পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র ২১তম পর্ব।
ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী–র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-২২)
“জীবনটাও এই কাপড় আর সেলাই মেশিনের মতোই! বুঝলে হে দেবু বাবু… এই যেমন আমি নানা মাপের কাপড় জুড়ে একটা মাপসই জামা করে ফেলছি, জীবনটাও তাইই …”মাস্টার পা দিয়ে মেশিন চালাতে চালাতে , হাতে কাপড়ে সেলাই ফেলতে ফেলতে দেবুর উদ্দশ্যে বলে।
সিগারেটে অনেকক্ষন টান না দেওয়ায় লম্বা হয়ে ছাই জমে উঠেছে, চায়ের গ্লাসে সর পড়ে গেছে। দেবু একটু অন্যমনস্ক থেকেই চায়ের গ্লাসে চুমুক দেয়, খুব গরম নেই তবু খাওয়ার মতোই। আজ কাজের চাপ কম, তাই একফাঁকে পিনুদার পুরোনো বাইকটা নিয়ে একবার মনে হলো মাস্টারের দোকানে ঘুরে আসি! অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, আড্ডা হয়নি। মন মেজাজও একটু বিগড়ে আছে কদিন। বাড়িতে বাবার সাথে প্রায় কথা বন্ধ! বাড়ি ঢুকলেই একটা কেমন থমথমে পরিবেশ। মণি আর মা পড়েছে মাঝখানে, জোর করে বাবার অমতে গিয়ে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া বাবা একেবারেই নিতে পারেনি। এসব নিয়েই মাস্টারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মাস্টার মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছে বারেবারে।
গত দু সপ্তাহে সব মিলিয়ে দিন চারেক কলেজে গেছে দেবু , একটা দুটো ক্লাস করেছে। টিডির কোচিং ক্লাসেও দু দিন যেতে পেরেছে। নন্দিতার সঙ্গে সেই শেষ দেখা হয়েছে , তারপর আর দেখা হয়নি। কি যে করছে মেয়েটা কে জানে! হয়তো নন্দিতা কলেজে এসেছে ঠিকই, দেবুই কলেজ যায়নি তাই দেখা হয়নি!
কাজে ঢোকার কদিন পর থেকেই কলেজে গেলে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে দেবুর! যেন এতদিনের চেনা কলেজটা অচেনা অচেনা ঠেকছে। ক্যান্টিনে গিয়ে আড্ডা দেওয়ারও সেভাবে উৎসাহ পাচ্ছে না।
কাজের জায়গা, ছাকনির আওয়াজ, দামোদরের বালির মধ্যে পা বসে যাওয়া, হাজার হাজার টাকা গোনার মধ্যে একটা নেশা খুঁজে পাচ্ছে যেন! আরও বেশি করে মনে হচ্ছে সেই পুরোনো কথাটা, টাকা উড়ছে , শুধু ধরতে জানতে হবে!
“মাস্টার , খোকনদার কি খবর জানো?”
“না হে… একবার মাঝে ইন্দাস যাওয়ার কথা বলেছিলো বটে! কিন্তু …”
“দিন সাতেক আগে একবার আমাদের সদরঘাট অফিসে এসেছিলো, বেশ আড্ডা হলো আমাদের, তারপর আর দেখা হয়নি…”
“আছে , এখানেই কিংবা ইন্দাসে, অবশ্য ইন্দাস গেলে খুব জোর দেড়দিন থাকে খোকন, তারপর পালিয়ে আসে… বউ ঠেলে পাঠিয়ে দেয় মনে হয়…হাহাহা”
দেবুও হেসে ফেলে মাস্টারের কথা শুনে, মাস্টারের এই এক গুন, এখানে কিছুক্ষন থাকলে মুড ভালো হবেই। মাস্টার ঠিক হাল্কা করে দেবে জমে থাকা মেঘ।
আরও কিছুক্ষণ নানা গল্প করে দেবু উঠে দাঁড়ায়। একবার কাঠগোলা অফিসেও ঘুরে যেতে হবে, সে টরকমই নির্দেশ আছে গদাইবাবুর। এখনও সরাসরি নির্দেশ দেবুর কাছে আসে না, পিনুদার মাধ্যমে দেবু জানে কি করতে হবে কখন। সে রকমই একটা নির্দেশ, কাঠগোলা ঘাটের অফিসে যাওয়ার।
“আজ উঠি মাস্টার… একটু যেতে হবে আর এক জায়গায়”
“ চললে! বেশ… আবার একদিন এসো, জমিয়ে আড্ডা হবে। আর মাথা ঠান্ডা রেখো ভাই…” মাস্টার উঠে এসে দেবুর কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। দেবু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বাইকে চাই লাগায়। তেলিপুকুর মোড় এখন এসময় ফাঁকাই, মাঝে মধ্যে দু একটা বাস, ছোটো ট্রাক পেরিয়ে যাচ্ছে তীব্র হর্ণ বাজিয়ে। আজ রবিবার বলেই বোধহয় এরকম হাল্কা ভিড় রাস্তাঘাটে! বর্ধমানে আবার রবিবারেই বেশিরভাগ বড় দোকানপাট বন্ধ থাকে। দেবু বাইকে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যায় সদরঘাট ব্রিজের দিকে। ব্রিজে ওঠা আগে ডান দিকে বাঁধের রাস্তা ধরে নেবে, এটাই সহজ রাস্তা কাঠগলায় যাওয়ার এখান থেকে।
ব্রিজে ওঠার আগে ডানদিকে ভাঙতেই উঁচুনিচু রাস্তা শুরু হয়ে গেল। রাস্তাটা চিনলেও এ রাস্তায় খুব বেশি যাতায়াত করেনি দেবু। কোথাও বাঁফহানো কোথাও ভেঙে গেছে রাস্তা, বাঁ?য়ে দামোদর শুয়ে আছে অনন্ত কাল ধরে, তার পাড়ে হোগলার জঙ্গল, আগাছার মাঝে কেউ কেউ সব্জির চাষও করেছে চরের জমিতে। বাঁধের ডান দিকে প্রচুর বাড়িঘর রয়েছে , কয়েকটা তো বেশ বড় বড়! দেবু সাবধানে ধীর গতিতে বাইক নিয়ে এগোতে থাকে। কিছুটা ফাঁকা থাকার পর আবার গাছপালা ঘন হয়ে এসেছে বাঁধের দুধারেই। বাচ্চা ছেলে পিলে খেলে বেরাচ্ছে বাঁধের উপর , ডান দিকের ঢালে চালা ঘরের বস্তি থেকে রান্নার গন্ধ ভেসে আসা টের পায় দেবু। এখানে দিব্যি একটা লোকালয় গড়ে উঠেছে! কোথা থেকে এত লোক যে বর্ধমানে আসছে কে জানে! এদের অনেকেই আশেপাশের গ্রামের বা দূর দুরান্তের ছিন্নমুল মানুষ। দূর থেকে মন্দিরটা দেখে দেবু বুঝতে পারে ও ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘাট অফিসে এখন গদাইস্যারের খাস বুধুয়াই থাকবে মনে হয়! দেবু ঢাল বেয়ে বাঁ দিয়ে চরে নেমে যায় , বালির রাস্তা না গিয়ে শক্ত মাটির রাস্তা ধরে অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইক রেখে অফিসে ঢুকে দেখে অফিস ফাঁকা! একটা এঁটো থালা নামো বাইরে, এক গোছা ধুপ গোঁজা আছে অফিসের ভিতরে রাখা হনুমানজির ছবির সামনে , জ্বলে জ্বলে প্রায় কাঠিতে ঠেকে গেছে। অফিসের ভেতরে ধুপের গন্ধে ম ম করছে । কিন্তু বুধুয়া গেল কোথায়!
টেবিলে রাখা এন্ট্রির খাতাটা নজরে পড়ে দেবুর। একবার মনে হয় দেখে খাতাটা, আবার ভাবে বুধুয়ার সামনে দেখলেই ভালো হয়, বুধুয়া সেভাবে ওকে চেনে না তাই ওর অনউপস্থিতিতে খাতা ঘাঁটা ঠিক হবে না। জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেই দূরে একটা লোককে হাতে একটা প্লাস্টিকের মগ নিয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে আসতে দেখে দেবু। দুপুরের রোদে দূরে দামোদরে জল আর রোদে ঝলসে ওঠা বালির চরের মাঝে ওই লোকটাকেই শুধু দেখা যাচ্ছে, আর কেউ নেই।
লোকটা অফিসের দিকেই আসছে, এই বুধুয়া তাহলে! মঝারি গড়ন, গায়ের রঙ কালো, কর্মঠ গিঁট পড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে লোকটা এসে একটু থমকে যায় দেবুকে দেখে। কিছুক্ষন আপাদমস্তক দেবুকে দেখে হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করে ইসারায় ও এখানে কি করছে। বুধুয়ার মুখে দাঁতনটা এক্তক্ষন চোখে পড়েনি দেবুর।
“আমায় গদাই স্যার আসতে বলেছে , আমি দেবু …”
এবার বুধুয়ার কুঁচকে থাকা ভুরু সোজা হয় , মুখের দাঁতনটা ফেলে হাসি ফুটে ওঠে।
“আরে! তুমিই দেবু… হামার মনে হচ্চিল… লেকিন…আচ্ছা আচ্ছা…”
“হ্যাঁ আমি এই প্রথম এ ঘাটে এলাম তো ! এসে দেখি ফাঁকা অফিস…”
“আরে ভাই… খাওয়ার পরে বহুত জোর সে লাগ গায়া… তাই…”
দেবু হাল্কা হাসে বুধুয়ার বলার ভঙ্গীতে, অফিসের ভিতরে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসে আয়েস করে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ জমে ওঠে বুধুয়ার সঙ্গে দেবুর। কথ বলে বেশ সাদা সরল ভালোমানুষ বলেই মনে হলো। গদাই ঘোষকে ভগবান জ্ঞান করে সেটাও বোঝাই যাচ্ছে তার কথা শুনে। এখানেই বাঁধের ওপাড়ে ডেরা বুধুয়ার, একাই থাকে, বউ বাচ্চা দেশের বাড়ি ছাপরায়।
খাতাটা টেনে নিয়ে এন্ট্রি দেখতে থাকে দেবু, আজ সারাদিনে এখনো পর্যন্ত একটাই এন্ট্রি খাতায়।
“ব্যাস এই লোডিং আজকের?” বুধুয়াকে জিজ্ঞের করতে বুধুয়া হাসে নিঃশব্দে, আর একটা খাতা টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনে।
“উটা হাতিকা দাঁত দেবু ভাই… এটা আসলি খাতা… চারটে ফিলিং বালি, একটা ছাকনি”
লেখা পাঠাতে পারেন
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুনঃ