিহারি মুসলনানদের জন্য রেড ক্রস কতগুলি রিফিউজি ক্যাম্প বানিয়ে দিয়েছিল। তারাই খরচপত্র দিয়ে কোনোরকমে জানে বাঁচিয়ে রেখেছিল আমাদের। সৈয়দপুরের সেই জেনেভা ক্যাম্পেই এই আমি এখনো রিফিউজি। অনেকে আবার নাম দিয়েছে ‘স্ট্র্যাণ্ডেড পাকিস্তানি’।
ক্যাম্পের বালবাচ্চাদের টুকটাক যা অক্ষর জ্ঞান তা ওই রেড ক্রসের দয়ায়। অনেকে ক্যামেরা নিয়ে মাঝে মধ্যে আসে। ছবি তোলে, গল্প, সিনেমা বানায়। এই যা!
আর আব্বু, আম্মু? সন্দীপ বলে।
আম্মুর তো মুক্তি যুদ্ধের বছর দুয়েকের মাথায় ইন্তেকাল হয়েছিল। আর আব্বু! সে আর কী বলবো মিঁঞা! বুড়ো বয়সে পাগলামি বেড়ে গেলে যা হয়! আমরা তো নাগরিক নই, তাই আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার ছাড়পত্রও নেই। আব্বু বুড়ো বয়সে ‘ভাইজান ভাইজান’ করে বদ্ধ পাগল হয়ে গেছিল। একদিন কাউকে কিছু না বলে বুড়ো লুকিয়ে কীকরে যেন ইণ্ডিয়াতে চলে গেছিল। জানেন তো, বর্ডার পার করার জন্য কত দালাল আছে। কড়ি ফেল্লে ব্যবস্থা করে দেয়।
“হুম” আন্নুর এক মত হয়।
অন্ধকারে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মুখতার বলে ” আব্বু চলে যাওয়ার বছর খানেক পর এক দালাল খবর দিয়েছিল, আব্বুকে নাকি ইণ্ডিয়া সরকার ধরে জেলে পুরে দিয়েছে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। তারপর আর বুড়োর ফিরে আসার আশা করিনি, ছেড়ে দিয়েছি। কী বলবেন বলেন মিঁঞা! এ পার, ও পার কোনোটাই আমার আব্বুর দ্যাশ নয়। বলছিলাম না মিঁঞা, মানুষের ক্ষ্যাপা সিংহ হওয়ার জন্য ধর্ম ছাড়াও অনেক কিছু আছে। মোদ্দা কথা, মানুষ ঠিক একটা নয় একটা কারণ খুঁজে নেয় রক্ত দেখার জন্য, কষ্ট দেওয়ার জন্য, দ্যাশহীন করে দেওয়ার জন্য।”
মুখতার খৈনি বের করে। ফিক করে একবার হেসে ওঠে। বলে, “কী মিঁঞা, মন খারাপ হয়ে গেল?” সন্দীপ, আন্নুর দুজনেই নিরুত্তর থাকে।
কথায় কথায় রাত ক্রমশ বেড়েছে। দোকানপাট বন্ধ হচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা। সন্দীপের সহসা মনে হলো শেখ মুজিবের বাড়ি হতে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। একটা নির্মমতা আর হিংসার পোড়া গন্ধে ভেসে যাচ্ছে গোটা ধানমণ্ডি।
লেখা পাঠাতে পারেন