জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা
গল্প শুরুর আগে নেকড়ে সম্বন্ধে একটু জেনে নেওয়া যাক। ধূসর নেকড়ে (Canis lupus লিনিয়াস, ১৭৯৮) প্লাইস্টোসিনকালের শেষ ভাগে অর্থাৎ প্রায় ৩,০০,০০০ বছর পূর্বে উদ্ভূত হয়। ডিএনএ সিকুয়েন্সিং এবং জিনেটিক ড্রিফট গবেষণায় দেখা গেছে নেকড়ে ও গৃহপালিত কুকুরের পূর্বপুরুষ একই, যদিও একথা প্রশ্নাতীত নয়। তবে নেকড়ে একমাত্র স্থল স্তন্যপায়ী প্রাণী যাদের সবচেয়ে বেশি আবাসস্থল রয়েছে। এরা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় (আলাস্কা থেকে মেক্সিকো) বাস করে। ইউরোপে এরা ইউক্রেন, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, বাল্টিক রাজ্য, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, বলকান অঞ্চলে থাকে। এশিয়াতে এদের কোরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান এবং আরব উপদ্বীপের উত্তরে পাওয়া যায়।
তুন্দ্রা, স্টেপি, তাইগার পাদদেশ, ক্রান্তীয় বনভূমি, মরুভূমি, পার্বত্য এলাকা, তৃণভূমি এবং এমনকি লোকালয়ের কাছাকাছি এলাকাতেও নেকড়ে বাস করে। নেকড়েরা বুদ্ধিমান এবং সামাজিক প্রাণী। এরা দলবদ্ধভাবে শিকারও করে৷ একটি নেকড়ে ছয় থেকে আটটি বাচ্চার জন্ম দেয়৷ এদের দলে নারীনেত্রী গর্ভবতী অবস্থায় বাচ্চা প্রসবের জায়গা নির্ধারণ করে৷ নেকড়ের গর্ভকালের মেয়াদ সাধারণত ৬৩ দিন হয়৷ আর জন্মের পর বাচ্চারা আট সপ্তাহ অবধি মায়ের দুধ পান করে৷ একটি নেকড়ের দলে ছয় থেকে দশজন সদস্য থাকে৷ দলের সদস্যরা সব বাচ্চা দেখাশোনা করে৷
বিভিন্ন মানব সংস্কৃতি ও পুরাণে নেকড়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ভাবেই স্থান পেয়েছে। বিশ্বাস করা হয় আলোর পথ খুঁজে না পাওয়া গেলে অন্ধকার সময়ে নেকড়ে মানুষের আত্মা নির্দেশক হিসেবে দেখা দেয় ও অনলস স্বাস্থ্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নেকড়ের স্বপ্ন দেখা মানে স্বাধীনভাবে আধ্যাত্মিক আবেগগুলির প্রকাশ। আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা বছরের প্রথম সুপারমুনকে ‘নেকড়ে চাঁদ’ ডাকে কারণ মনে করা হয় ওই সময় এত আলো হয় যে, নেকড়েরা ডেরা থেকে বেরিয়ে ডাকতে শুরু করে। যেমন জ্যাক লন্ডনের বহুল পঠিত ‘হোয়াইট ফ্যাঙ’ বইয়ের প্রচ্ছদে একটি নেকড়েকে চাঁদনি রাতে ডাকতে দেখা যায়।
তবে বিজ্ঞানীরা বলেন, চাঁদ ওঠার সঙ্গে নেকড়ের ডাকার সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। নেকড়ে নিশাচর প্রাণী। ডাক ছেড়ে সঙ্গীদের নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। বিপদে পড়লেও ডাকে, যেন অন্যরা এসে তাকে সাহায্য করে। বছরের শুরুতে ক্ষুধার্ত নেকড়েরা নিজেদের ডেরা ছেড়ে বেড়িয়ে এসে ডাকাডাকি করে। নেকড়ের ডাক কখনো উঁচুতে ওঠে, কখনো বা নিচে নামে, কখনো একই লয়ে চলতে থাকে।
পৌরাণিক নেকড়ে মানব যা লাইকানথ্রপ নামেও পরিচিত (গ্রিক λυκάνθρωπος থেকে: λύκος, lykos, “নেকড়ে”, এবং ἄνθρωπος, anthrōpos, “মানুষ”)। সে ইচ্ছা করলে বা অভিশাপের কারণে নেকড়েতে বা নেকড়ের মত জীবে পরিণত হয়। কোন কোন অঞ্চলে এরা ‘মায়া নেকড়ে’ নামেই পরিচিত। এক্ষেত্রে দিনের আলোয় স্বাভাবিক মানুষ হলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মায়া নেকড়ে পালটে যায়। রাতের গভীরতা যত বাড়ে ততই সে নিরীহ মানুষের খোলস পাল্টে হয়ে ওঠে হিংস্র নেকড়ে। সামনে যা পায় তাই সে তীক্ষ্ম নখ আর ধারালো দাঁত দিয়ে ফালা ফালা করে ফেলে। ভোর হলে সে আবার শরীরে ও আচরণে যে কে সেই হয়ে যায়। ইউরোপের নেকড়ে অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মায়া নেকড়ে নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত আছে, যেমন ইংরেজি আদি মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’-এ। গ্রিক রূপকথায় দেখি গ্রিক দেবতা জিউসের অভিশাপে লাইসিয়ান নামক এক ব্যক্তি নেকড়েতে পরিণত হয়েছিল কারণ লাইসিয়ান জিউসকে মরা মানুষের দেহ দিয়ে খাবার তৈরি করে খাইয়েছিলেন। নরওয়ের লোকগাথায় এক পিতা এবং সন্তান দু’জনেই এমন একটি নেকড়ের চামড়া তৈরি করেছিল যা গায়ে জড়ালে তারা নেকড়েতে পরিণত হতো। ১৫২১ সালে ফ্রান্সের পায়ার বারগট এবং মাইকেল ভারদুন নামক দুই মায়া নেকড়ে একের পর এক নারী-পুরুষ এবং পোষা প্রাণী হত্যা করতে থাকে। অবশেষে তারা ধরা পড়ে। শাস্তি হিসেবে তাদের দু’জনকেই আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় যাতে তাদের পুনর্জন্ম না হয়। ১৫ শতকে জার্মান লোকগাথা অনুসারে পিটার স্টব নামক এক ব্যক্তি নির্বিচারে মানুষ ও অন্য প্রাণীদের হত্যা করতে থাকে। ধরা পড়লে তাকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।
বিজ্ঞান বলছে মানুষের এই নেকড়ে হিসেবে দাবি করাটা এক ধরনের হরমোনের তারতম্যজনিত রোগ। রোগটির নাম হাইপারট্রিকোসিস বা ওয়্যার উলফ সিন্ড্রোম। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে অস্বাভাবিকভাবে চুল গজাতে থাকে। ফলে সে ধীরে ধীরে অনেকটা নেকড়ের মত হয়ে যায়। এছাড়া তার শরীরে নেকড়ের অন্য কোনো উপসর্গ থাকে না। প্রাচীনকালে এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়েই হয়তো মায়া নেকড়ের এমন কাল্পনিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। বেশ কিছু বছর আগে এক বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল- ‘নেকড়ে মানুষ বা নেকড়ে নারী চাই’। শর্ত ছিল মাথা থেকে শুরু করে গোটা মুখ ঢাকা থাকতে হবে লোমে। আর সার্কাসে খেলা দেখানোর দক্ষতা থাকতে হবে। কাজের শর্ত হিসাবে যেতে হবে যে কোনও জায়গায়। ব্রিটিশ সরকারের চাকরির ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছিল এই অদ্ভুত বিজ্ঞাপন। মুখ সহ সারা শরীরে অস্বাভাবিক লোম বা হাইপারট্রিকোসিসে আক্রান্ত এক মেক্সিকান যুবক ছিল জেসাস অ্যাসিভেস। আর এ জন্যই তিনি ব্রিটেনের সার্কাস অফ হররে কাজ পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার অভিবাসন আইনে কড়াকড়ি করে বলে চাকরির ক্ষেত্রে সব সংস্থাকে বিদেশিদের বদলে দেশের নাগরিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাধ্য হয়ে সার্কাস অফ হরর সরকারি ওয়েবসাইটের দ্বারস্থ হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের জব সাইটে তাই দেখা গিছল ওই অদ্ভুত বিজ্ঞাপন। ইন্টারভিউতে অ্যাসিভেস বলেছেন- “বিশ্বে আমার মতো মানুষের সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ। ইংল্যান্ডে যদি আমার মতো দেখতে কেউ থাকেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তিনিই এই চাকরিটা পাবেন। সকলেরই তো কাজের দরকার”।
ভারতে এমনকি আমাদের বাংলাতেও এরকম নেকড়ে মানব-মানবীর ঘটনা শোনা যায়। ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ‘ফেরাল চাইল্ড’। ১৮৯৪ সালে লেখা ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর বিখ্যাত চরিত্র মোগলির কথা সকলেরই মনে আছে নিশ্চই। গভীর বনে একটি নেকড়ে পরিবারের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছিল মা-বাবাহারা এই শিশুটি? মোগলিদের বাড়ি ছিল জঙ্গলের পাশের গ্রামে। শের খান নামে এক বাঘ তার বাবাকে খেয়ে ফেলে। মোগলিকেও ছেড়ে দিত না। কিন্তু মোগলির বাবা মৃত্যুর আগে লাল ফুল ফুটিয়ে যান, আগুন জ্বেলে সেই কাঠ নিয়ে শের খানকে আক্রমণ করেন। শের খান পালিয়ে যায়। বাঘেরা নামে এক ব্ল্যাক প্যান্থার মোগলিকে জঙ্গলে নিয়ে আসে, নেকড়েরা তাকে প্রতিপালন করে। বালু নামে এক ভালুকের সঙ্গে মোগলির বন্ধুত্ব হয়, সবাই মিলে শের খানের সন্ত্রাস থেকে জঙ্গলকে বাঁচায়। কিপলিং-এর মোগলি পরে বড় হয়ে যায়, গ্রামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে। এখানে ক্লাইম্যাক্সে দাবানলে পুড়ে শের খানের মৃত্যু। বালু আর বাঘেরার সঙ্গে গাছে বসে থাকে মোগলি। মানুষের গ্রামে যাবে না সে, জঙ্গলকে বাঁচাবে। দূষণ আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর এটা একটা মেসেজও বটে!
নেকড়ে-মানুষ: ‘মোগলি: লেজেন্ড অব দ্য জাঙ্গল’ (২০১৮) ছবির দৃশ্য
মোগলি চরিত্রটি লেখকের নিছক কল্পনা হলেও বাস্তব পৃথিবীর অনেক গল্প মাঝেমধ্যে কল্পনাকেও হার মানায়। সভ্যতা থেকে ছিটকে গিয়ে, বনমানুষ বা পাখি বা নেকড়ের পালের মধ্যে বড় হওয়া মানবসন্তানের খবর এখনও কাগজে বেরোয় মাঝেসাঝে। লোকগাথা ও সাহিত্যের নেকড়ে মানবরা খবরে উঠে এসেছে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই। ১৬৪৪ সালে বেলজিয়ামের জঙ্গলে এক যুবককে পাওয়া গিয়েছিল যার নাম দেওয়া হয়েছল ‘জন’। সে চার বছর বয়েসে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল। ১৭২৫ সালে পাঁচ বছরের বালক পিটারকে উত্তর জার্মানির জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল। ১৭৩১ সালে কিশোরী মেরিকে ফ্রান্সের জঙ্গলে পাওয়া গেছিল। ১৮০০ সালে বারো বছরের ভিক্টরকে ফ্রান্সের অ্যাভেরনের জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল। এদের সবাইকে নগ্ন বা অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, আর এরা পশুদের মত ব্যবহার করত। অনেক খুঁজেও এদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ১৮৬৭ সালে নাকি এক দল শিকারী উত্তরপ্রদেশের সিকান্দ্রায় (আগ্রার কাছাকাছি) এক গভীর বনে এক পাল নেকড়ের সঙ্গে চার পায়ে দৌড়োনো একটা মানুষের ছেলেকে দেখতে পান! তাঁদের দেখেই পশুর পাল পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে পড়ে। তখন গুহার বাইরে গনগনে আগুন জ্বালালেন শিকারীরা। ধোঁয়ার চোটে পশুগুলো বাইরে আসতেই, শিকারীরা সব ক’টা নেকড়েকে গুলি করে মারলেন। আর ধরে আনলেন নেকড়ে-বালককে। ভীষণ আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছিল সে, দু্র্বোধ্য শব্দ বের করছিল মুখ দিয়ে। তাকে ধরেবেঁধে নিয়ে যায় শিকারীরার। বছর ছয়েকের সেই শিশুর ঠাঁই হল মিশনারিদের এতিমখানায়। তার নাম দেওয়া হল ‘দিনা শনিচর’, বোধহয় শনিবার তাকে ধরা হয়েছিল বা ওই অনাথ আশ্রমে আনা হয়েছিল তাই। সেখানে শনিচরকে দু’পায়ে চলতে শেখানো হলেও সে নুয়ে নুয়েই হাঁটত। সে শুঁকে শুঁকে মাংস খেত, জামাকাপড় পরতে চাইত না আর রাস্তায় পাথরে ওপর উপুড় হয়ে পড়ে দাঁত ঘষে ধারালো করত। হাতের তালু ও পায়ের তলা পশুদের মতোই শক্ত। সে দিনের বেলায় ঘুমাতো ও সারা রাত চার হাত পায়ে ঘুরে বেড়াতো। মানুষের ভাষা কিছুতেই সে বলতে পারত না, মুখ দিয়ে কেবল ফ্যাঁসফ্যাঁস বা ঘড়ঘড় জান্তব আওয়াজ করত। খ্যাঁকখ্যাঁক, গোঁগোঁ, দাঁত কিড়মিড় এই সবই সে করতে পারত। আর রাতবিরেতে বুকের রক্ত জল করা নেকড়ের ডাকও ডাকত। তাই তাকে সবাই নেকড়ের বাচ্চা বলেই ডাকত। তবে বন থেকে ধরে আনা আর একটি বাচ্চার সঙ্গে তার খানিক ভাব জন্মেছিল। কারণ, সে তাকে কাপে করে খেতে শিখিয়েছিল। দুই পায়ে হাঁটতে শিখেছিল, পোশাক পরে থাকতে শিখেছিল, মানুষের ভাষা বুঝতে শিখেছিল; কিন্তু কথা বলতে শেখে নি।
মানুষের সংস্পর্শে একটাই স্বভাব দারুণ রপ্ত করেছিল সে। সেটা হল অনর্গল ধূমপান করা। ১৮৯৫ সালে সে যক্ষ্মা হয়ে মারা গিয়েছিল। তার বয়স তখন মাত্র ৩৪ বছর।
এরপর বলব বিবিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গল্প। গল্পটি সত্যিকারের এক মোগলির- স্পেনের ষাটোর্ধ্ব মারকোস রদ্রিগেজ প্যানতোহার। নিতান্ত শিশু বয়সে গভীর বনে গিয়ে নেকড়ে, সাপ ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গী বনে যান তিনি। কাটিয়ে দেন প্রায় এক যুগ। মারকোসের জবানিতে জানা গেছে, তাঁর বয়স তখন ছয় কি সাত। একদিন অর্থকষ্টে পড়ে তাঁর বাবা এক কৃষকের কাছে মারকোসকে বিক্রি করে দেন। ওই কৃষক তাঁকে সিয়েরা মোরেনা পাহাড়ে নিয়ে যান। মারকোসের কাজ ছিল ওই কৃষকের সঙ্গে তাঁর ছাগলের পাল চরানো। তবে কিছুদিন পর ওই বৃদ্ধ কৃষক মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুর পর পাহাড়ের গভীর অরণ্যে পালিয়ে যান মারকোস।
রাখালের কাজ করতে গিয়ে এরই মধ্যে মারকোস শিখে গেছেন কীভাবে ফাঁদ পেতে খরগোশ বা তিতির পাখি ধরতে হয়। তাই বনে থাকার দিনগুলোতে খাবারের অভাব হয়নি তাঁর। জনমানবশূন্য বনে নিঃসঙ্গ মারকোসের সঙ্গে দ্রুত পশুপাখির এক অদ্ভুত সখ্যতা গড়ে ওঠে।
একদিনের ঘটনা, মারকোস একটি গুহার ভেতর কিছু নেকড়ে ছানার সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠেন। খেলতে খেলতে গুহার ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। খানিক পর বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে গুহায় ঢোকে নেকড়ে মা। ঘুম ভাঙার পর মারকোস দেখেন, নেকড়ে মা হিংস্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। নেকড়ে শাবকগুলো মহা আনন্দে মাংসের টুকরো খাচ্ছিল। ক্ষুধার্ত মারকোস পাশে থাকা একটি নেকড়ে শিশুর খাবার চুরি করার চেষ্টা করলে মা নেকড়ে থাবা দিয়ে মারকোসকে সরিয়ে দেয়। শিশুদের খাওয়া শেষ হলে মা নেকড়ে মারকোসের দিকে এক টুকরো মাংস ছুড়ে দেয়। প্রথমে মারকোস ভয়ে তা স্পর্শ করেননি। তা দেখতে পেয়ে নেকড়ে মা নাক দিয়ে মাংসের টুকরোটি আবারও তার দিকে ঠেলে দেয়। মারকোস ভয়ে ভয়ে মাংসের টুকরোটি তুলে নিয়ে খেতে শুরু করেন। এ সময় নেকড়ে মা তার জিভ দিয়ে মারকোসকে আদর করে দেয়। এভাবে মারকোস ওই নেকড়ে পরিবারটির একজন সদস্য হয়ে ওঠে।
১৯৬৫ সালে ১৯ বছর বয়সী মারকোসকে সিয়েরা মোরেনার গভীর অরণ্য থেকে উদ্ধার করে স্পেনের পুলিশ। দীর্ঘদিন বনে থাকার কারণে মানবসমাজের রীতিনীতি, সভ্যতা-ভব্যতা শিখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে মারকোসকে। নাপিতের দোকানে চুল কাটতে নিয়ে যাওয়া হলে মারকোস ভেবেছিলেন, নাপিত বুঝি তাঁর গলাটাই কেটে দেবে। প্রথম যেদিন খাবার টেবিলে বসিয়ে এক বাটি স্যুপ তার সামনে রাখা হলো, তখন বাটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছিলেন মারকোস। কিছু বুঝতে না পেরে বাটিটির ভেতর তিনি যেই হাত চোবালেন, অমনি গরম স্যুপের তাপে তার হাত ঝলসে যায়। মুহূর্তে বাটিটি হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মাদ্রিদে এক নান তাঁকে বিছানায় ঘুমানোর বিষয়টি শেখাতে চাইলে তাঁর সঙ্গে রীতিমতো কুস্তি লেগে যায়। দীর্ঘদিন বনে থাকার কারণে মানবসমাজের রীতিনীতি, সভ্যতা-ভব্যতা শিখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে মারকোসকে। শুরুর দিকে রাস্তা পার হতে খুব ভয় পেতেন মারকোস। চারপাশের শব্দ, মানুষের হট্টগোলের সঙ্গে আজও অভ্যস্ত হতে পারেননি তিনি। সোজা হয়ে হাঁটতে শেখানোর জন্য মারকোসের পিঠে কাঠের টুকরো বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে এসব শিখে নিয়েছেন মারকোস। স্পেনের রানতে অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রামে ১৫ বছর ধরে বাস করছেন তিনি। সেখানকার বাসিন্দারা তাঁকে খুব পছন্দ করেন। বিগত বছরগুলোতে পিয়ানো ও গিটার বাজাতে শিখেছেন মারকোস। গ্রামের একটি ছোট্ট বারে এগুলো বাজিয়ে মাঝেমধ্যে গ্রামবাসীদের আনন্দ দেন। এখনকার জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এমনকি তাঁর বেশ কয়েকজন বান্ধবীও হয়েছিল, তবে পরে সেসব সম্পর্ক কেটে যায়। ২০১০ সালে স্প্যানিশ-জার্মান ছবিতে রদ্রিগেজের গল্প চিত্রিত হয়েছিল এন্ট্রেলবোস।
শেষ করব বাংলার কাহিনী দিয়ে। ১৯২০ সালে, ময়ূরভঞ্জের কাছে মেদিনীপুর জঙ্গলের একটি গুহায়, একটি ধর্মপ্রচারক দম্পতি দু’টি মেয়ে শিশুকে কিছু প্রাপ্তবয়স্ক নেকড়ে এবং দু’টি ছানার সংগে খুঁজে পান ও উদ্ধার করেন। মেয়েরা ছিল মানুষের মত দেখতে, কিন্তু ব্যবহারে নেকড়ের মত। তারা চারপায়ে চলাফেরা করত, কাঁচা মাংস খেতো এবং নেকড়েরা যখন রাতে কম-বেশি নির্দিষ্ট সময়ে চিৎকার করত তাতে তারাও যোগ দিত। তাদের নাম ছিল অমলা ও কমলা। সে সময় কমলার মানসিক অবস্থা ছিল ছয় মাসের শিশুর মতন। অমলা কয়েক মাসের মধ্যে মারা যায়। কমলা অবশ্য ১৯২৯ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিল। অমলার মৃত্যুর পর, কমলা বেশ কয়েক দিন খাবার স্পর্শ করেননি, অমলা যে বিছানায় ঘুমোতো সেখানে সে শুঁকতো। সে হাত এবং হাঁটু ব্যবহার করেই হাঁটত. গতির জন্য হাঁটুর পরিবর্তে পায়ের আঙ্গুল ব্যবহার করত। দু’ই পেয়ে মানুষের চেয়ে চার অঙ্গে কমলার গতি ছিল অনেক ভালো। কমলা শাকসবজি ফেলে, কাঁচা মাংস এবং হাড় চিবিয়ে খেত। কমলা প্রায় ১৭ বছর বয়সে মারা যায়। তবে তার মৃত্যুর আগে, সে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারত, সোজা হয়ে দাঁড়াত পারত এবং তার হাত দিয়ে খেতে পারত। আসলে কোন নেকড়ে মানব-মানবীই বেশি দিন বাঁচে না, নিঃশেষ হয়ে যায় অকালে।
রেভারেন্ড জে এ এল সিং এই ঘটনাটির কথা তাঁর ডায়েরীতে বিস্তারিত লিখেছেন-
আমরা, আমাদের মিশনারি ট্যুরে, মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল এলাকার সবচেয়ে ঘন অংশে গিয়েছিলাম এবং মানুষের বাসস্থানের সন্ধানে ময়ূরভঞ্জ রাজ অঞ্চল দখল করেছিলাম। এই সময় আমরা মেদিনীপুর এবং ময়ূরভঞ্জের সীমান্তবর্তী গোদামুরি নামে একটি গ্রামে গিয়ে আমরা এক গ্রামবাসীর গোয়ালঘরে আশ্রয় নিলাম। লোকটির নাম ছিল চুনারেম এবং জাতিগতভাবে সে ছিল কোরা (ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে একটি)। রাত্রে লোকটি আমাদের কাছে এসে খুব ভয়ে ভয়ে কাছের জঙ্গলে একজন মানুষ-বাঘা বা মানুষ-ভূতের খবর দিল। সে ছিল ভূতের ভয়ঙ্কর মাথাওয়ালা মানুষের মতো। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল যে এটি সন্ধ্যার সময় দেখা যায়। তিনি যে স্থানটির উল্লেখ করলেন সেটি গ্রাম থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে ছিল। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আমাকে এই মানুষ-বাঘার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কারণ তারা এই প্রাণীটিকে মারাত্মকভাবে ভয় করত।
সেপ্টেম্বর ২৪, ১৯২০
আমি কৌতূহলী হয়ে সেই ভূত দেখতে চাইলাম। আমরা ওই দিন (শুক্রবার) সন্ধ্যার একটু আগে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু তার কোনো চিহ্ন দেখতে ব্যর্থ হলাম। আমি ভেবেছিলাম সব মিথ্যা গুজব এবং খুব একটা পাত্তা দিইনি। দ্বিতীয়বার চুনারেমরা একই গল্প আমার কাছে অত্যন্ত শঙ্কা ও উদ্বেগের সাথে পুনরাবৃত্তি করল। তারা এতটাই ভয় পেয়েছিল যে আমরা এলাকা থেকে ভূত দূর করার জন্য কিছু না করলে তারা সেই জায়গাটি পরিত্যাগ করে চলে যেতে চেয়েছিল। আমি একটি পরিকল্পনার কথা ভেবেছিলাম এবং সেই অনুযায়ী তাদের পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমি তাদের কাছাকাছি একটা বড় গাছ দেখালাম, যেখানে ভূতের থাকার কথা ছিল সেখান থেকে প্রায় একশ গজ বা তারও বেশি দূরে। আমি তাদের সেই গাছে একটি শুটিং মাচান (একটি উঁচু প্ল্যাটফর্ম যেখান থেকে বন্য প্রাণীদের গুলি করা যায়) প্রস্তুত করতে বলেছিলাম, যাতে আমরা মাচানে চড়ে গোপনে ভূতটিকে দেখতে পাই যখনই সে তার ডেরা থেকে বেরিয়ে আসে।
এরপর আমি ৩রা অক্টোবর, ১৯২০, রবিবার খড়্গপুরের রেলওয়ে কলোনির মিস্টার রোজের কাছ থেকে একটি ফিল্ড গ্লাস ধার করে নিয়ে আসে। তারপর সব গুছিয়ে ৫ই অক্টোবর মেসার্স পি. রোজ, হেনরি রিচার্ডস, জানু টুডু, এদের সাথে ময়ূরভঞ্জ সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। করণ হাঁসদা ও জানু টুডু জঙ্গলে আমাদের পথ প্রদর্শক ছিল।
৮ই অক্টোবর, ১৯২০
আমরা ৮ই অক্টোবর গোদামুড়িতে পৌঁছে চুনারেমের সাথে সেখানে থাকলাম। ৯ তারিখ খুব ভোরে আমরা মাচান দেখতে বের হলাম এবং তথাকথিত ভূতের আড্ডা পরীক্ষা করলাম। সেখানে একটি দোতলা বাড়ির মতো উঁচু একটি উইপোকার ঢিবি ছিল, যা মাটি থেকে মন্দিরের মত আকার হয়ে উঠেছিল। তার চারপাশে সাতটি গর্ত ছিল, পরে ঢিবির নীচে মূল গর্তের দিকে নিয়ে যাওয়া সাতটি সুড়ঙ্গ পাওয়া গিছল। এই ঢিবির কাছে একটা উপপথ ছিল। গ্রামবাসীরা এই পথ দিয়ে যাতায়াত করত। জ্বালানী, কাঠকয়লা এবং পাতা সংগ্রহের জন্য জঙ্গলের মধ্যে যাতায়াত করত, তারপর সেগুলো তারা হাটে বিক্রি করত, ক্ষেতে তাদের কাজ শেষ হওয়ার পরে এবং তারা তাদের ফসল সংগ্রহ করার পরে এইসব করত। এমন হয়েছিল যে কখনও কখনও ভোরবেলা এবং কখনও কখনও সন্ধ্যার সময় তারা এই বাঘাভূতদের দেখা পেত। পাছে তারা আক্রমণ করে সেই ভয়ে তারা সেই পথটি দিয়ে যাতায়াত একেবারে ছেড়ে দিয়েছিল এবং ভয়ানক ভয়ে দিন কাটাচ্ছিল, এতটাই ভয় তারা পেয়েছিল যে তারা সেই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছিল। এই সময় তারা আমাদের দেখা পেয়ে ভেবেছিল যে আমরা যদি বন্দুকের গুলিতে ভূতকে মেরে ফেলতে পারি তাহলে তাদের সমস্ত ভয়ের অবসান ঘটতে পারে।
৯ই অক্টোবর, ১৯২০
শনিবার সন্ধ্যার অনেক আগে, বিকাল প্রায় ৪.৩০ বা ৫টা নাগাদ আমরা চুপিচুপি মাচানে চড়লাম এবং উদ্বিগ্নভাবে সেখানে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর হঠাৎ করেই, একটি প্রাপ্তবয়স্ক নেকড়ে একটি গর্ত থেকে বেরিয়ে এল, যা তাদের ক্রমাগত বের হওয়া এবং প্রবেশের কারণে খুব মসৃণ ছিল। এরপর একই আকার এবং ধরণের আরেকটি নেকড়ে বেরিয়ে এল, তার পেছনে তৃতীয়টি বাইরে এল, সবশেষে দু’টি শাবক ঘনিষ্ঠভাবে তাদের অনুসরণ করল। গর্তটার পরিধি দু’টি নেকড়ে একসঙ্গে বেরোবার মত বড় ছিল না।
শাবকগুলোর পরেই আবির্ভূত হল সেই ভূত মানুষ বাঘা। তার হাত, পা এবং মানুষের মতো শরীর থাকলেও মাথাটি ছিল একটি বড় বলের মত যা কাঁধ এবং বুকের ওপরের অংশকে ঢেকে রেখেছিল, শুধুমাত্র মুখটা দৃশ্যমান ছিল এবং সেটি ছিল মানুষের। তার পায়েপায়েই আরেকটি ভয়ঙ্কর প্রাণী বেরিয়ে এল, হুবহু প্রথমটির মতো দেখতে, কিন্তু আকারে ছোট। তাদের চোখ ছিল উজ্জ্বল এবং তীক্ষ্ণ, মানুষের চোখের মত নয়। আমি তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে এরা মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথম ভূতটি তার আবক্ষ দেহ পর্যন্ত মাটিতে আবির্ভূত হয়েছিল এবং গর্তের কিনারায় তার কনুই রেখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে শাবকদের অনুসরণ করল এর পরে একই ধরণের আরেকটি ছোট ভূত একই রকম ভাবে ছুটল চারপায়ে।
আমার বন্ধুরা ভূতের দিকে গুলি করার জন্য তাদের বন্দুক তাগ করল। আমি যদি তাদেরকে নিরুৎসাহিত না করতাম তবে তারা তাদের হত্যা করত। আমি তাদের ব্যারেল চেপে ধরলাম এবং ফিল্ডগ্লাসটি মেসার্স রোজ এবং রিচার্ডসকে দিলাম এবং বললাম যে আমি নিশ্চিত যে এই ভূতগুলি মানব সন্তান। সেই কাঁচ দিয়ে দেখে মাচানে উপস্থিত সবাই আমার সাথে একমত হল, শুধু চুনারেম ছাড়া। সে তখনও তার বিশ্বাসে অটল যে তারা মানুষ নয়, মানুষ-বাঘা। আমরা সবাই চুনারেমের সাথে একমত না হয়ে মাচান থেকে নেমে আসি। যখন আমরা চুনার গোয়ালঘরে আমাদের আশ্রয়ে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ৮টা।
অক্টোবর ১০, ১৯২০
পরের দিনও আমরা আবার নেকড়ে এবং ভূতদের দেখতে পাই। রাতে খাওয়ার পর আমরা চুনারকে ডেকে বললাম যে আমরা পরের দিন সেই বাচ্চাদের ধরতে উইপোকার ঢিবি খনন করতে চাই এবং সম্ভব হলে তাদের ধরে ফেলতে চাই। আমরা তাকে কিছু লোক লাগিয়ে আমাদের জন্য জায়গা খনন করতে বলেছিলাম এবং সেজন্য তাদের ভালো অর্থ প্রদান করব একথাও বলেছিলাম। কিন্তু চুনার স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলল, “না, স্যার, আমরা তা করতে পারি না। আপনারা সবাই এখানে শুধুমাত্র একটি দিনের জন্য এসেছেন, কিন্তু আমাদের এখানে থাকতে হবে। আপনারা যখন চলে যাবেন তখন এই মানুষ-বাঘারা আমাদের আক্রমণ করে হত্যা করবে। আমরা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম। যাই হোক, আমরা বিষয়টিকে নিয়ে আর চাপ দিইনি, কারণ আমি জানতাম কী করতে হবে এবং তাই আমি বিষয়টি পুরোপুরি চেপে গেলাম।
১১ই অক্টোবর, ১৯২০
আমি আমার বন্ধুদের সাথে সেই রাতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে দূরবর্তী গ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম এবং কিছু লোকও জোগাড় করলাম যারা আমাদের অনুসন্ধান সম্পর্কে কিছুই জানত না। তারা সবাই একমত হল এবং আমরা আমাদের সফর শুরু করলাম আমরা প্রায় তপোবনের কাছাকাছি একটি দূর গ্রামে এলাম. সেখানকার মানুষ ওই ভূতবাঘা সম্পর্কে কিছুই জানত না। এখানে আমি গ্রামবাসীদের সাথে জঙ্গলে উইঢিবির মধ্যে মন্দিরের দরজার মতো একটি দরজা কেটে আমাদের জন্য একটা কাজ করার জন্য বলেছিলাম। আমি তাদের দৈনিক মজুরি এবং কাজের জন্য পুরস্কারের টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম। তারা রাজি হয়ে গেল এবং আমরা পরের দিন সোজা নেকড়েদের আড্ডায় ফিরে যাই। সেখানে বসবাসকারী ভূতের ব্যাপারে আমরা কেউ তাদের কিছু বলিনি।
গোদামুড়ি গ্রাম থেকে সাত মাইল দূরে জঙ্গলে ওই ঢিবি ছিল। আমরা লোকজনদের সরাসরি ঘটনাস্থলে নিয়ে এসেছি; আমাদের মধ্যে অর্ধেক মাচানে চড়েছিলাম, কিন্তু আমি শ্রমিকদের সাথেই রয়ে গিছলাম কাজের তদারকি ক্রার জন্য। আমি স্পষ্টভাবে আমার বন্ধুদের বলে দিয়েছিলাম কোনো কারণেই গুলি না করতে।
১৭ই অক্টোবর, ১৯২০
রবিবার। কোদাল এবং বেলচার কয়েক আঘাতে একটি নেকড়ে দ্রুত বেরিয়ে এসে তার জীবন বাঁচাতে দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। দ্বিতীয়টিও বেরিয়ে দ্রুত আগের নেকড়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করল। এবার তৃতীয়জন হাজির। এটি বিদ্যুত গতিতে গর্তের ভেতরে ঢুকে গেল বটে কিন্তু খননকারীদের তাড়া করতে অবিলম্বে বেরিয়ে এল- চিৎকার করে, অস্থিরভাবে দৌড়ে, প্রচণ্ডভাবে মাটি আঁচড়ে এবং দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগল। এটা জায়গা থেকে নড়বে না মনে হল। এটিকে ধরার জন্য আমার খুব ইচ্ছে করছিল, কারণ আমি ঘটনাস্থলেই এটির আচার-আচরণ দেখে অনুমান করেছিলাম যে এটি অবশ্যই মা নেকড়ে, যার প্রকৃতি এত হিংস্র এবং আদর্শ মায়ের সমস্ত ভালবাসা এবং স্নেহ উজার করে দিয়েছিল অন্য দু’টি মানুষ-নেকড়ের জন্য যারা অবশ্যই তার শাবক ছিল। তাই তাদের বাঁচিয়ে রেখে লালন-পালন করা এক ঐশ্বরিক চেতনা। আমি পরিস্থিতির চাপে বোবা ও জড় হয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে, আমার লোকেরা তাকে তীর দিয়ে বিদ্ধ করল এবং সে মারা গেল। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য!
মা নেকড়ে মারা যাওয়ার পর, কাজটা সহজ হয়ে গিছল। যখন দরজাটি কেটে দেওয়া হল, তখন পুরো উইঢিবিটি ভেঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গিছল, খুব সৌভাগ্যবশত কেন্দ্রীয় গুহাটি খোলা ছিল। গুহাটি একটি কেটলির নীচের মত ফাঁপা ছিল, সরল এবং মসৃণ, যেন সিমেন্ট করা। জায়গাটা এতটাই পরিপাটি ছিল যে কোথাও একটা হাড়ের টুকরোও দেখা যাচ্ছিল না, তাদের মলমুত্র এবং অন্যান্য অপরিচ্ছন্নতার কোনো প্রমাণ ছিল না। গুহাটির একটি অদ্ভুত গন্ধ ছিল, যা নেকড়েদের মতই অদ্ভুত।
এখানেই বাস করত নেকড়ে পরিবার। দু’টি শাবক এবং অন্য দু’টি ভয়ঙ্কর প্রাণী তখন সেখানে এক কোণে বসেছিল, চারজনেই একসাথে আঁকড়ে জড়াজড়ি করেছিল। তাদের একে অপরের থেকে আলাদা করা সত্যিই খুব শক্ত কাজ ছিল। ভূতেরা শাবকদের চেয়েও হিংস্র ছিল, মুখ ব্যাদান করে দাঁত খিঁচিয়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে পেছনে ছুটে যাচ্ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী করব।
আমি একটা যন্ত্রের কথা ভাবলাম। আমি আমার লোকদের কাছ থেকে চারটি বড় চাদর সংগ্রহ করলাম, যেগুলো ওই অঞ্চলে গিলাপ (গ্রামবাসীদের শীতের গায়ের চাপা) বলা হয়। আমি বাচ্চাদের এবং শাবকদের ওপর একটি চাদর ছুঁড়ে ফেললাম এবং একটিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিলাম। এইভাবে আমরা তাদের সবাইকে আলাদা করেছিলাম, প্রত্যেককে একটি চাদরে বেঁধে রেখেছিলাম, শুধুমাত্র মাথাটি মুক্ত রেখেছিলাম। আমরা খননকারীদের হাতে নেকড়ে শাবকগুলো তুলে দিলাম এবং তাদের মজু্রিও দিয়ে দিলাম। তারা খুশি হয়ে চলে গেল এবং ভালো দামে বাচ্চাগুলোকে হাটে বিক্রি করল।
আমি দুটি মানব শিশুর দায়িত্ব নিলাম, এবং গোদামুড়িতে চুনারের বাড়িতে ফিরে এলাম। আমি তাকে অনুরোধ করলাম এই শিশুদের প্রতি নজর রাখতে। আমি তাদের তার উঠানের এক কোণে একটি ব্যারিকেডের মধ্যে রেখেছিলাম, লম্বা শাল খুঁটি দিয়ে তৈরি ছিল সেটা যাতে বন্দীরা বের হতে না পারে। ব্যারিকেডের ক্ষেত্রফল ছিল আট ফুট বাই আট ফুট। ব্যারিকেডের পাশে চাল ও জলের জন্য দু’টি ছোট মাটির পাত্র রাখা ছিল, যাতে রক্ষকরা বাইরে থেকে তাদের খাবার ও পানীয় ঢেলে দিতে পারে। চুনার আমার ফিরে আসা পর্যন্ত তাদের রাখতে রাজি হল।
১৮ই অক্টোবর, ১৯২০
আমি আঠারোই অক্টোবর সোমবার গোদামুড়ি ত্যাগ করি এবং আমার ট্যুর প্রোগ্রাম শেষ করতে চলে যাই। আমার বন্ধুরা খড়্গপুর ফিরে গেল। গোদামুড়ি ফিরতে আমার পাঁচ দিন লেগেছিল।
২৩শে অক্টোবর, ১৯২০
আমি শনিবার, অক্টোবরের তেইশ তারিখে ফিরে এসেছি। ফেরার পথে গোদামুড়ির কাছে এসে বাচ্চাদের করুণ অবস্থার কথা জানলাম। কোন খাবার বা পানীয় ছাড়াই তাদের ওই বন্দীশালায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। চুনারের উঠানে ভূতেদের অবস্থান তার এবং পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমরা চলে যাবার পরপরই ওরা খুব তাড়াহুড়ো করে জায়গাটা ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল যে কেউ জানত না। আতঙ্ক এতটাই ছিল যে পুরো গ্রামটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।
আমি পরিস্থিতি খুব গুরুতর বলে মনে করে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিনি বা কোন চিন্তাও করিনি, তবে সাথে সাথে ব্যারিকেড তৈরি করে রাখা শাল খুঁটি ভেঙে ফেলে বাচ্চাদের শুয়ে থাকতে দেখতে পাই, ক্ষুধার জ্বালায়, তৃষ্ণা এবং ভয়ে হাঁপাচ্ছে ওরা। আমি সত্যিই তাদের জন্য খুব দুঃখ পেলাম এবং আসলে আমার অবহেলার জন্য কেঁদেও ফেললাম। আমি তাদের মুখে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দিলাম। তারা মুখ খুলল; আমি জল ঢালাতে লাগলাম এবং তারা পান করতে লাগল। আমি এক এক করে তাদের কোলে তুলে গরুর গাড়িতে নিয়ে গেলাম। আমি তাদের গরম চা খাওয়ানোর চেষ্টাও করলাম।
খাওয়ানোর সমস্যা ছিল। তারা মুখে কিছুই তুলবে না। আমি আমার রুমাল ছিঁড়ে একটি বাতির ওপরে দিয়ে চায়ের কাপে ডুবিয়ে দিলাম; এবং যখন সেটি ভালভাবে ভিজে গেল, তখন আমি তাদের মুখে এক প্রান্ত রাখলাম এবং অন্য প্রান্তটি কাপে রইল। আমি তাদের একটি শিশুর মত বাতি চোষা দেখতে দেখতে ঈশ্বরকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানালাম তাঁর অপার করুণার জন্য, আমার শিশুদেরকে অবহেলা করার অপরাধ ক্ষমা করার জন্য বহুবার আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।
আমি কয়েকদিন গোদামুড়িতে থেকে গেলাম বাচ্চাদের লালন-পালন এবং খাওয়ানোর জন্য কারণ গরুর গাড়িতে চড়ে মেদিনীপুরে পৌঁছানোর জন্য পঁচাত্তর মাইল পথের মধ্যে বেশ ঝাঁকুনি ছিল। আমি তাদের শুধুমাত্র কাঁচা দুধ খেতে দিতাম এবং দেখলাম তারা খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করছে। যখন আমি তাদের সুস্থভাবে যাত্রার ধকল সহ্য করার মত অবস্থায় দেখলাম, তখন আমি ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
ক্রমশঃ…