প্রথম মহিলা ভাষা-শহীদ ‘কমলা ভট্টাচার্য্য’
লিখলেন- স ন ৎ কু মা র ব ট ব্যা ল
বাঙালি মনে রাখেনি ভাষা আন্দোলনে বিশ্বের প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্যকে।
আজকের দিনে( ১৯ শে মে) বাঙলা ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই শহীদ স্মরণে জানাই অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও আভূমি প্রনাম।
‘……ভাত বেড়ে রেখো মা,
ফিরে এসে খাবো ,না এলেও মাগো ভেবো না’
সাহিত্যিক মনীশ ঘটক ( যুবনাশ্ব- মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য/ দেবীর বাবা)তার ‘ মায়ের কান্না ‘ শীর্ষক কবিতায় আসামের বরাক উপত্যকায় সেদিনের
ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ কমলা ভট্টাচার্যের আত্মাহুতীতে তাঁর মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনিয়েছেন।উপেক্ষিত আত্মবলিদানের মর্মন্তুদ কাহিনী!
১৯৬১ সালের ১৮ই মে | ঐদিন ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হল তাঁর | ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে হরতাল কর্মসূচি শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। সেদিন সকালে, অর্থাত্ ১৯শে মে সকালে তিনি আন্দোলনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সকালে স্নান করে মেজদিদির জন্য রাখা শাড়ীটা পড়ে নেন তিনি। মেজদিদি যেতে বারণ করলেও শোনেন না| এমন সময় আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের নেতৃত্বে ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল তাঁর বাড়ীতে আসে তাঁকে নেওয়ার জন্য। তাঁর মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে তারা তাঁর মাকে বুঝিয়ে রাজী করেন।মা তাঁকে এক টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ঘরে কিছুই না থাকায় খালি পেটেই বের হন |তাঁর সাথে বেড়িয়ে পড়েন তাঁর ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল, ও বড়দির ছেলে বাপ্পা।মায়ের মনে সেদিন কী উঠেছিল কে জানে! দুপুরের দিকে তাঁর ছোট ভাই বকুল আর বড় বোনের ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে আসেন তাঁর বিধবা মা সুপ্রবাসিনী দেবী। বকুল আর বাপ্পাকে প্রথমে পুলিশ ধরলেও পরে ছেড়ে দেয়।মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন তিনি, মায়ের ধূলিধূসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মাকে আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সে| সেই ছিল মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা ।
দুপুর দুটো | আন্দোলনকারীরা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। মারাত্মক অঘটন বুঝি আর ঘটবে না। কংগ্রেস সরকারের সমস্ত বলপ্রয়োগ বিফলে গেছে। হরতাল সফল হতে চলেছে।পুলিশ মিলিটারি অত্যাচারের মাত্রা একটুখানি কমিয়ে দম নিচ্ছে। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ ধ্বনিতে রেলস্টেশন মুখর।বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় দ্রুত | দুপুর প্রায় আড়াইটের সময় ন’জন আন্দোলনকারীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক শিলচর রেলওয়ে স্টেশন কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । শিলচর স্টেশনে আন্দোলনকারীরা সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে।তাঁর ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যান ও সাহায্যের জন্য চিত্কার করতে থাকেন। হঠাৎ গুড়ুম্-গুড়ুম্-গুড়ুম্ আওয়াজে শিলচর রেল স্টেশন সচকিত হয়ে উঠল। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এলো রাইফেল থেকে। সাত মিনিটের ভিতর তাঁরা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়।মঙ্গলাকে বাঁচাতে তিনি ছুটে গেলে একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে তার মাথা চুরমার করে দেয়। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে তাঁকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখনেই তার মৃত্যু হয়। আহত হয় মঙ্গলা। মঙ্গলা হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে করে তোলে চিরদিনের জন্য অপ্রকৃতস্থ।
তিনি আর কেউ নন,তিনি হলেন বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ, বাংলা ও বাঙালির গর্ব কমলা ভট্টাচার্য| বিশ্বের প্রথম নারী যিনি মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন।
কমলার জন্ম ১৯৪৫ সালে, অসমের শ্রীহট্টে। রামরমণ ভট্টাচার্য ও সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের পঞ্চম সন্তান হলেন কমলা। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবেই তার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতৃবিযোগের পর আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটতে থাকে কমলার পরিবারের। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে অসমের শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা আরম্ভ হলে তার রেশ শ্রীহট্টেও এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে অসমে চলে আসতে বাধ্য হন। তারা শ্রীহট্টের পার্শ্ববর্তী অসমের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন।
শিলচরে কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়ীতে। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে শিমূলগুড়ি চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজ দিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। কমলার পরিবার তার মেজদিদির আয়ের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। শৈশবে কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইন্ষ্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের পাঠ্য পুস্তক কেনার ক্ষমতা ছিল না কমলার। কমলা একবার বড়দিদি বেণুকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে তার বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতেন। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসেন। কমলা যখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী, বরাক উপত্যকা তখন উত্তাল ভাষার সংগ্রামে। অভাব অনটনে বড় হওয়া কমলা মনে মনে তখন ভীষণ লড়াকু। সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে সেও হয়ে উঠে সোচ্চার।কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি| তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতকস্তর পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিকের পর তিনি টাইপরাইটিং শিখবেন বলে মনস্থির করেন।পাশ করলেও সে রেজাল্ট তিনি দেখে যেতে পারেননি। জানা যায়, তার রেজাল্ট নিয়ে বিধবা মা আর্তনাদ করে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের মত স্বাধীন দেশের মানুষের হাতেই প্রাণ যাবে গো তোমার সন্তানের।’
স্বাধীন দেশে ১৯ মে ভাষা আন্দোলনের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। কমলাসহ সেই ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে শিলচর স্টেশনের এক শহীদ বেদির উপর। শিলচর স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।২০১১ সালে, ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কমলার স্কুল প্রাঙ্গনে ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয়। শিলচরের পাবলিক স্কুলের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে কমলা ভট্টাচার্য সড়ক, এই রাস্তার পাশেই ভাড়া থাকত কমলা ভট্টাচার্যের পরিবার।
কমলা ভট্টাচার্য অমর রহে।
বাঙালি হৃদয়ের অন্দরমহলে তোমার জন্য পাতা রইলো স্বর্ণ সিংহাসন।
আমরা তোমাকে ভুলতে পারি না ভুলবো না।চিরদিন বেঁচে থাকবে বাঙালির মনের মণিকোঠায়।
তোমার জন্য রইলো আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আভূমি প্রনাম।
ঋণ স্বীকার- বাঙালির ইতিহাস।