গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(নবম পর্ব)”

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান-র নবম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড লর ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(নবম পর্ব)

অপু, দাদা শম্ভু  ও অন্যান্যরা
“সিনে কা দাগ হ্যায় ও নালা কি লব তক না গ্যায়া/খাক কা রিযক হ্যায় ও কাতরা কি দরিয়া না হুয়া” গালিব।
(যে আর্তনাদ ঠোঁটে এলো না সে বুকে দাগ কেটে বসে/যে জলবিন্দু নদীতে পৌঁছলো না তাকে মাটি শুষে নেয়)
   এমনিতেই সকাল সকাল ওঠার কথা ছিল। বর্ষার শেষ দিকের কথা বলছি। নৌকা নিয়ে আমি দাদা শম্ভু ও আরো কয়েকজন লুথিয়ান দ্বীপে যাবো। সেখানে দ্বাদশী থেকে পূর্ণিমা অব্দি তাঁবু বেঁধে থাকা হবে। মীন জাল টানা হবে জোয়ার ভাঁটা ধরে। লুথিয়ানের চড়ায় এখনো অব্দি কেউ মীন জাল টানতে যায়নি। ওখানে স্বভাবতই জাল টানলে বাগদার পোনা উঠবে বেশি বেশি।সেই আশা নিয়েই কমল দলুইর নৌকা নিয়ে কমল সলুই সহ আমরা ক’জন যাচ্ছি। সকাল সকাল বেরনোর কথা। আজকের দিনটার জন্য যে যার কেটলিতে করে পান্তা ভাত নুন আর কাঁচা পেয়াজ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকি দিনগুলো ওখানে দিনে একবার রান্না হবে। নৌকায় প্রয়োজনীয় জিনিস পত্তর আগের দিন সন্ধার সময় তুলে নেওয়া হয়েছে। খাবার জল নেওয়া হয়েছে ড্রামে করে। চাল আলু আর একটু তেল নুন ছাড়া বিশেষ কিছু নেই।
যে কথা বলছিলুম। সকালে কুকুরের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। গাঙ ধারের দিক থেকে কুকুরের চিল্লামিল্লির শব্দ আসছে৷ আমি দৌড়ে গেলাম। যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। দিন সাতেক আগে হঠাৎ ঝড়ে  এই দ্বীপের এবং পাশাপাশি দু একটা দ্বীপের বেশ কয়েকটা নৌকা নিখোঁজ হয়েছিল। তুফানে নৌকা নিরুদ্দেশ হলে আমরা ধরে নিতুম ডুবে গেছে অকূলদরিয়ায়। লোকেরাও অবধারিত মারা গেছে। ‘নৌকা মার যাওয়া’ বলে, ডুবে যাওয়াকে। আমাদের দ্বীপের অদ্ভুত নিয়ম হচ্ছে লাশ না পাওয়া অব্দি স্বামী বেঁচে আছে ধরে নিয়ে মহিলারা শাঁখা সিঁদুর পরে থাকত। এভাবে ১২ বছর সধবার বেশে থাকার পর ধরে নেওয়া হত নিরুদ্দিষ্ট লোক মৃত, তখন তার শ্রাদ্ধ শান্তি করা হোত।
  আমার জ্ঞান পড়ার পর দেখতুম গাঙের ধারে তরুবালা ঠাকমা(ঠাকুমা) একটা ছোট্ট দু চালা ঘরে থাকতো। মীন ধরে,কাঠ ভেঙে সংসার চালাতো। তিনকালে তার কোথাও কেউ আছে বলে শুনিনি। একা মানুষ। সংসার বলি আর ঘর বলি সেই একা একটা লোককে নিয়েই। যাই হোক, জ্ঞান পড়ার পর জেনেছিলুম তার স্বামী বাইর গাঙে ফিশিং করতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল। তারপর যেমন করে ১২ বছর সধবা থাকার তেমনই ছিল তরুবালা ঠাকমা। ১২ বছর পর মুরুব্বিদের কথা মতো শ্রাদ্ধ শান্তি করে ঠাকুমা বিধবা হয়ে গেছিল। এই অব্দি সব ঠিক ছিল। একদিন একটা ঘটনা ঘটল। সে ঘটনা না ঘটলে অমন কিছু যে হতে পারে জিন্দেগী কেউ বিশ্বাস করবে না। তখন বোশেখ মাস। বনবিবির পূজাতে সেই রাতে দুখু মিঁঞা পালাগান সবে শুরু হবে। অমনি অন্ধকার চিরে মাইল খানেক দূর হতে চিৎকার ভেসে এল। যাত্রাশালের লোকজন মুহুর্তে দৌড়ানো শুরু করল। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে মা’র মুখের দিকে তাকালুম।মা বল্ল “তাড়াতাড়ি ঘর চ’,  চোর পড়ছে”।
  পরের দিন সকালে শুনলুম চোর গতকাল রাতে ধরা পড়েছে। তাকে যৎপরোনাস্তি মারধর করে গাছের সংগে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি দাদা শম্ভু নুনা সবাই মিলে দেখতে গিয়ে দেখি এক কাণ্ড। হাউমাউ করে তরুবালা ঠাকমা কাঁদছে ” ওওওও বাবা রে, তোন্নে কাকে মারচু রে, এ তো আমার নিজের লোক রে বাবা”।  হাউ হাউ করে তরুবালা ঠাকমা আছাড় খাচ্ছিল আর কাঁদছিল। বয়স্ক মুরুব্বিরা এসে দেখল। মাথার লম্বা জটা চুল ও পাকা চুলে ভর্তি দাড়ি গোঁফের পিছনে কানু দলুই কে তারা চিনতে পেরেছিল। তরুবালা ঠাকমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কানু।
তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হল।  জল দেওয়া হল।মারের চোটে ফেটে যাওয়া ফালা ফালা পিঠে দেওয়া হল লাল গদের পাতার রস। সবই হল, কিন্তু কানু কোনো কথা বল্লে না। বলবে কীকরে? সে তো মাথার মাথা খেয়ে ইতিমধ্যে পাগল হয়ে গেছে। তরুবালা ঠাকমা অনেক চেষ্টা করেও ঘরে নিয়ে যেতে পারল না। একে পাগল, তার উপর তার শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেছে, সে এখন বেঁচে নেই। মরা ভাতারকে নিয়ে বুড়ি ঘরে ঢোকাবে, সে জিনিস মুরুব্বিরা মানবে কেন? তাই সত্যিকারে মরার আগে অব্দি কানু দ্বীপের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত, যা পেত তাই খেত, যা দেখত তাই গায়ে জড়াতো। লোক বলতো শালা মরা কানু ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ শালা না মানুষ, না ভুত।
যা বলছিলুম। দৌড়ে এসে দেখলুম একেবারে বাঁধের ধারে জংগলের মধ্যে বিশ ত্রিশ টা কুকুর একটা লাশ নিয়ে মারামারি করছে। কেউ পা খুবলোচ্ছে,  তো কেউ মাথা। কেউ আবার বুকের মাংস ছিঁড়ে নিয়ে চিবোচ্ছে। লাশটা অন্তত পাঁচ ছয়দিন আগের। গন্ধ ছড়াচ্ছে। খবর দিলুম মন্টু সাউকে। মন্টু সাউ তারা বাগকে সঙ্গে নিয়ে এল। প্রথমে কুকুর তাড়ানো হল বহু কসরত করে। সে কাজ তারা বাগ ছাড়া কে করবে? এসব কাজে এ দ্বীপে সেই ভরসা। এক গেলাশ দেশি মদ খাইয়ে দিলে জগতের সব নোংরা কাজ সে করে দিতে পারে। তার গায়ে ভয়ংকর শক্তি। দেখতেও সে যমের মতো। ঘাড় অব্দি লম্বা চুল। পেশিবহুল শরীর। তাকে কেউ কখনো জামা পরতে দেখেনি। শীতের রাতে খড়ের গাদায় শুয়ে থাকে। বর্ষায় সারা রাত ভিজে ভিজে মাছ ধরে। জঙ্গলে ডাঁশ মৌর বাঁশা ভেঙে হাতে ধরে এক সঙ্গে সে আধসের এক সের মধু খেয়ে নেয়। তাকে মৌমাছি হুল ফোটালে সে টের পায় না।
যাইহোক, আমি শম্ভু নুনা, ফটাফট কিছু শুকনো গাছের ডাল ভেঙে দিলুম। তারা বাগ একটা কাঠের ডাঁই সাজালো। তারপর পচা, কুকুরে খুবলে খাওয়া লাশটা টেনে এনে পাঁজাকোলা ক’রে সেই কাঠের ডাঁই এর উপর শুইয়ে দিল। মন্টু সাউ কেরোসিনের ব্যারেল এগিয়ে দিল। কাঠের উপর কিছুটা কেরোসিন ঢেলে ট্যাঁক থেকে দেশলাই বের করে জ্বালিয়ে দিল। শুকনো কাঠ। হু হু করে ধরে গেল। তারা বাগ বাঁধে উঠে এসে হলুদ হলুদ বিচ্ছিরি দাঁতগুলো বের করে এক গাল হেসে বল্ল “শ্লা, এই লিয়া ১৯ টা হইল। মুখে আগুন দিলি। এই চুদির ভাইগুলা আগের জন্মে আমার বাপ থাইল”। হো হো করে হাসতে থাকে তারা বাগ। কী ভয়ংকর সে হাসি! মনে হচ্ছে গোটা দ্বীপের মুখেই আগুন লাগিয়ে দিয়ে অট্টহাসি হাসছে দানবটা।
  আমাদের স্বভাবতই রওনা দিতে দেরি হয়ে গেল। বাড়ি গিয়ে পান্তার কেটলি, জাল, মীন বাছার হাঁড়ি থালা ঝিনুক ইত্যাদি নিয়ে এসে নৌকায় উঠলাম। কমল দলুই হাল ধরল। আমি আর শম্ভু দু পাশে দাঁড়ে। ছপাশ ছপাশ করে এগিয়ে চল্লাম লুথিয়ানের দিকে। গাঙ কে দেখে বোঝার উপায় নেই যে মাত্র সাত দিন আগে এ কত ভয়ংকর মাতাল হয়ে জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। সেই ভয়ংকরী এখন কী অনিন্দ্যসুন্দর শান্ত! আদর করতে ইচ্ছে হয়। বুকে জড়িয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে হয়। এত রহস্যময়ী সুন্দরী আর কোথাও নেই পৃথিবীর। ওর সুন্দর সমাহিত ওষ্ঠ, বুক, পেট আর সুগভীর নাভি তখন ইশারা করে ডাকছে। তরুবালা ঠাকমার কথা মনে পড়ল। এক মুহুর্ত সহ্য করতে পারেনা এই গাঙকে। যা তা বলে। খিস্তি আওড়ায়। “নাঙখোরি গাঙ। নাঙকে ভুলিয়া ভালিয়া লিয়া যায়া মারে। বেবুশ্যে মাগির অত মাথা খায়াও সাধ মিটেনি।”
লুথিয়ানে পৌঁছে প্রথম দিনেই কেল্লাফতে হয়ে গেল। একেক বার জাল টানি তো হাজার কি শ’পাঁচেক বাগদার পোনা উঠে আসে। আমি আর শম্ভু দুজনে দুটো জাল টানছি, দাদা দুটো জালের মিন বেছে উঠতে ঘেমে যাচ্ছে। জাল টেনে এনে জালের পঁটায় যা আছে সব কিছু ঝেড়ে ফেলা হয় একটা বড় হাঁড়িতে, তারপর সেই হরজয় মাছের ভীড় থেকে বাগদার পোনা বেছে নেওয়া হয় ঝিনুক দিয়ে। সেগুলোকে আর একটা হাঁড়িতে রাখা হয়। প্রথম দিনেই প্রায় হাজার পাঁচেক মীন ধরে ফেল্লাম আমি শম্ভু আর দাদা। মীনের হাজার তো তখন অন্তত দশ পনের টাকা হবেই। আমাদের মুখে চওড়া হাসি। শুধু আমার তিনজনই নয়, কমল দলুই আর তার বৌ মিলেও কম সে কম হাজার তিনেক মীন ধরেছে। আমাদের তৃপ্তি তখন লুথিয়ানের আসন্ন রাত্রিযাপনের সামান্য ভয়কে অতিক্রম করে গিয়েছে। সেরাত্রে রান্নাবান্না না হওয়ারই কথা। কিন্তু আনন্দেই হোক আর সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে অত্যন্ত ক্ষিধেবশতই হোক,রান্না করলাম।কমল দলুইর বৌ ভাত আর কুচো চিংড়ির ঝাল রান্না করল। আমরা পেট পুরে খেলুম সবাই।
  সন্ধ্যার আগেই দুটো তাঁবু তৈরি করে ফেল্লাম। আমরা তাঁবু নয়, কুঁড়িয়া বলতুম। গাছের ডাল কেটে দু চালি কাঠামো করে তার উপর ত্রিপল টাঙিয়ে দিলুম। চার পাশে ছোট ছোট থাড়িয়া (খুঁটি) পুঁতে ত্রিপলকে টানটান করে দিলুম। ভিতরে শুকনো পাতা পেতে দিলুম পুরু করে। দুটো তাঁবু হোল। একটায় আমি দাদা আর শম্ভু, অন্যটায় কমল দলুই আর তার বৌ। বালির খালের ভিতর নৌকা বেশ খানিকটা ঢুকিয়ে উঁচু গাছের ডালের সংগে বেঁধে দিলুম যাতে জোয়ার এলে দড়িতে টান না পড়ে।
   আমরা রাজপুত্তুর নই। ভাল বিছানায় ঘুমোনোর অভ্যাস কোনোকালেই নেই। সারাদিনের পরিশ্রম আছে তার উপর। ঘুম আসতে দেরী হলো না। একটা খসখস শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। চুপচাপ বোঝার চেষ্টা করলুম কী হচ্ছে। বামদিক ঘুরে শম্ভুকে ঠেলা দিলুম।
“কী হইচে রে? ঘুম জড়ানো গলা শম্ভুর।
” চুউউপ! শুঁ, শুঁ তে পাউটু?”
হুম
উঠে বসল শম্ভু। বোম্বা জ্বালে দেশলাই বের করে। তখনকার দিনে টিনের কৌটো কেটে ইয়া বড় বড় কেরোসিনের ল্যাম্প বানাতুম আমরা। সে ল্যাম্প জোর বাতাসেও নিভতোনা। সেই ল্যাম্পকেই আমরা ‘বোম্বা’ বলতুম। বোম্বা বাইরে এনে কিছুটা বোম্বার আলো আর কিছুটা পড়ন্ত চাঁদের আলোয় দেখলুম গোটা ত্রিশ পঁয়ত্রিশেক শেয়াল আমাদের তাঁবুর চারপাশে ঘিরে গেছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলুম। এই বোধ হয় ওরা একসঙ্গে আক্রমণ করল। আমার আর শম্ভুর ফিসফিস কথা আর অতগুলো শেয়ালের খড়মড় খসখস আওয়াজে তখন দাদাও জেগে গেছে। সে উঠে বসে বোঝার চেষ্টা করছে। ওপারের তাঁবুতে বোধ করি কমল দলুই আর তার বৌও জেগে গেছে। তাদের তাঁবু থেকে বোম্বার আলো দেখা যাচ্ছে। শেয়ালগুলো এদিক ওদিক পায়চারি করছে। দুটো একটা একেকবার অতি উৎসাহে তাঁবুর একেবারে গায়ে এসে আবার দু’পা পিছিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শম্ভুর গলায় গগন বিদারি হাঁক ‘এই শালারা আ আ আ আ ‘। তার পর চোখের পলকে লাফিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে সন্ধ্যার সময় যে ক’টা কাঠ রান্না করার পর বেঁচেছিল তারই একটা হাতে তুলে লাফ দিয়ে আরো দু’পা সামনে এগিয়ে আবার হাঁক ছাড়ল। শেয়ালগুলো সম্ভবত হকচকিয়ে গিয়ে দৌড়ে অনেকটা পিছিয়ে গেল। কিন্তু একেবারেই চলে গেল তা নয়। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখলুম দূরে গিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো একটা চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি সচকিত হয়ে বল্লুম “যায়নি শ্লারা। আবার আইসবে”। তড়িৎগতিতে শম্ভু শুকনো কাঠে আগুন ধরালো, তারপরেও যখন গেলনা জন্তুগুলো, তখন একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে দৌড়ে গেল ওদের দিকে। সেদিন অতগুলো জন্তু আতংকে দৌড়ে যেভাবে পালিয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। শম্ভু ফিরে এলে বল্লুম ” তুই শ্লা বেম্মদত্যি। তোকে কে শ্লা না ভয় করবে!” খুব শান্ত গলায় শম্ভু বল্লে “শ্লা, আমাকে না হো, অন্নে আগুনকে দেখিয়া ভয় পাইছে”। আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম, যেন বিজয়ীর হাসি।
   সকালে উঠে মিনের জল পাল্টালুম। ভোর রাতে মিন জাল নিয়ে জলে নামার কথা ছিল, কিন্তু মাঝরাত্রিতে জংলি জানোয়ারগুলোর জন্য ঘুমের বারোটা বেজে গেছিল। ভোররাতে সবাই গভীর ঘুমে পড়ে যায়, কারুরই ঘুম ভাঙেনা। আবার জাল নিয়ে জলে নামবো সেই দুপুরের পরে। অগত্যা শম্ভুর সঙ্গে জঙ্গলের ভিতর গেলুম। আমি দাদা পিছনে, শম্ভু সামনে হাঁটছে। শ্বাসমূলে পা পড়ে মচমচ করে আওয়াজ হচ্ছে। ঘন বানি গাছের জঙ্গল। কিছুটা এগোনোর পর কমল দলুইর গলা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লুম। সেও যেতে চায় আমাদের সংগে। কমল আসার পর আবার জংগলের ভিতর দিয়ে হাঁটা শুরু হলো। চারিদিকে হরিণের পায়ের ছাপ। শম্ভু বোঝাচ্ছিল কোনটা হরিণের পায়ের ছাপ আর কোনটা শুয়োয়ের। বুনো শুয়োর আমি আগে দেখেছি। লুথিয়ান থেকে পেরিয়ে আমাদের দ্বীপে উঠেছিল। কী তার চেহারা! হিংস্রতায় ভরপুর।  কানু বারুই কুড়ুল নিয়ে তাড়া করেছিল। কুড়ুলের ঘা খাওয়ার পরেও অসম্ভব ক্ষীপ্রতায় কানু বারুইর পায়ে কামড়ে এক খাবলা মাংস তুলে নিয়েছিল। কানু বারুইএর পা আর কখনো ভাল হয়নি। ওই পা’র জন্যই সে মরেছিল।
  হঠাৎ ডানপাশে একটা হিস হিস আওয়াজে ঘুরে দাঁড়ালুম। অন্তত হাত পাঁচেক লম্বা একটা কেউটে সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। শম্ভু ইতিমধ্যে গাছের একটা ডাল ভেঙে সেটা লাঠির মতো বাগিয়ে ধরে হাঁটছে। ও নিজেও জানে ওই আমাদের নেতা। ওর সাহসে ভর করেই আমরা হাঁটছি। কছুটা অগ্রসর হয়ে শম্ভু দাঁড়িয়ে পড়ল। উপরের দিকে আঙ্গুল তুলে কিছু দেখানোর চেষ্টা করছে। তাকিয়ে দেখলুম একটা ডাঁশ মৌমাছির চাক। শম্ভুর ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি
” কী রে, মধু খাবু?”
কে ভাঙবে? দাদার চটজলদি প্রশ্ন।
খাবু কি? আমি ভাঙবো।
অবাক বিস্ময়ে দেখছি শম্ভু চারপাশ থেকে শুকনো পাতা জড়ো করছে। তারপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার হাত কমল দলুইর দিকে কিছু চাইল। কমল দলুই কোনো কথা না বলে ট্যাঁক থেকে দেশলাই বের করে দিল।
অদ্ভুত লোক এই কমল দলুই। বয়সে আমাদের চারগুণ। ঢ্যাঙ্গা চেহারা। পাতলা চুল ঘাড় ছাড়িয়ে পিঠে কাঁধে পড়েছে। লোকটা কথা এমনিতেও কমই বলে। গানের গলা খুব ভাল। লোকে কেন গান গায় জানি না। কিন্তু কমল দলুই গান করে মনের ডাকে। সন্ধ্যার অন্ধকার চিরে মাঝে মধ্যে দ্বীপের দক্ষিণ দিকের লোকেরা হঠাৎ হঠাৎ একেক দিন তার গলা শুনতে পায়। কী সুন্দর ভাটিয়ালি টান! সম্পত্তির মধ্যে লোকটার একটা নৌকা আর একটা পুরানো রংচটা হারমোনিয়াম ছিল। কখনো কখনো দুপুরবেলা অকস্মাৎ তার বাড়িতে গিয়ে গান করতে বলতুম। বিনা প্রশ্নে হারমোনিয়াম নিয়ে শীতল চাঁটাই পেতে বসে যেত। তারপর যতক্ষণ না আমাদের ক্ষিধে পায়, যতক্ষণ না শ্রবনেন্দ্রিয় ক্লান্ত হয় ততক্ষণ সে গান চালিয়ে যেত। হারমোনিয়াম গুছোতে গুছোতে বলতো ” তোন্নে দেখবু, আমি গান গায়া একদিন বড়লোক হয়াবো, শ্লা, তখন আগে একটা ভাল হারমোনিয়াম কিঁবো।”
  শম্ভু দেশলাই জ্বেলে শুকনো পাতায় আগুন ধরায়। আগুন ভালভাবে ধরে গেলে কিছু কাঁচা পাতা নিয়ে আগুনের উপর চাপিয়ে দেয়, গপগপ করে ধোঁয়া উঠে। মুহুর্তে পুরো জায়গাটা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। মৌমাছি গুলো উড়তে শুরু করে। ” সব লোক চুপ করিয়া দাঁড়া” শম্ভু সাবধান করে দেয়। ক্রমশ পুরু ধোঁয়ায় মৌমাছিগুলো চাক ছেড়ে দেয়। শম্ভু এক হেঁচকায় ডাল ধরে গাছে উঠে পড়ে। তারপর চাকের কাঁদা ভেঙে নেয়। কাঁদা ভাঙতে গিয়ে কিছুটা মধু পড়ে যায় নীচে। আমি হাত পাতি। নীচে নেমে আসে শম্ভু। তারপর আদিম জন্তুর মতো সেই কাঁদা চারটে প্রাণী ফটাফট ভাগাভাগি করে মধু খেতে থাকে।
  জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবার আগেই দেখতে পেলুম জঙ্গলের উপর কালো মেঘের ঘন ছায়া। “হাওয়া ভাল ঠ্যকেটেনি রে কচি, চ’ তাড়াতাড়ি পা চালা” কমল দলুই বলে। আমরা দ্রুত পা চালিয়ে যখন জংগলের বাইরে বেরলুম, দেখলুম আকাশ ঘোলাটে, বাতাস ছাড়ছে হু হু করে। আমাদের তাঁবুর ত্রিপলগুলো আছাড় খাচ্ছে হাওয়ায়। জোয়ারের গাঙ ফুঁসছে। একটা অমঙ্গলের সংকেত এদিকে ওদিকে। শম্ভু যেন একটু বিচলিত হয়ে উঠল। “কমল দাদু, আর রওয়া যাবেনি। কুঁড়িয়া ভাঙিয়াবে। আর দেরি করলে শেষে ঘরে যাইতে পারবনি। তাঁবু ভাঙো, সব গুছি লও।” বিদ্যুৎ গতিতে কাজ শুরু করলাম আমরা। পলকে সব গুছিয়ে নিলুম। কমল দলুই নৌকা খুলে আনলো। জোয়ারের জল তখন জংগলের ধার অব্দি এসে গেছে। লম্বা লম্বা ঢেউ এসে জংগলের গায়ে নিষ্ঠুর আঘাত করতে লাগলো। সব জিনিসপত্র তুলে নৌকায় উঠলাম। মীনের হাঁড়ি ও অন্যান্য জিনিস নৌকার খোলে রাখলাম। দাঁড় ও হাল নামানো হলো। এই উত্তাল গাঙে শুধু দাঁড় বেয়ে এগোনো মুশকিল। কমল দলুই আর শম্ভু মিলে কোনোক্রমে পাল টাঙিয়ে দিল। অমনি নৌকা পাগল হয়ে গেল। আমি আর শম্ভু দাঁড় নিয়ে বসে আছি। জলে লাগাতে পারছিনা। তার প্রয়োজনও নেই। দাঁড় তুলে দিলুম। নৌকা মাতালের মতো একবার সোঁ করে সামনে এগিয়ে গিয়ে জলের তলায় চলে যায়, পরক্ষণেই ঢেউএর মাথায় উঠে পড়ে। আমাদের নৌকাটা যেন যুদ্ধে নেমেছে। কমল দলুই হাল ধরে রাখতে পারছে না। হালের পাতায় একেকটা ঢেউ ধাক্কা মারে আর হালের বাতা ঠিকঠাক ধরে রাখতে কমল দলুই চীৎকার ক’রে তাকত্ লাগায়। ছাতির হাড় বেরিয়ে আসতে চায় যেন। তখনকার দিনের লম্বা হালের বাতা,বসে ধরা যেতো না, দাঁড়িয়ে ধরতে হোত। আমরা জোয়ান কচি মানুষগুলো বসে থাকতে পারছি না। নৌকার ডালি ধ’রে চেপে বসে আছি। এই মনে হয় ছিঁটকে পড়বো গাঙে। আর কমল দলুই লম্বা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হালের সংগে কুস্তি করছে। বুঝতে পারছি কমল দলুই আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারবে না। একবার শম্ভু উঠে পালের দড়ি খুলে দেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। পালের পেট অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছিল বার বার। শম্ভু হন্যে হয়ে নৌকার খোলে কাটারি খুঁজতে লাগল দড়ি কেটে দেবার জন্য। হাতের কাছে পাচ্ছিল না। আমার দাদা কাঁদছিল। আমি তাকে সামলাবার কোনো চেষ্টা না করে খোলের মধ্যে চোখ চালাচ্ছিলাম কাটারির জন্য। হঠাৎ নৌকাটা জোর গোঁত্তা খেল। দ্রাম করে হালের বাতা লাগল কমল দলুইর মাথায়। সে ছিঁটকে পড়লো গাঙে। আমার দাদা আর কমল দলুইর বৌ দুজনেই হাঁক ছেড়ে কাঁদছিল। আমি কাটারি পেয়ে গেলাম। এক কোপে পালের দড়ি কেটে দিলাম। নৌকা সাঁই করে ঘুরে গেল। কমল দলুই চেষ্টা করছে নৌকার কাছে আসার। কিন্তু পেরে উঠছে না। আমি দড়ি ছুঁড়ে দিলাম। বেচারি ধরতে পারলো না। এদিকে নৌকার হালে ক্যারচা ঢেউ লেগে নৌকা পাল্টি খাওয়ার অবস্থা। শম্ভু লাফ দিয়ে নৌকার হাল ধরল। আমি দ্বিতীয়বার দড়ি ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই কমল দলুইকে আর দেখা গেল না। কোথায় গেল? ঢেউ তাকে কোথায় নিয়ে গেল? মাথায় জোর বাতার ছাটা খেয়েছিল সে। তাতেই হয়তো জলের সংগে লড়াই করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছিল কিছুটা। আমি আর সদ্য নিরুদ্দিষ্ট কমল দলুইর বৌ দাঁড় ধরলাম। শম্ভু বল্ল ” যেকুনভাবে ধারে যাইতে হবে। যায়া খবর দিলে বড় লৌকা লিয়া খুঁজতে আসবে,  আমান্নেও আসবো”।
  অনেক লড়াই করে গঙ্গাবুড়ির ঘাটে পৌঁছালুম। এসেই চেঁচিয়ে কেঁদে সবাইকে বলতে লাগলুম “কমল দাদু লৌকানু পড়িছে, তুমান্নে সব লৌকা খুল, যাও। আমার মা ঘাটে বসে ছিল, দৌড়ে এসে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।খবর পেয়ে প্রায় এক ডজন বড় নৌকা কমল দলুইকে খুঁজতে বেরোল। তখন হাওয়ার দাপট কিছুটা কমেছে। সারাদিন খোঁজা চল্ল। রাত পেরিয়ে গেল। পরের দিন সকালে কমল দলুইকে পাওয়া গেল। ভাসান খালের নাবায় (নিম্নাংশ) পাওয়া গেল তাকে। উপুড় হয়ে কাদার উপর পড়ে আছে। হাত পা ফ্যাকাশে। মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন। ডান পায়ের একটা আঙ্গুল সম্ভবত কোনো মাছে কেটে খেয়েছে।
   কমল দলুই একটা গান খুব গাইত। “ওওও আল্লা, ওওওও ঈশ্বর, ওগো দয়াময়। ঠাঁই দিও চরণে তোমার”। গানটা কানের কাছে রিঁ রিঁ করে বাজছিল।
লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(অষ্টম পর্ব)”

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *