শৈ বা ল   মু খো পা ধ্যা য়-র একটি ছোটগল্প “সোনার মানুষ”

পরিচিতিঃ ১৯৭১ সালে কলকাতায় জন্ম। শিক্ষা ও পিতার চাকরিসূত্রে আবাল্যলালিত বর্ধমান শহরে। লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ সময়ের ভিড় পত্রিকায় নব্বইয়ের দশকে। ধারাবাহিক, হাটে বাজারে, গল্পগুচ্ছ, সাপ্তাহিক বর্তমানসহ বহু পত্রিকায় তিনি নিরলস লিখে চলেছেন গল্প উপন্যাস ও অনুগল্প।তিনটি গল্প সংকলন রয়েছে এখনও পর্যন্ত। ২০১৭য় পেয়েছেন বর্ধমান অভিযান গোষ্ঠী প্রদত্ত চিত্ত ভট্টাচার্য পুরস্কার। বাইফোকালিজমে রইল আজ তাঁর একটি ছোটগল্প।

শৈ বা ল   মু খো পা ধ্যা য়র একটি ছোটগল্প 

 

সোনার মানুষ 
চিত্রঃ ২

‘স্বার্থ আর রাজনীতি অঙ্গাগিভাবে জড়িয়ে গেছে- কাউকেই আর দেখি না আত্মত্যাগ করতে। জানি না দেশটা কীভাবে এগিয়ে যাবে। গদির মোহে একটা প্রাণ হাউয়ের মত উবে যায়, কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সংবাদপত্র, মিডিয়া টি আর পি বাড়াবার জন্য কিছুদিন হইচই করে— তার পর আবার অন্য খবর’— নিউজ দেখতে দেখতে নিজের মনেই বকে চলে তুষার। ‘এই না হলে আমার দেশ! বিনা সংগ্রামে, মাত্র কয়েকটা হাতিয়ারকে সামনে রেখে ভোটযুদ্ধে ভোটটাকে ছিনিয়ে নিতে পারলেই সারা জীবনের মত নিশ্চিন্ত। যদি ছোটখাটো একটা মন্ত্রীত্ব পেয়ে যায়—তাহলে সোনায় সোহাগা। নিজের আত্মীয়গুষ্টি কেউ বেকার থাকবে না। সত্যি, এরাই সোনার মানুষ।
সৃজা কোনও কথার উত্তর দিল না। সে রুবুকে অঙ্ক দিয়ে পাশে বসে রয়েছে। রুবুর ক্লাস সেভেন। সৃজাই ওকে পড়ায়। তুষার একটি সাধারণ মানের সরকারী চাকুরে। বাপ-ঠাকুরদা কিছুই করে যেতে পারে নি, ফলে ভাড়া বাড়িতেই দিন কাটাচ্ছে।
তুষার আবার বকবক করতে থাকে, ‘দেখ, দেখ, গরীব ঘরের একজন বয়স্ক লোক সরকারি হাসপাতালে কোনও ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে না। ডাক্তারবাবুদের পোষা দালালরা বলছে- এখানে সেই রকম কোনও পরিকাঠামো নেই। নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়ে দিন। অথচ দেখ গে যাও, কোটি কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রগুলো হাসপাতালে পড়ে আছে। ওগুলোর ব্যবহার হয় না। সুপারের কাছে জানতে চাইলে তিনি সাফাই গাইবেন, ওই উন্নতমানের আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো অপারেট করার মত কোনও কর্মী নেই। যে সমস্ত প্রাইভেট ইন্সটিটিউড আছে, সেখানে চার লাখ, পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে লেখাপড়া, না না ডিগ্রি পাওয়া যায়- সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে প্রতি বছর পঁচিশ তিরিশজন স্টুডেন্ট ওই ডিগ্রি লাভ করেছে, যারা উন্নতমানের যন্ত্রপাতি অপারেট করতে পারে। তাহলে এখন প্রশ্ন- কর্মী যদি না থাকে তাহলে ওগুলো কেনা হল কেন? আগে কর্মী নিয়োগ করা হোক। তারপর মেশিন—
সৃজা কোনও কথা না বলে টিভি অফ করে দিল।
‘যাঃ, টিভি বন্ধ করে দিলে। আমি খবর দেখছিলাম’।
‘ছেলেটা পড়ছে। তাছাড়া, তুমি খবর দেখতে দেখতে ওই ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে তার বিচার বিশ্লেষণ করছ। সারা সপ্তাহের খবরে কাগজ বন্ধ করে সপ্তাহান্তে একটা করে রাখছিলাম। সেটাও বন্ধ করে দিয়েছি’।
‘তুমি তো জান সৃজা, আমি এসব সহ্য করতে পারি না। সমাজের ভালই যদি না করতে পারে তাহলে কীসের জন্য রাজনীতি করা?’
সবাই কী আর তোমার আমার মত করে ভাবে। তারা ভাবে তাদের মত করে। এখন টাকা থাকলেই ক্ষমতা। টাকা নেই ক্ষমতা নেই।
‘তাহলে সাধারণ মানুষরা যাবে কোথায়? দেশে এমন কেউ নেই যে যাকে দেখে মানুষ এগিয়ে যাবে। সে বিচার করবে। কেউ নেই। বিচার আচার সব ধ্বংস’।


রুবু বলল, ‘বাবা, ওঁরা হচ্ছেন সোনার মানুষ আর তুমি আমি রক্তমাংসের মানুষ। আমরা যেখানে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি সেখানে ওঁরা উজ্জ্বলতা লাভ করছে। ওঁরা যত অন্যায়ই করুক ম্লান হবে না। ওদের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে কৌলিন্যও বাড়বে’।
রুবুর কথা শুনে সৃজা অবাক হয়ে গেল। এইটুকু একটা ছেলেও সমাজ সম্পর্কে সচেতন। হবে নাইবা কেন? ওদের মধ্যেও সমাজের কুপ্রভাব পড়ছে। স্কুল আসা-যাওয়ার পথে, উঁচু ক্লাসের দাদাদের কাছে কিছু শোনে, কিছু দেখে।
সৃজা, তুষারের উদ্দেশে বলল, ‘এদের দোষারোপ করে কোনও লাভ নেই বুঝলে’।
তুষার চোখ টান টান করে বলল- ‘কী বলছ সৃজা? এদের ওই আচরন দেখে তোমার ঘৃণা হয় না, করুণা করতে মন চায় না?’
সৃজা মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, ‘না। যেখানে দেবতারাই এদের সঙ্গ দেয় মানে অধিকার দিয়েছে তখন রক্তমাংসের মানুষরা আর কীইবা করতে পার। তাদের আহবানে দেবতাদেরও ঘুম ভাঙে না। একটা গল্প বলি শোনো’—
‘সৃষ্টির প্রথম যুগে মানুষ বলে কিছু ছিল না। ছিলেন তিনজন দেবতা। তাদের হাতেই স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল। কিন্তু নিঃসঙ্গ ক্ষমতা তাদের ভাল লাগছিল না বলে তাঁরা ঠিক করলেন সর্বাঙ্গসুন্দর ও শক্তিশালী মানুষ সৃষ্টি করে তাদের উপর ছেড়ে দেবেন পৃথিবীর সমস্ত ভার। মানুষ দেবতাদের পুজো করবে, কৃতজ্ঞতা জানাবে।
দেবতারা প্রথমে মোমের মানুষ গড়লেন। দেখলেন মোমের মানুষ আগুনে গলে গেল। তারপর তৈরি করলেন কাদার মানুষ। সে জলে ধুয়ে গেল। তারপর বানালেন সোনারমানুষ। জলে বা আগুনে সে তো গললই না বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দেবতারা খুশি হলেন। ভাবলেন, সোনারমানুষ দেবতাদের পুজো করবে, কৃতজ্ঞতা জানাবে। কিন্তু দেখা গেল, সোনার মানুষ নড়ল না, কথা বলল না। দেবতারা হতাশ হলেন। ভাবলেন, এরা দেখতে সুন্দর হলেও জর পদার্থের মত থাকলেও- এদের দিয়ে কোনও কাজ হবে না। তারা সোনার মানুষকে ধ্বংস করলেন না।
বেশ কিছুদিন পার হওয়ার পর একজন দেবতা বললেন, তিনি শেষ চেষ্টা হিসাবে রক্তমাংসের মানুষ গড়বেন বলে ঠিক করলেন। নিজের বাঁ হাতের চারটে আঙুল ছুরি দিয়ে কাটলেন। কিন্তু কিছু করার আগেই ওই চারটে আঙুল পৃথিবীতে পড়ে গেল। পৃথিবী অনেক দূর। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেবতারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কয়েক হাজার বছরেও তাদের ঘুম ভাঙল না।


মাটিতে আশ্রয় পেয়ে ওই চারটে আঙুল ক্রমশ রক্তমাংসের মানুষ হয়ে জন্ম নিল। তারা চাষবাস শিখল। মাটিতে সোনার ফসল ফলাল। বন্য জীবজন্তুদের বশ করল। শক্ত লোহাকে নিজের হাতের মুঠোতে আনলো। এভাবেই তারা পৃথিবীতে প্রতিপালন হতে লাগল।
একদিন সেই সোনার মানুষ কেমন করে পৃথিবীতে এসে হাজির হল। রক্তমাংসের মানুষরা তাদের দেখে যেমন অবাক হল, তেমনই তাদের রূপ দেখে আকৃষ্ট হল। তখন পৃথিবীর মানুষ ওই সোনার মানুষকে তাদের ফলমূল, ফসল দিয়ে সহযোগিতা করল। বসবাসের জন্য জায়গা দিল। ক্রমে ক্রমে সেই সোনার মানূষদের সুন্দর শরীরে প্রাণ এল। সে চলতে শিখল। কথা বলতে শিখল। এবং অবশেষে তাকে এত সুন্দর করে গড়ার জন্য দেবতাদের উদ্দেশে সে কৃতঞ্জতা জানাল। সেই স্তব স্বর্গের দিকে ভেসে গেল এবং স্বর্গের দেবতাদের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে ঊঠে তারা দেখলন পৃথিবীর রূপান্তর ঘটেছে। দেবতারা বুঝতে পারলেন, এ তাদের সৃষ্টি সোনার মানুষ পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তিনিজন দেবতাই এই বিষয়ে সহমত পোষন করলেন। দেবতারা খুশি হয়ে সোনার মানুষদের সারা পৃথিবীর উপর একচ্ছত্র অধিকার দিয়ে বসলেন’।
সৃজা থামতেই রুবু বলল- ‘মা, তারপর?’
সৃজা তুষারের মাথার চুল এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল- ‘সেই থেকে সোনার মানুষ এবং তার বংশধররা পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য ভোগ করতে লাগল। আর রক্তমাংসের মানুষরা তাদের জন্য কাজ করে যেতে লাগল। দেবতাদের ঘুম মাঝে মাঝে ভাঙে আর তাদের আশীর্বাদ ঝরে পড়ে সোনার মানুষদের উপর’।
(‘মানুষ জন্মের কাহিনি’ মেস্কিকো মিথ ব্যবহার করা হয়েছে।–লেখক।)

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *