ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-১৪)
বার দুয়েক পুরো রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল পিনু। গদাই ঘোষের ভ্রু কুঞ্চন বেড়ে গেছে বেশ কিছুটা ততোক্ষনে , এরকম সচরাচর হয় না! একটা সিস্টেম কাজ করে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। নিতান্তই যদি কিছু এদিক ওদিক হয় তবে আগেই খবর হয়। অনেক সময় মিডিয়ার চাপে বা ইলেকশনের আগে প্রশাসনের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করার জন্য কিছু কড়াকড়ির ভান করতেই হয়! আবার ঠান্ডা হয়ে যায় কিছুদিন পর। মিডিয়াও তখন অন্য কোনো ইস্যু খুঁজে নেয়। এভাবেই চলে সমান্তরাল ব্যবস্থা। কিন্তু এরকম তো বিশেষ হয় না!
“এতক্ষণ লাগাল কেন ফোন ধরতে! কাজের সময় আড্ডা দিচ্ছিলে নাকি?” গলায় ঝাঁজ বেশ ভালই গদাই ঘোষের টের পায় পিনু।
“না স্যার অফিসের বাইরেই ছিলাম… চার নম্বর জেসিবিটার গিয়ার অয়েল লিক করছে, কাজ করাচ্ছিলাম স্যার…“
“ও… যাই হোক খবর কিছু পেয়েছো?”
“হ্যাঁ স্যার, মণিরুল ফোন করেছিলো, গাড়ি আটকেছে। কিছু বুঝতে পারছি না স্যার, আমি এম ভিতে ফোন লাগিয়ে ছিলাম। ওরা গোল গোল কথা বলছে স্যার যা বুঝলাম। জানেনই তো সালারা জাত হারামি!”
“এক্ষুনি দেখো ব্যাপারটা। আমার গাড়ি আটকেছে! ব্যাপারটা কি জানা দরকার… শুনলাম কে এক নতুন অফিসার এসেছে…”
“হ্যাঁ স্যার… আচমকাই পোস্টিং দিয়েছে, সেটিং করার সুযোগই পাইনি… প্রথম প্রথম একটু গরম খাচ্ছে মনে হচ্ছে, জানেনই তো এদের স্টাইল!”
“বেশ শোনো… ব্যাপারটা বাড়ে না যেন। গাড়ি রাতেই বের করতে হবে না হলে প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে যাবে পার্টির কাছে!”
“দেখছি স্যার… আমি এখুনি বেরোচ্ছি “
“হুম…” ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে গদাই ঘোষ। এরকম দিন যে একেবারেই আসেনা তা নয় তবে যেভাবেই হোক বেরিয়ে আসা গদাই ঘোষের হাতযশ। এ লাইনে গাড়ি ধরা, লোকাল ঝামেলা, উঠতি মস্তান সামলানো এসব লেগেই আছে। যেখানে যে ওষুধে কাজ হবে সেখানে প্রয়োজন মতো সেই ওষুধ দিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়। লোকালি মিটে গেলে ভালো টাকাপয়সা দিয়ে, না হলে ওপর লেভেল থেকে ফোন করাতে হয়। কিন্তু কে এই নতুন অফিসার! এই নতুন অফিসারের কথা শুনে অনেক পুরানো একজনের কথা মনে পড়ে গেল গদাই ঘোষের। সে ছিলো এক দুঁদে একরোখা অফিসার, অরিন্দম বোস, কিছুদিন খুব জ্বালিয়েছিলো, গাড়ী গলসি পেরোনোর উপায় ছিলো না। কোনো কিছু দিয়েই থাকে বাগে আনা যাচ্ছিল না! না টাকা পয়সা, না মদ ,মেয়েছেলে কোনো নেশাই ছিলো না যে তার! এরকম লোক পাওয়া মুশকিল। কালে ভদ্রে প্রশাসনে এরকম দু একজন চলে আসে, যাদের সৎ ভাবে নিজের ডিউটি টুকু করার ভুত থাকে মাথায়। অরিন্দম বোসও সেরকমই একজন অফিসার ছিলো, খুব নাজেহাল করেছে কিছুদিন। শেষে অনেক কসরত করে ওপর মহল থেকে তার ট্রান্সফার করিয়ে তবে শান্তি। অসুবিধা যে অনেকেরই হচ্ছিল! ভাগ বাটওয়ারার যে সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে ওপর থেকে নিচ অবধি তাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তো সবারই অসুবিধা! তাই আর বেশিদিন এখানে টিকতে পারেনি অরিন্দম বোস, ট্রান্সফার হয়ে চলে যায় পুরুলিয়ায়।
বেলা পড়ে আসছে । রমেশ এসে চায়ের কাপটা নামাতেই গদাই ঘোষের চিন্তার তারটা ছিন্ন হয়। অন্যদিন চা সনাতনই আনে, সনাতন নেই তাই আজ রমেশই এনেছে চা। চায়ে চুমুক দিয়ে সামনে রাখা এন্ট্রির খাতা উল্টাতে থাকে গদাই ঘোষ। দুটো গাড়ি লোড হয়েছে আজ। একটা লোকাল আড়তে আর একটা চব্বিশ পরগনা গেছে। লেভির এক ট্রলি আলাদা রেডি করতে বলা আছে। লেভির চাল আলাদা যায় এফ সি আই গোডাউনে।
চা খেয়ে অফিসের বাইরে এসে পায়চারি করতে থাকে গদাই ঘোষ। দারোয়ান বজরঙ্গের আস্তানার দিক থেকে কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে। বজরং এর দেশ থেকে কোনো আত্মীয় এসেছে সম্ভবত।মাঝে মধ্যে আসে, ওদের এই ব্যাপারটা বেশ ভালো। বিদেশ বিভুঁইয়ে এলে আত্মীয় স্বজন একবার আসবেই। এইভাবে অনেকে একজনের সুত্র ধরে নানা কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে কিছুদিন থাকার পরেই! বসে থাকার লোক কেউ নয়, প্রচন্ড পরিশ্রম করতে পারে তাই কাজের অভাব হয় না। একটু বুদ্ধি ধরে যারা তারা অল্প দিনেই উন্নতি করে, কেউ কেউ নিজের ভ্যান কিনে ফেলে বা ছোটো খাটো ব্যবসা। একে তাকে ধরে একটা ঝুপড়ি দোকান। দেখতে দেখতে বর্ধমান শহর এমনকি শহর ছাড়িয়েও বিহার থেকে আসা এবং এখানে থেকে যাওয়া মানুষজনের সংখ্যা প্রচুর পরিমানে বেড়েছে গত বিশ বছরে। পাল্লা দিয়ে দাপটও বাড়ছে তাদের! তবে সচরাচর দু একজন ছাড়া এদের অকারণে মাথাচাড়া দিতে দেখা যায় না। মুলত স্টেশন এলাকা, রেলপাড়, মিলের আসেপাশেই এদের সংখ্যা বেশি।
বজরং গেটের কব্জাগুলোয় তেল দিচ্ছিল। লোক বেশ চৌখস, কাজের বেলায় খুব একটা অভিযোগের সুযোগ দেয় না সে। “বজরং…” গদাই ঘোষ হাঁক পাড়তেই, চমকে উঠে হাত মুছতে মুছতে এসে হাজির হয় বজরং।
“হ্যাঁ বাবু !…”
“বলছি কে এসেছে তোমার ডেরায়? নতুন গলা পাচ্ছি !”
“আরে বাবু ও আমার চাচাতো ভাই আছে…বালিয়া থেকে এসেছে… লিলুয়া শেডে কাজে ঢুকেছে নতুন…”
“ও… তা তোমার পরিবার সব ভালো আছে তো?”
“হ্যাঁ বাবু… সব ঠিক আছে…” এক গাল হেসে জবাব দেয় বজরং। মিলের আর এক বাসিন্দা সনাতনের ‘কালুয়া’ দূর থেকে গদাই ঘোষের গন্ধ পেয়েই চেঁচাতে লেগেছে। মনিবকে এরা ভালোই চেনে। এবার একবার কাছে গিয়ে মাথায় হাত না বোলালে শান্তি নেই! কাছে যেতেই গদাই ঘোষের গোটা গা শুঁকতে থাকে কালুয়া কেন কে জানে! সম্ভবত ঝিমলির গন্ধ পায়। এদের ঘ্রানশক্তি প্রচন্ড। কালুয়াকে আদর করে মিলের পিছন দিকে একবার দেখে আসে গদাই ঘোষ, আউটলেটটা মাঝে মধ্যেই জ্যাম হয়ে আসে, সময় মতো পরিষ্কার না করলে মিলের জল ব্যাক করে মিল চত্বরেই থেকে যাবে। সে জলের আবার প্রচন্ড দুর্গন্ধ!
মিলের চক্কর দিতে দিতেও গদাই ঘোষের মাথা থেকে গাড়ি আটকানোর ঘটনাটা মাথার মধ্যে ঘুরছে, না জানি পিনু কতটা কি করল! এসবে পিনুর উপর একটু বেশিই নির্ভর করতে হয় গদাই ঘোষকে। পিনু এমনি এক্সপার্ট, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে গদাই ঘোষ জেনেছে একজনের উপর বেশি নির্ভর করলে অনেক সময়েই তা বিপদজনক হয়ে ওঠে। পিনুর একটা বিকল্প তৈরী করতে হবে, নতুন ছেলেটাকে দিয়ে হবে কিনা দেখা যাক।
দক্ষিন দামোদরের আকাশ লালচে হয়ে আসছে ক্রমশ। বিকেল নেমে গেছে বিস্তীর্ণ আবাদি প্রান্তর জুড়ে। তবে একটানা বেশিদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাবে না , মাঝে মধ্যেই ধাক্কা খাবে। বড় পাকা বাড়ি বা মিলের চিমনিতে। যত দক্ষিনে সরে যাওয়া যাবে ততো দিগন্ত বিস্তৃত ধান জমি দেখা যাবে মিল কমে আসবে।
“রমেশ গাড়ী বের কর… বেরবো” পড়ে আসা বেলার আলোয় গদাই ঘোষের মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না, তবু সুক্ষ্ম চিন্তার রেখাগুলো কপালের ছায়া ফেলছে একটু কাছ থেকে দেখলেই বোঝা যায়। রমেশ অনেকদিনের সঙ্গী, জানে কখন কথা বলতে হয়, তাই চুপচাপ গাড়ি নিয়ে এসে পিছনের দরজাটা খুলে দাঁড়ায়।
ক্রমশ…
আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে