গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান”(শেষ পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-শেষপর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(শেষ পর্ব)

সে ও তারা
“There,” she said softly. “Now he could be sleeping.” –
J.K.Rowling, (Harry Potter and the Deathly Hallows)
” এখানে এমন একজন শুয়ে আছে যে এক যুগ আগে বিশ্ব জয়ে গেছে” – এই কথা গুলো লেখা আছে ইঁট বালি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি একটা বেদীর গায়ে। আর সেই বেদীর কাছে দিন রাত এক ক’রে বসে থাকে এক উন্মাদিনী। আপনি লুৎফাউন্নেসার কথা ভাবছেন। সিরাজের সমাধিস্থলে পায়ের কাছে বসে আছে ১৭ বছর। কিন্তু এই উন্মাদিনীর কথা কোনো ইতিহাসে লেখা নেই, এসব থাকেও না। লাভও নেই। উন্মাদ ঠিক মানুষ নয়। তার বাড়ি নেই, কিংবা বাড়ি তার জন্য নয়, সে খাবার জমিয়ে রাখে না দুঃসময়ের জন্য, সে সবার সংগে কাঁদে না, হাসে না, সে থোড়াই পরোয়া করে জগৎ সংসারকে। তার বয়স থেমে যায় হিমালয়ের মতো। তার চুল, নখ বেড়ে যায় অবলীলায়, আদিম বন্যতার ভিতর তার সহজ যাতায়াত। আসলে আমার মনে হয় প্রত্যেক উন্মাদ কোনো দীর্ঘ প্রতীক্ষারত মানুষের নাম। তাকে কেউ কবে বলেছিল,
“তুই অউঠি দাঁড়া, আমি আইসিটি।”
সে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার বয়স, কাল, ইতিহাস, ভূগোল এবং জাগতিক সমস্ত পারিপার্শ্বিক ঠায় দাঁড়িয়ে যায়। হয়তো অপেক্ষা করতে বলা লোকটা এক বা দু’যুগ পরে ফিরে এলো, কিন্তু সে সেই প্রতীক্ষারত উন্মাদকে আর এসে চিনতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। কেউই চায় না ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে ঘুরে কোনো এক বসন্তের আদিম সন্ধ্যায় চলে যেতে। এই উন্মাদিনীর ক্ষেত্রে সেই ভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য কিছুই হয়নি। সেই ভালো। বলা যায় না, এক যুগ পর ফিরে এসে আধুনিকতা বন্যতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও পারতো। কে চায় ফের গাছের ডাল ভেঙে শিকারের পিছন পিছন দৌড়াতে!
  এখন দ্বীপে ফেরা মানে দুটো জায়গা আমার ধরা বাঁধা, যেখানে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। চন্দ্রানীর ঘাটে এই বেদীটার কাছে। অবশ্য বেদীর নীচে শুয়ে থাকা ঘাস পাথর মাটিরাও নির্জনতা কী জিনিস জানে না। দিন রাত দুটো উন্মাদ বসে থাকে। এক জন সারাক্ষণই থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠে ” ঝন্টু আসসে রে মাধবী, চলিয়ায় চলিয়ায়, কাঠগা নামিদে, কাই গেলুরে অলাউঠা হতচ্ছাড়ি!” আর একজন নির্মোহ চাউনি নিয়ে বসে থাকে, তার মুখে রা টিও নেই। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকায় আর বেদীর গায়ে হাত বোলায়। মাঝে মধ্যে দু’একখানা নৌকা এখানে আসে, উন্মাদ দুটোকে দেখে, একটু হাসাহাসি করে, ঠাট্টা করে, নিজেদের কাজ শেষ করে আবার চলে যায়। গাঙের তরঙ্গ আছে, এ কথা কে না জানে, কিন্তু খুব কম মানুষ এ কথা জানে যে গাঙ পাড়ের সব কিছু নিস্তরঙ্গ, বৈচিত্রহীন। মাঝে মধ্যে তার তাল কাটে যে মরশুমে কোনো নৌকা ডুবি হয় না, কেউ হারিয়ে যায় না, কোনো পচা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ ভেসে আসে না। মনি জ্যাঠার পাগলামো এখানে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সে সকাল সকাল এসে বসে থাকে কৃষ্ণচূড়ায় হেলান দিয়ে, কাউকে দেখলেই ঝন্টুদার কথা জিজ্ঞেস করে, কেউ কোনো উত্তর দেয় না, খাবার সময় কোনো দিন পুটা, কোনো দিন চঞ্চলী বৌদি, কোনো দিন বা শ্রীকান্তদা এসে তাকে টেনে নিয়ে যায়। মনি জ্যাঠা গালাগাল দেয়, অভিশাপ দেয়, ফলে না।
  আর একটা জায়গা, শ্মশান ঘাট আমার খুব প্রিয়। আমি সারা বিকেল, সন্ধ্যা, রাত অব্দি সেখানে বসে থাকি, বিড়ি খাই আর এলোমেলো সুরে গান গাইতে থাকি। এখানেই এক কোনে বহুকাল আগে এই দ্বীপে পা রাখা এক কিশোরী,যে এখানে এসে সংসার পেতেছিল, স্রোতে ভাসতে ভাসতে ৩১ বছর কাটিয়েছিল এই দ্বীপে, শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে। দুর্গা নামে সেই কিশোরীর বুকে ছিল আর এক সমুদ্র, সেই সমুদ্রের ঢেউ দু’টো দ্বীপ বেঁধেছিল তার বুকে, জানি না কোথা থেকে কীভাবে রসদ ব’য়ে এনে সে পুষ্ট করেছিল সেই দুটো দ্বীপকে। সে অন্য কথা। আর একটা উপাখ্যান। সে উপাখ্যানের শেষ পাতায় লেখা আছে  ” ইতিহাস আর উপন্যাসের ভেতরের ফাঁকটুকু যে পূরণ করেছিল”।
  চন্দ্রানীর ঘাটের বেদীটা আমরাই তৈরি করেছিলাম। আমি, নুনা, দাদা, শ্রীকান্ত দা চঞ্চলী বৌদি আর মন্টু সাউ মিলে। এক যুগ পর যখন সে ফিরে এলো না, যখন সম্রাট ইউলিসিস হয়তো কোনো এক লোটোস ল্যাণ্ডের দুর্নিবার আকর্ষণে সেখানেই থেকে গেল,  তার অক্ষম প্রজারা এই বেদীটা তৈরি করল। এই প্রথম মহল্লার কোনো মানুষ হারিয়ে যাবার এক যুগ পর তার শ্রাদ্ধ হলো না। আমরাই দিলাম না করতে।  আমরা তাকে মৃত বলে মানিনি, মানি না ও। আমাদের দলটা তখন মহল্লার শক্তসমর্থ যুবকের দল, মোড়লদের অমান্যি করার হিম্মত আমরা দেখালুম। মহল্লা একজোট ক’রে আমরা নিদান দিলুম ” যে অর ছ্রাদ্দ করতে আইসবে, সে বাঁচিয়া ঘুরিয়া যাবেনি।” মোড়লরা পিছু হটেছিল। চন্দ্রানীর ঘাটে আমরা একদিন শৈশবে ফিরে গেলুম। মহল্লার অন্তত জনা বিশেক বাচ্চা কাচ্চা মহিলাকে নিয়ে আমরা ছোটবেলার ফিস্টি ফিস্টি খেলা খেল্লুম সেদিন। বাঁধের উপর উনুন খোঁড়া হলো, আমরা ঘর থেকে বাসনপত্র আনলুম ব’য়ে। শুকনো কাঠ আনলুম জংগল থেকে ভেঙে। শংকর ঘড়ুইর চরপাটা থেকে কেঁদে মাগুর আনলুম। এই কেঁদে মাগুর আমাদের মহারাজের ভীষণ প্রিয় ছিল কিনা! ডুবে ডুবে খাস খাল থেকে হাঁচা করে চ্যাং মাছ ধরা হলো। আমি আর দাদা মিলে রান্না করলুম। চঞ্চলী বৌদি সারাদিন কেঁদে কেটে একশা করছিল। আমার মা দূর থেকে আমাদের দেখছিল। খুদি পাত্রের দোকানের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েছিল মা। আমি দৌড়ে মা’র কাছে গেলুম।
ম্বা আ আ –
আইজ শম্ভুর বার সাল হয়াল, না?
হঁ
অলাউঠামনে ছ্রাদ্দের জন্যে মুখিয়া থাইল।
হুঁ ম্বা।
ঠিক হইছে। তোন্নে ঠিক কচ্চু।
ফোঁটা কয়েক জল পড়ে গেল মার চোখ দিয়ে। আঁচলের খুঁট দিয়ে জল মুছতে মুছতে বল্লে –
গৌরি কাই?
অউঠি।
অলাউঠা বাপ মা টা মারিয়া মারিয়া অকে পাগলি করিয়া দিল’। অখঁ আর খুঁজ্ খবরও ল্যায়নি।
হঁ।
তোর গংগা প্যাশাটা ঠাকুর থানের ধারে বুসিয়াছে।
অহ।
জাউঁ তো, তখঁ তোন্নে খুব ছোট, ঝড়ে ঘর ভাঙিয়া পড়িতল। অউ গংগা ঘড়ুই ছুটাছুটি করিয়া একলা একটা কুঁড়িয়া বাঁধিয়া দিতল’।
আমার মনে আছে গো ম্বা।
আবার কাঁদতে লাগল মা। আমি চোখ মুছে দিয়ে বল্লুম ” ঘর যাও ম্বা”।
এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মা চলে গেল।
মন্টু সাউ রাজমিস্ত্রী নিয়ে হাজির হলো। আমরা চাঁদা তুলে সব মালপাট কিনেছি। চঞ্চলী বৌদির ঘরের কাছেই চন্দ্রানীর ঘাটে মুহুর্তে একটা বেদী তৈরি হয়ে গেল। আর সেই বেদীর উপর বালি সিমেন্টের মশলা দিয়ে লেখা হলো ” এখানে এমন একজন শুয়ে আছে যে এক যুগ আগে বিশ্ব জয়ে গেছে”।
একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় সুন্দর করে আমরা সাজিয়ে দিলুম ভাত, কেঁদে মাগুরের ঝাল, চ্যাং মাছের লংকা বাটা দিয়ে ভাজা আর একটা জ্বলন্ত বিড়ি। তারপর আমি দাদা আর নুনা জলে নেমে সেটা ভাসিয়ে দিলুম গাঙে। একটা গাঙ শালিখ উড়ে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে। বসন্তের শান্ত জলে ভাসতে ভাসতে থালাটা জংগলের আড়ালে চলে গেল। যে যার মতো করে কৃষ্ণচূড়া ফুল দিয়ে কাঁচা বেদীটা ফুলে ফুলে লাল করে দিলাম।
°
অপুউউউ নাকি রেএএ
কে গোওওওওও
সন্ধ্যার অন্ধকারে ঠাওর করলুম মন্টু সাউ। নৌকা গাছে বেঁধে উঠে আসে আমার কাছে। বেদীটার কাছে এসে বসে পড়ে। বিড়ি ধরায়, আমাকেও দেয়।
কবি আসসু?
আইজ বিকায়ে।
অহ।
ভালো আছু কচি?
হঁ, তুমি?
কী লুবু ক’অত? বয়স হয়া যাআটে।
অনেক দিন পর আইলু, না?
হঁ।
চঞ্চলী শীকান্ত এঠিনু উঠিছে। সে রিং বাঁধের কাছে ভালো করিয়া ঘর বাঁদচে।
অহ, কদ্দিন হইল?
হঁ আধাসাল হইল।
অহ, অনেক দিন আইসিনি আমি।
তোর মা মরিয়া যাবার পরনু তুই একদম আসা কমি দিচু।
কিছুই বল্লাম না, চুপ করে থাকলাম।
কীরে কচি?
নাহ্, ভাবিটি৷ কত কী যে দেখলি জীবনে!
হুম। মনি মুণ্ডঁ মরিচে জাউঁ তো?
একটা তড়িৎপ্রবাহ ছুটে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে,
মনি জ্যাঠা মরিচে?
হঁ, শীকান্ত চঞ্চলী সব কাজ করচে।
অহ, আর বা তার কে থাইল!  আমি স্বগতোক্তি করলাম।
হঠাৎ প্রশ্ন করলাম –
গৌরি অখঁ কাই জ্যাঠা?
সে সের্কম আছে, গংগা ঘড়ুই তাকে ধরিয়া লিজায়, খাবায়।
অহ, আচ্ছা, গংগা ঘড়ুইর চলেটে কী করিয়া জ্যাঠা?
একটা দেব শিশুর মতো এক চিলতে হাসি বেরিয়ে আসে মন্টু সাউর গলা থেকে।
আমি দেই, আর কী করবো ক’ বাওয়া?
জ্যাঠা।
হঁ।
আমি কিছু দিয়াবো কাল যাবার সময়।
কাল চলিয়াবু?
হঁ।
অহ,
মন্টু সাউ যেন নিরাশ হলো।
আমি উঠে পড়লুম। বল্লুম
চলো, লৌকা লিয়া একটু ঘুরি।
যাবু?
হুঁ।
মাঝ গাঙে যখন আল্লাদির উপর চড়ে ভাসছিলাম, পুরো দ্বীপটাকে একটা রহস্যেমোড়া আরব্যরজনীর কল্পিত গুহা মনে হচ্ছিল। আমি সেই গুহার দিকে তাকিয়ে থরেবিথরে সাজানো পাথর গুলোর মধ্যে প্রাণ খুঁজছিলাম। মন্টু সাউ গলা ছেড়ে গাইছিল
“ওওওওও দয়াল রেএএএএ/ আমায় ভাসাও তুমি,  ডুবাও তুমি/ অকুল দরিয়ায় যেএএ।”
(সমাপ্ত)
লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুনঃ

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস– “হেঁতালপারের উপাখ্যান”(২১তম পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *