কৃ ষ্ণা মা লি ক-র হাট দর্শন
হাটের মানুষ বাটের মানুষ(১ম পর্ব)
কোপাই নদীর এক পাড়ে মহাশ্মশান। অন্যপারে এক বাউলের গলায় মানবদেহের অসারতার দর্শন লালনগানে মুখর হয়ে উঠছিল। কী তীব্র আর্তি সেই গানে। গনগনে দুপুরটিও সজল হয়ে উঠছিল আমার দেহমনের অনুভবে। লালনের সেই গান, মনের হলো মতি মন্দ, তাইতে হলাম জন্মঅন্ধ–
আজ সকাল থেকে গুনগুন করে উঠছে মনের ভেতর গানের লাইনগুলো। এক একদিন হয় না, কোনো গান পেয়ে বসে সারাদিনের জন্য? আজ লালন ফকির আমায় ভর করেছেন, নাকি সেই শ্মশানের দিকে অর্ধ নিমীলিত চোখে নিরাসক্ত বাউলটি, তা বলতে পারব না।
বলতে বসেছি হাটের কথা। হাটের মানুষের কথা।আর মনে এলো লালনের গান! তাতে কি মহোদয়/মহোদয়া? সবই তো এক তারে বাঁধা। হাট আর বাউল ভিন্ন নয়। পরস্পর যেন পরস্পরের ছায়া। হাট তার কোল পেতে দিয়ে বাউলকে আসর জাগনের ডাক দেয়। তাছাড়া সবই হলো মানুষ পড়ার বিষয়। মানুষকে পড়া। সহজ নাকি? তবে সহজ হয়ে যায়। মনকে যদি তুমি নিরাসক্ত বাউল করে তুলতে পারো, তবে তোমার চোখ খুলবে। তবে তুমি মানুষ চিনবে। তারপর সেই মানুষ নামের মহাগ্রন্থ পাঠ সম্ভব। মনের মতি মন্দ যতদিন, ততদিন আমরা জন্মঅন্ধ। ততদিন সেই বইএর মলাট দেখে যাওয়া শুধু। পাঠ গ্রহণ করতে জন্ম পার হয়ে যাবে। তবু পাঠ শেষ হবে না। পাঠ করতে হলেও মনকে গভীর এক টলটলে দিঘি বা নিদেন কূয়ো করে তোলা চাই-যার স্বচ্ছ আয়নায় আকাশ তার মুখের তিলটুকুর সৌন্দর্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারবে। আমি কূয়ো হতে পারিনি, কূয়োর ব্যাঙ হইলাম বটে জবরদস্ত! অগত্যা আমার সেই মলাটের রূপটুকুই দেখতে চাওয়া। এটা বুঝেছি, যতটুকু দেখতে চাই, ততটুকুর জন্যও সব অহম রাগ দ্বেষ লোভ মোহ ত্যাগ করতে পারা চাই।
এই ভনিতার এই অংশে এসে একখান কথা আছে। কথায় বলে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়।সাহিত্য, কবিতার মমাঁর্তের নিভৃত ও ফুলটুশি মার্কা চর্চা ছেড়ে এমন হাটে হাটে টো টো কোম্পানির কর্মী হয়ে পায়ে পায়ে ক্ষুইয়ে ফেলা সঘোষ বর্ণ আস্ফালনের কী দরকার? দরকার তো নিজের কাছে। যাদেরকে দূর থেকে দেখেছি, কখনও একপলক হাসিমুখে তাকিয়ে একটা মিষ্টি কথা ছুঁড়ে দেওয়ার আদিখ্যেতাও-তাদের কাছ থেকে দেখতে চাওয়া। জানতে চাওয়া তাদের সুখ-দুঃখ সাচ্ছল্য-দৈন্য আনন্দ-বেদনা আর ভেতরের আসল মানুষটিকে। ওই যে বললাম, মন যখন টলটলে জলের কূয়োয় খুলে দেবে মনের ভার স্বচ্ছতোয়া দর্পণে তখন ঘর তোমায় ঠেলাঠেলি করবে, যাও, যাও! বাইরে থেকে ঘুরে এসো দেখি!
আজ থেকে ক’বছর আগে সপরিবার কোরাপুট গিয়েছিলাম। কোরাপুটের হাট দেখে তার মধ্যে একটু বিশেষত্ব লক্ষ্য করি। কৌতুহল হয় যে, ওই অঞ্চলের সব হাটেরই কি ওই বৈশিষ্ট্য রয়েছে? কৌতুহল যখন হয়েছে তখন তো তার নিরসন করতেই হয়। বেশ ক’বার এরপর কোরাপুট চলে গেলাম। হাটে হাঠে কম ঘুরলাম না।কিন্তু এত দূর থেকে যাওয়া আর সেখানকার ভিনভাষী মানুষদের মনের পিঁড়িতে দু-দন্ডের ঠাঁই পাওয়া সহজ নয়। বহু ধৈর্য আর সময় দরকার। তাই কাজ অসমাপ্ত থাকল। কিন্তু হাটের মানুষ মাঠের মানুষেরা আমায় সদাই টানে।
এই গল্প যখন এক বন্ধু শুনলেন, বললেন কোরাপুট ছাড়ুন তো, মশাই! বাংলার হাট নিয়েও কাজ করা যায়। মুখে বললাম, ঠিক বলেছেন। মনে মনে বললাম, কেমনে ব্যাটা পেরেছে এটা জানতে! আমি নিজেও ভাবছিলাম আমাদের আঞ্চলিক হাটগুলো নিয়ে। সেহারা বাজারের মঙ্গলবারের গরুরহাটও তো বিখ্যাত। তবে এ দিগরে বহু পাঁচমিশেলি হাট থাকলেও, গরুর হাট কমই। তো হাট নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করতে গেলে ব্যাপারটা খুব কাঠখোট্টা হয়ে যায়।তথ্য পরিসংখ্যান লাগে। সে অনেক হ্যাপা। কোথায় পাব সেসব? তারচে’ আমি যখন রসের কান্ডারী, ভাবের কান্ডারী, তখন শুধু শুধু পুঁথি জ্ঞানের লটবহর কেন? মানুষের মতো জানার আর পাঠ করার মতো বিষয় আর কী আছে? তাই হাটের মানুষ আর বাটের মানুষের মনোরত্নের সন্ধানে আজ বেরিয়েই পড়লাম শেষমেশ।