ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-১৩)
দেবু অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিলো কলেজের দোতলার বারান্দা থেকে নিচে মাঠের দিকে, কখন এসে যে নন্দিতা ওর পাশে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি ও। পিঠে আলতো চাপড় পড়তেই চমকে ঘাড় ঘোরাতেই দেখে নন্দিতা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
“কি রে! কার কথা ভাবছিলি?”
“আমি!… উমম তোর কথা”
“মাইরি! চল ঢপ দিস না… আমার কথা না কোচিনের নতুন মালটার কথা!”
“ধুর… বুঝলি কাজটা নিয়েই নিলাম শেষ পর্যন্ত …যা হয় হবে ।” একটু থেমে থেমে উত্তর দেয় দেবু।
“মানে! আর পড়াশুনা? পরীক্ষা!” হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নন্দিতা।
“সে দেখা যবে… ম্যানেজ করে নেব ঠিক”
“ম্যানেজ! সে আবার হয় নাকি! … তোর এত তাড়া কিসের বলতো পয়সা কামাবার?”
“তুই বুঝবি না… আমায় অনেক কিছু করতে হবে অনেক কিছু…”
“তারজন্য সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে! নাঃ এটা ঠিক করছিস না তুই …”
“দেখ জ্ঞান দিস না তুইও বাবার মতো! এক বাবাতেই দিমাগ খেয়ে রেখেছে আবার তুই!”
“বেশ… দেবনা, আমার যা ভালো মনে হলো বললাম” নন্দিতা একটু নিভে এলো, একটা ছায়া এসে নন্দিতার মুখে যেন পাতলা চাদরের মতো ঢেকে দিলো।
“ওই দেখ! রেগে গেলি তো… মাইনে পেয়েই প্রথম তোকে আইনক্সে নিয়ে যাবো… প্রমিস”
“আমি বলেছি নিয়ে যেতে? যা করবি কর… তা কবে থেকে জয়েন করছিস? কি কাজ?”
“কাজ ম্যানেজারির… এক তারিখ থেকে যেতে বলেছে”
“এক তারিখ মানেতো সামনের শুক্রবার!”
“হুম…”
“বেশ… চল ক্লাসে চললাম… টিডির ক্লাস আছে, তুই যাবিনা?”
“টিডি ! চল যাচ্ছি…”
নন্দিতা কয়েক মুহুর্ত দেবুর দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর করিডোর দিয়ে ধীরে ক্লাসের দিকে চলে যায়। একটা কমলা রঙের টপ আর ব্লু জিন্স পরে এসেছে নন্দিতা, পিঠে ব্যাকপ্যাকটা ঝুলে আছে, বেশ ঝলমলে লাগছে নন্দিতাকে আজকে।নন্দিতার হাঁটায় একটা ছন্দ আছে, একটা যেন আলো ঘিরে থাকে ওকে সব সময়! যখন যে রঙের পোশাক পরে সে রঙের আলো। আজ কমলা আলোটাও ওর সাথে সাথে দেবুর কাছ থেকে সরে যায় নন্দিতা যে দিকে গেল সেদিকে। দেবু তাকিয়ে থাকে নন্দিতা যতক্ষন না করিডোরের বাঁকে আড়াল না হচ্ছে ততোক্ষন।
টিডির ক্লাশ আর শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় না দেবুর। গেটের বাইরে এসে এক ভাঁড় চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরায়। সেদিনের গদাই ঘোষের সঙ্গে কথাবার্তা যতটুকুই হোক, সেটা একবার মনে মনে ভাবতে থাকে দেবু। লোকটা বেশ রাশভারি, কিন্তু কিছু একটা আছে লোকটার মধ্যে! কয়েক পলক ওর দিকে তাকিয়েছিলো মনে হচ্ছিলো ওর সব কিছু দেখে ফেলছে ওইটুকু সময়েই। লোকটার যে প্রচুর পয়সা আর ক্ষমতা এ বিষয়ে ওর বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। এরকম লোকের সাথে ওঠা বসা করতে পারলে লাইফ সেট হয়ে যাবে!
দেবু স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে রওনা হয় মাস্টারের দোকানের দিকে। এ সময় মাস্টার একটু ফাঁকাই থাকে, তাছাড়া সামনে পুজো বা ইদ কিছুই নেই তাই সেরকম চাপও নেই। একটু আড্ডা মারা যাবে।
“মাস্টার ও মাস্টার…আছো নাকি!”
“আর কোথায় যাবো ভাই! এখানেই থাকতে হবে , একেবারে বডি উঠবে…” হাসতে হাসতে দোকানের পিছনের দিকে থেকে মাস্টার উঠে আসে দোকানে।
“আরে না না ওসব বডি ফডি উঠতে অনেক দেরি, তার আগে কত কাজ বাকি তোমার! তাই না বলো?”
মাস্টার উত্তরে শুধু হাসে, কাউন্টারের পাল্লাটা তুলে দেবুকে ভিতরে আসতে ইসারা করে।
‘’বোসো একটু চা আনাই”
হেঁকে চায়ের কথা বলতে ওপাড় থেকে কাঁচা গলায় উত্তর আসে। সেই চা দিয়ে যাওয়া ছেলেটা!
আরামবাগ রোড রোদে তেতে পড়ে আছে। দূরে তেলিপুকুর ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে হুস হুস করে দ্রুতগতির গাড়ি, দুরপাল্লার বাস, ট্রাক চলে যাচ্ছে। এরা বর্ধমান পেরিয়ে আরও অনেক অনেক দূরে যাবে! পানাগড়, দুর্গাপুর, আসানসোল, ধানবাদ… কিংবা সিউড়ি, বোলপুর আরও অনেক দূরেও! কেউ হয়তো বর্ধমানেই অন্য দিক দিয়ে ঢুকবে! অনেক জায়গা আছে বর্ধমানে ঢোকার। দেবু দাদুর কাছে শুনেছে ছোটো বেলায়, এই কৃষক সেতু তখন ছিলো না। নৌকায় নদী পেরিয়ে তারপর গরুর গাড়িতে খন্ডঘোষ যেতে হতো। বর্ষায় গাড়ির চাকা আটকে যেত। তখন দামোদরের ছিলো রুদ্র রূপ! ফি বর্ষায় তান্ডব করতো সে। বর্ষায় শহর বাঁচাতে নদী বাঁধ ভেঙে ফেলা হতো, দক্ষিন দামোদরের অনেক অঞ্চল বানভাসি হতো। এমনকি ৭৭এর বন্যায় দুর্গাপুরের দিকে দামোদরের শাখা, তামলা নালা ভয়ংকর রূপ নেয়, তাকে নালা বলে তখন কার সাহস! ইস্পাত কারখানা বাঁচাতে, ইস্পাত নগরী বাঁচাতে তার পাড়ের বাঁধ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় আপতকালীন পরিস্থিতিতে! ওপাড়ে এমনিতে রুখা সুখা বাঁকুড়া জেলার বিস্তির্ণ অঞ্চল ভেসে যায়, উব্দাস্তু হয় হাজারে হাজারে মানুষ। তারপর আর সেভাবে আর বন্যা টন্যা হয় না! দামোদর প্রজেক্টের ড্যাম আর ব্যারেজে ব্যারেজে দামোদর নদই এখন মানুষের করুণা নির্ভর হয়ে বয়ে চলেছে।
“ঠান্ডা হয়ে যাবে গো দেবুবাবু! খেয়ে নাও…” মাস্টারের কথা হিজিবিজি চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে দেবু।
“এই মাস্টারদা… আমায় বাবু বাবু বলো কেন বলো তো! আমি শালা কোনো বাবু টাবু নই… নাম ধরে ডাকতে পারো না!“
“আরে না না ওতো আদরে ডাকি… কিছুটা অভ্যাসে। পুরোনো অভ্যাস, আমরা হলাম গিয়ে আদতে গ্রামের লোক! এই বদ্দমানের অর্ধেক লোকই গ্রামের। অনেকেই এককালে জমিদার ছিলো, এখনও এনামে বেনাম বহু বিঘে ধরে রেখেছে। আর বাকিরা তাদের প্রজা ছিলো… এই যেমন আমি… তোমরা হলে গিয়ে শিক্ষিত বড় বাড়ির ছেলেপিলে… অভ্যাসে বলে ফেলি”
“আরে বাবা আমরা কোনো জমিদার টমিদার ছিলাম না! ঠাকুর্দা শুনেছি জমিদারের সেরেস্তায় হিসাবনিকাশের কাজ করতো আর অল্পসল্প চাষবাস। আমার বাবাই প্রথম ইস্কুল পেরোনো বংশে প্রথম… বুঝলে?”
“হ্যাঁ গো বুঝলাম… আর আমার দাদু যে মুনিশ খাটতো! আবার জমিদারের হুকুমে লেঠেলগিরিও করতো। আর বাবা ছিলো নিপাট ভালো মানুষ, মনিহারি ফিরি করতো গ্রামে গ্রামে। তোমরা বোধহয় দেখোনি সেসব! সাইকেলের পিছনে একটা বড় কাঁচ লাগানো কাঁচের বাক্সো, আর তাতে নানারকম ঝুটো গয়নাগাটি, চুল বাঁধার ফিতে, ক্লিপ… বাচ্চার পিছুপিছু ছুটতো গ্রামে ঢুকলেই!”
“আর তুমি হলে মাস্টার… টেলার…” দেবু সঙ্গত দেয়।
“ঠিক… এবার তফাতটা বুঝছো… আর কান্ড দেখো তোমার দাদুর মতো তুমিও লেখা জোকা, ম্যনেজারির কাজে লাগতে চলেছো!…গদাই ঘোষও তো এ যুগের জমিদার বইতো আর কিছু নয়!”
দেবু চুপ করে বাইরে চলমান আরামবাগ রোডের দিকে তাকিয়ে থাকে। রোদ কিছুটা মরে এসেছে, ফ্লাইওভারের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে ঢেকে ফেলছে পুলিশ বিট। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেবু লক্ষ্য করে দুজন চারজন করে একটা জমায়েত দানা বাঁধছে! কারা এরা? কেমন এক রকম টি শার্ট গোছের পরে আছে সবাই! কোনো কোম্পানীর ক্যাম্পেন নিশ্চয়ই। দেবু নিশ্চিত হয়, তাইই হবে। প্রায়ই কোনো মোবাইল কোম্পানী বা শপিং মল বা কসমেটিকস কোম্পানীর এরকম ক্যাম্পেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে বা ক্রুশিং এ দেখা যায়। খুব বিরল নয় এ দৃশ্য।
কিন্তু সেখানে বড়জোর দুজন বা চার জন থাকে ছাতা লাগিয়ে, এখানে তো কম করে গোটা কুড়ি পঁচিশজন! কৌতুহল একটু বেড়েই যায় দেবুর । এমনিতে এবার উঠতে হবে, দুদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকবে বলেই ঠিক করেছে দেবু, যতটা সহজ রাখা যায় বাড়ির পরবেশ।
“মাস্টার আজ উঠলাম…“
“সেকি গো! এত তাড়াতাড়ি … কাজ আছে বুঝি?”
“হ্যাঁ …বাড়িতে একটু কাজ রয়েছে …” সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে সাইকেলে চাপে না দেবু, সাইকেল নিয়ে হাঁটতে থাকে। জটলাটার সামনে আসতে বুঝতে পারে দেবু বুঝতে পারে তাদের প্রত্যেকের গেঞ্জিতে একটা কথা লেখা আছে সবুজ রঙ দিয়ে, ‘সবুজ পাঠ’! এ আবার কি! কোনো নতুন ক্লাব বা গোষ্ঠি হবে হয়তো, এসব হুজুগও আজকাল খুব হয়েছে। দেবু মনে মনে হাসে, ওইভাবেই সাইকেল নিয়ে হেঁটে জটলাটা পেরিয়ে যেতে যেতে চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে যায়… ভিড়ের মাঝে একই রকম গেঞ্জি গায় ওই মেয়েটাকে হুবহু নন্দিতার মতো দেখতে! নন্দিতার মতো দেখতে কেন… ওটা নন্দিতাই!
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-