“গরীবের ঘোরা রোগ”-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ(৫ম পর্ব)

পরিচিতিঃ জন্ম ও বড়ো হওয়া মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায়। সেরিকালচার ও বাংলা বিষয়ে স্নাতক। বাংলায় স্নাতকোত্তরের পরই লেখার জগতে প্রবেশ ছোটো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ সাহিত্যের হাত ধরে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশিত বই দুটি- ছোটো গল্প ‘যাপ্যযাত্রা’ (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ২০১৮ হিসাবে ডা: ব্রজগোবিন্দ সাহা পুরস্কারে ভূষিত) ও নভেলা গ্রন্থ ‘আমি বৃক্ষপুরুষের প্রেমিকা’।

গরীবের ঘোরা রোগ-এ রুমকি রায় দত্তর মণিপুর ভ্রমণ

 

মণিপুরের পথে পথে

৫ম পর্ব

বেশ সকালেই উঠে পড়েছি আমরা। আগেরদিন গাড়ি বুক করা আছে। ঠিক ন’টায় গাড়ি আমাদের বর্তমান হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে যাত্রা করবে নাগাল্যান্ডের পথে। সারাদিনের জার্নি। সকাল সকাল স্নান সেরে বেশ ভারী ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম আমরা। তারপর শীতের মিঠে রোদ গায়ে মাখতে ক্লাসিক হোটেলের সুন্দর সাজানো গোলাপ বাগানে গিয়ে দাঁড়ালাম। অপেক্ষা গাড়ির। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক চলছে,তখনও জানি না, এ অপেক্ষা অন্তহীন হতে চলেছে। সাড়ে ন’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফোন করা হল ড্রাইভারকে। যা জানলাম, তখন মাথায় আকাশ ভাঙার মতো অবস্থা প্রায়। গাড়ি নাগাল্যান্ড যাবে না। সকালে যে ক’টা গাড়ি রওনা হয়েছিল, একে একে সবাই ফিরে আসছে। কারণ, একটা ড্রাইভার সহ ট্রাক নাগাজঙ্গিরা অপহরণ করেছে। সে গাড়ি তখনও উদ্ধার করা যায়নি। কাজেই রুট বন্ধ। কোনও গাড়ি নাগাল্যান্ড যাবে না। কিন্তু রাস্তা খুলবে কবে? সেই মুহুর্তে সেটাও বলা সম্ভব নয়।
সর্বনাশ! নাগাল্যান্ডে হোটেল বুক করা তিনদিনের ২৯,৩০,৩১ ডিসেম্বর। এক তারিখ ডিমাপুর থেকে ফ্লাইটের টিকিট কাটা আছে। নাগাল্যান্ডই যদি পৌঁছাতে না পারি, তবে কী হবে? বিশাল দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে তখন বিভ্রান্তিকর সব সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছি আমরা। একবার মোবাইলে ইম্ফল থেকে কলকাতা ফ্লাইটের টিকিট দেখছি। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, যদি ফ্লাইটেই নাগাল্যান্ড চলে যায়? ভাড়া দেখেও মাথায় হাত। পরিবার পিছু তিনজনের ফ্লাইটের টিকিট সে তো কম টাকা নয়, তার উপর কেটে রাখা টিকিটের টাকাটা পুরো নষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে ক্লাসিক হোটেলের ম্যানেজার আমাদের শুভ বুদ্ধি দিলেন। সেইদিনটা মণিপুরেই থেকে যাওয়ার। আরও কিছু দেখার আছে, সেগুলো দেখে নেওয়ার।এপথে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়, কাজেই আশা করা যায়, পরেরদিন রাস্তা খুলে যাবে।
থেকে গেলাম আমরা, এবং থেকে গিয়ে লস কিছু হল না। হোটেল থেকেই আমাদের গাইড করলেন, কাছেই “মণিপুর ট্রাইবাল মিউজিয়াম” আছে। ঠিক করলাম, মিউজিয়াম দেখে সারাদিন বাজার ঘুরে সময়টা কাটিয়ে দেব। হোটেলের সামনে থেকেই অটো ধরে গেলাম ট্রাইবাল মিউজিয়ামে। বেশিদূর নয়, কাছেই। সুসজ্জিত প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে চার থেকে পাঁচজন রাইফেলধারী কমান্ডো। এত কড়া সিকিউরিটি দেখেই মনে হয়েছিল, নিশ্চয় ভিতরে রত্ন আছে। সত্যিই অসাধারণ এই মিউজিয়াম। না-দেখলে সত্যিই অপূর্ণ থেকে যেত আমাদের মণিপুর ভ্রমণ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সব আদিবাসী সাধারণ মানুষ থেকে রাজা-রাণীর ব্যবহার করা পোশাক, অস্ত্র, গ্রেহস্থালির সরঞ্জাম। জীবনযাপনের মডেল। আশ্চর্য এই মিউজিয়াম। প্রতিটি জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের যে নিজস্ব কালচার, তা সযত্নে তোলা এই মিউজিয়ামে। আকারে বিশাল বড়ো এই মিউজিয়াম। দেখতে দেখতে অ্যান্টিক রুমে পৌঁছে হতবাক! একটা পাথরের বিষ্ণু মূর্তি। লেখা দেখলাম পাণ্ডুয়া থেকে আবিষ্কৃত এই মূর্তি। পান্ডুয় মানে কি হুগলী জেলার পান্ডুয়া? রয়েছে কাচের সিন্দুকে রাখা অজস্র পুথি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন অনেক অরিজিন্যাল পুথি। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ,মধ্যযুগের এমন তাজা নিদর্শন দেখে মন লোভাতুর হয়ে উঠল নিমেষে। একটা তো কাচের দেওয়াল মাত্র। যদি বের করে একবার হাতে ধরতে পারতাম! দেখে দুঃশ্চিন্তাও হল।কবে শুনব,এগুলোও চুরি হয়ে গিয়েছে। বেশ ঘন্টা তিনেক সময় কোথাদিয়ে যেন পার হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম যখন, ঘড়িতে তখন একটা বেজে গিয়েছে। দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়েই দেখলাম,সামনেই সেই ট্রাডিশন্যাল পোশাকের হাট। গতদিন বিকেলে যেটা বন্ধ ছিল। এখন রমরমিয়ে চলছে বিকিকিনি। তারমানে এর উলটো দিকেই কিছুটা হেঁটেই “ ইমা মার্কেট” সেই মহিলা পরিচালিত বাজার।
কিন্তু আসে পাশে চোখ বুলিয়ে কোথাও কোনও ভাতের হোটেল পেলাম না। একটা রেস্টুরেন্ট নজরে এল, কিন্তু আমাদের চাই, ভাতের হোটেল। একজন জানাল, একটু সামনের দিকে এগোলেই একটা বাস- অটো স্ট্যান্ড আছে। ওর শেষ প্রান্তে পরপর ভাতের হোটেল আছে কয়েকটা। আমরা কথামতো এগোতে লাগলাম। হ্যাঁ, এই তো অটোস্ট্যান্ড! বাঁ-দিকে তাকিয়ে মন ভরে উঠল। একখন্ড কলকাতার কলেজস্ট্রিট যেন! পরপর দোকান সব থরে থরে সাজানো বই। সেসব দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম অপর প্রান্তে। আছে, সত্যিই কতগুলো ভাতের হোটেল, তবে পরিবেশ মোটেই তেমন পরিষ্কার নয়। তারই মধ্যে একটা ছিমছাম হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম। ভাতের সাথে প্রথমেই দিল ডাল আর ঝিঙ্গা ভাজা। দেখলাম, অতিকুচো চিংড়ির সাথে একটা শাক মুচমুচে করে ভাজা। দারুণ উপাদেয়। দুবার নিলাম। শাকটার নাম জানতে চাইলাম। জানাল—নকুচি শাক আর ঝিঙ্গাভাজা। কী শাক কে জানে? জীবনে নাম শুনিনি তো। তবে শুনলাম এই শাক এখানে বিশেষ প্রচলিত। এর সঙ্গে আরেক প্রকারের শাক ভাজা ছিল, তারনাম ‘নপাপী’। আমি ডাল,শাক দিয়ে নিরামিষই খেলাম। বাকি সদস্যরা একপিস করে মাছ। খুব স্বাদের নয়,শুনলাম সেই মাছ। খাওয়া সেরে সামনের রাস্তা দিয়ে ঐ হাটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দিনের বেলায় পথ না হাঁটলে এই জমজমাট মণিপুর দেখতে পেতাম না। রাস্তার একধারে সার বেঁধে বসে আছে হলুদ মাখানো বিভিন্ন মাছ নিয়ে। কেনা বেচা চলছে। আঁশটে গন্ধে ম ম করেছে বাতাস। আমরা হেঁটে পৌঁছালাম ঐ ট্রাডিশন্যাল হাটে। বিশাল এই হাটের রংবাহারি রূপ দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কোন দোকানে যাব? কী কিনব? সবই তো ভালো লাগছে। কি মুশকিল! মনিপুরী চাদর। ট্রাডিশন্যাল পোশাক হল innaphi ( উপরে পরার চাদর) phanek ( নীচে জড়িয়ে পরার ড্রেস )। কোনো জায়গায় গেলে সেখনাকার ট্রাডিশন্যাল কিছু না কিনলে মন কেমন করে। নিজের জন্য একটা ড্রেস তাই কিনেই ফেললাম। কোথাদিয়ে যেন সময় বয়ে যেতে লাগল। ঘুরে ঘুরে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পাশেই একটা সুসজ্জিত পার্ক আছে। সেখানে গিয়ে ঢুকলাম। এককাপ গরম চায়ের জন্য মন কেমন করে উঠল। দেখলাম, কোনো দোকান নয়, মণিপুরী মহিলারা বড়ো ফ্লাক্সে করে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করছে। বেশ ঘন্টাখানক বসে আছি আমরা। সন্ধ্যা প্রায় নামার সময় হল। ঠিক আছে, এখান থেকে বেরিয়ে পথে “ ইমা মার্কেটে” কিছু কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরব। চা খেয়ে পয়সা মেটাচ্ছি আমি। একজন মহিলা কিছু পোশাক নিয়ে এসে পার্কেই বসেছে। সেইদিকে তাকিয়ে আছি। ছেলে কত্তার হাত ধরে আছে। কয়েকটা মিনিট মাত্র অন্যমনস্ক হয়েছি, হঠাৎ দেখি ছেলে কত্তার কাছে নেই। সে নিজেই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ছেলে কোথায়?


আমি বিস্ময়ে থমকে গেলাম। মুহূর্তক্ষণ মনে হলে আমি কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছি। মাথার মধ্যে শুধু একটাই কথা ভেসে উঠছে। ছেলে নিশ্চিত কিডন্যাপ হয়েছে। কারণ আসার আগে এইসব রাজ্য সম্পর্কে তো শুধু এটাই শুনে এসেছি। বাকি পাঁচটা মানুষ নিমেষে সক্রিয় হয়ে উঠলাম। যাকে পাচ্ছি, জানতে চাইছি, কোথাও কেউ কোনও বাচ্চাকে দেখেছে কিনা? অনেকে ভাষা বুঝতে পারছে না। কেউ বুঝতে পারলে, মাথা নেড়ে জানাচ্ছে দেখেনি। বুকের ভিতরে তখন উথালপাতাল চলছে। একি হল? সব শেষ?
দশ মিনিট প্রায় অতিক্রান্ত। হতাশ অবসন্ন হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছি চারিদিকে। হঠাৎ দেখি দীর্ঘ লম্বা পার্কের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে ছেলে। নির্বিকার, নিরুত্তাপ! কোনও ভয়ের ছাপ নেই তার মুখে। সে তো আসলে পার্কের গাছ গুনছিল। বাপি বলেছে এই পার্কে ক’টা গাছ আছে গুণে ঠিক করে বলতে।
ছেলে গাছ গুনছে, আর বাপ সেটা বেমালুম ভুলে বসে আছে। তখন বারবার মনে হচ্ছিল, এই যে মনের কোণে এক অজানা আতঙ্ককে বহন করে চলেছি আমরা,এটা তারই পরিণতি। রাজ্যগুলি সম্পর্কে এত খারাপ কথা শুনেছি যে, একটা অদৃশ্য আতঙ্ক পিছনে ঘুরছেই। অথচ সেই ২৩শে ডিসেম্বর থেকে ঘুরছি আমরা। দুটো রাজ্য পার হয়ে গেল, সত্যিই তেমন কোনও ভয়ানক কিছু উপলব্ধি তো হল না! তবে নাগাজঙ্গিদের অপহরণের বিষয়টা সত্যিই ভয়ঙ্কর!
ইমা মার্কেটে পেলাম এখানকার বিশেষ হস্তশিল্পের নমুনা। এখানে উৎপন্ন হয় একপ্রকার ঘাস। সেই ঘাস দিয়ে তৈরি হয়,ব্যাগ, জলের বোতল রাখার ব্যাগ,আরও রকমারি জিনিস। সংগ্রহ করলাম কিছু জিনিস।
সাতটার মধ্যে বাজার বন্ধ হতে শুরু করেছে। কিছু দোকানের ঝাঁপ নেমে গিয়েছে। ইমা মার্কেটের মহিলা বিক্রেতারা গোটাচ্ছে তাঁদের পসরা। আমরাও বড্ড ক্লান্ত তখন। অটো ধরে ফিরলাম হোটেলে। এবার কিছু খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। পরেরদিন নাগাল্যান্ডের পথে দৌড়াব আমরা।
মণিপুর ভ্রমণ এখানেই সমাপ্ত।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *