“বাবা বুদানের কফি” কলমে– তু ষ্টি ভ ট্টা চা র্য

পরিচিতিঃ গদ্য ও কবিতায় সমান চলন। শেওড়াফুলি নিবাসী, বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। বাইফোকালিজম্র পাতাজুড়ে আজ তাঁরই একটি গদ্য।

বাবা বুদানের কফি

  তু ষ্টি   ভ ট্টা চা র্য

 

শীতকালে এক কাপ কফির কোনো তুলনাই হয় না। উষ্ণতা, আয়াসে কফির জুড়ি মেলা ভার। আর যারা কফিপ্রেমী তাদের সারা বছরই কফি চাইই চাই। আর এই কফিরও যে কত রকমফের রয়েছে! প্রাত্যাহিকের বাইরে স্টাইলিশ কফি বানানো, বিভিন্ন স্বাদ আর নামের কফি খাওয়া এক বিলাসিতাও বটে। ভারতে পশ্চিমঘাট পর্বতাঞ্চলে কফি চাষের প্রচলন আছে। কুর্গ অঞ্চলের অধিবাসীরা কফি চাষে সিদ্ধহস্ত। বৃটিশরা ভারতে এসে নিজেদের স্বার্থেই এই অঞ্চলে কফি প্ল্যান্টেশনের আধুনিক পদ্ধতি শুরু করে। কিন্তু তাদের আসার আগেই এই অঞ্চলে কফি চাষের প্রচলন ছিল। এই চাষ করত স্থানীয়রাই। কিন্তু কিভাবে ভারতে এলো এই কফি বীজ? কিভাবে শিখল তারা কফি চাষের পদ্ধতি? এই নিয়ে এক কাহিনি প্রচলিত আছে। সেই কাহিনিই বলব এখানে।
হজ করে ভারতে ফিরছেন এক বৃদ্ধ পিরবাবা। ইয়েমেন থেকে ফেরার সময়ে তাঁকে যেন একটু বেশিই সন্ত্রস্ত আর ভীত দেখাচ্ছে। অথচ একজন হাজি’র তো শুদ্ধ ও প্রসন্ন চিত্তে বাড়ি ফেরার কথা। তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে বাবা বুদান নামে সম্বোধন করছেন মাঝেমাঝে। কোন রকমে দু’এক মুঠো মুখে তুলছেন অনিচ্ছায়। বেশির ভাগ সময়ে চুপচাপ আর স্থির হয়ে হাতের লাঠিটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে শকটে বসে আছেন। যেন লাঠিতেই রয়েছে তাঁর প্রাণভোমরা। এমনকি রাতেও তিনি ঠায় জেগে বসে আছেন লাঠি হাতে। আর সারাক্ষণ হাতের মালা জপ করে চলেছেন। অথচ সঙ্গীরা কিন্তু বাবা বুদানকে এমন আচরণ করতে আগে কখনও দেখেনি। তারা অনেকেই তাঁর শরীর সম্বন্ধে বারেবারে খোঁজখবর করায় তিনি আবার বিরক্ত হচ্ছেন। ফলে তারা কেবল ফিসফিস আলোচনা করছে নিজদের মধ্যে—কী এমন হল বাবা’র? বেশ কয়েকদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পরে বাবার মুখে একদিন যেন হাসি ফিরে এলো। সেদিন ভোরের আলো ফোটার সময়ে আজান শুনে বাবা নমাজ সেরে এলে, সকলে দেখল, বাবা আবার সেই আগের হাসিখুশি অবস্থায় ফিরে গেছে। এ কদিনের দুশ্চিন্তার রেশ উধাও তাঁর মন থেকে। আর সুখের কথা এও যে, আরবের সীমানা ছাড়িয়ে জাহাজ এবার নিজেদের দেশে প্রবেশ করেছে। হয়ত দেশ বাবাকে টানছিল। অনেকদিন একটানা বিদেশে থেকে হয়ত বাবার মন খারাপ হয়েছিল। যাই হোক না কেন, সকলে আজ খুব ভারমুক্ত মনে রইল। তবে বাবা কিন্তু লাঠিটা এখানে এসেও হাতছাড়া করেননি, এটা সকলে খেয়াল করেছে।


শেষ পর্যন্ত যাত্রা শেষ হল। সেই সময়ের মহীশূরের চিকমাগলুর জেলার ছ’হাজার ফিট উচ্চতার চন্দ্রগিরি পাহাড়ে, যেখানে বাবা বুদানের আস্তানা, বাবা এসে পৌঁছলেন সপারিষদ। নিজের ডেরায় গিয়ে বাবা সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি তোমাদের এবার একটি ঘটনা বলব। যা শুনে তোমরা আমাকে যদি দোষী সাব্যস্ত কর, তো সে পাপ আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব।‘ ভক্তরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তখন বিস্ময়ে। এ আবার কী ধর্ম সঙ্কটে ফেলে দিলেন তাদের বাবা! একজন তবু সাহস করে বলে ফেলল, ‘আপনি কোন গুনাহ করতেই পারেন না। এ আমাদের বিশ্বাস। তবু যদি না জেনেবুঝে কিছু অন্যায় ঘটে থাকে আপনার দ্বারা, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার স্থান আমাদের কাছে একই রকম থাকবে।‘ বাবা যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। গুছিয়ে বসে তিনি এবার ধীরে ধীরে তাঁর কাহিনি শুরু করলেন। ‘আমি যখন ইয়েমেনে পৌঁছই, ওখানে কফি খেয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাবছিলাম, আমাদের দেশে কেন এমন কফি পাওয়া যায় না! স্থানীয়দের থেকে কফি চাষের পদ্ধতি শুনে মনে হয়েছিল, আমাদের এই চন্দ্রগিরিতে উত্তম মানের কফি চাষ হতে পারে। এখানকার মাটি, জলহাওয়া, পাহাড়ের ঢাল, সর্বোপরি এই বৃষ্টি—এখানে কফি চাষের খুবই সহায়ক। কিন্তু পরে শুনলাম, এই কফি বীজ আরব দেশ থেকে কোথাও রপ্তানি করা হয় না। বীজ সিদ্ধ করে বা গুঁড়ো করে কফি প্রস্তুত করার পরেই তা রপ্তানি করা হয়। অন্য দেশ যাতে কফি চাষের পদ্ধতি শিখে না ফেলতে পারে, যাতে তাদের ব্যবসায় ক্ষতি না হয়, তাই কফি বীজ ওদেশের বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার আইন নেই, লুকিয়ে কেউ নিতে গেলে এবং ধরা পড়লে তার কঠিন সাজা দেওয়া হয়। এইটুকু শুনে আমি প্রচণ্ড হতাশ হই। এদিকে সেই কফির ঘ্রাণে আমি পাগল হয়ে উঠেছি প্রায়। কী জানি কেন, মাথায় রোখ চেপে গেল আমার সেদিন। আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে আল্লার নাম করে, একটি একটি করে পবিত্র সাত সংখ্যাকে মনে রেখে, সাতটি বীজ চুরি করলাম। এই সময়ে, একদিকে গ্লানি আমায় চেপে ধরছিল, অন্যদিকে আনন্দ। এরপর আবার সেই বীজ দেশে নিয়ে যাব কী করে সে উপায় ভাবতে ভাবতে আমার রাতের ঘুম চলে গেল প্রায়। শেষে আল্লাহ্‌ই আমাকে বুদ্ধি দিলেন স্বপ্নে। আমার এই লাঠির ভেতরে আমি সাতটি বীজকে লুকিয়ে নিয়ে এলাম। পুরো যাত্রাপথ উদ্বিগ্ন ছিলাম ধরা পড়ার ভয়ে। একজন লোভী তস্করের বেশি নিজেকে ভাবতে পারছিলাম না সে সময়ে। মনে হচ্ছিল হজ করার সমস্ত পূণ্যফল এই কটি কফি বীজ চুরি করে নষ্ট হয়ে গেল। এইবার তোমরা আমায় যা শাস্তি দেওয়ার দাও। তবে এই পাহাড়ে আমি এই বীজ পুঁতবই। চাষের পদ্ধতিও জেনে এসেছি। তোমাদের শিখিয়ে দেব।ভক্তরা হৈহৈ করে উঠল সব শুনে। তারা বাবাকে কাঁধে করে পাহাড়ে নিয়ে চলল তখুনি। সেই সাতটি বীজ পোঁতা হল। আর শুরু হল কফি চাষ। লোকমুখে সেই চন্দ্রগিরি এখন বাবাবুদান গিরি নাম নিয়েছে। এ ঘটনা নয় নয় করে সেই ১৬৭০ সালের ঘটনা। তারপর পশ্চিমঘাটের গা বেয়ে অনেক অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সেই সময়ের শাপদ সঙ্কুল ঘন জঙ্গলে ঘেরা বাবাবুদান গিরিতে ধীরে ধীরে লোকবসতি বেড়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে কফি চাষ পদ্ধতি শুরু হওয়ার পরে বড় আকারে চাষবাস করতে তাও লেগে গেছে দেড়শো/দুশো বছর। ১৮৪০ সালে স্থানীয় বাসিন্দারা জমি কিনে এই পাহাড়ে কফি চাষ শুরু করে পাকাপাকি ভাবে। তারপর আসে বৃটিশরা উনিশশো সালের পরে। তারা না এলে কফি প্ল্যান্টেশনের আধুনিক পদ্ধতি শিখতেই পারত না কন্নড়রা।


১০০০মিটার থেকে ১৫০০মিটার উচ্চতায় ভাল ও দামী কোয়ালিটির অ্যারাবিকা প্রজাতির ফলন প্রচলিত রয়েছে এই অঞ্চলে। যদিও কম দামী ও উচ্চ ফলনশীল রোবাস্টা প্রজাতিরও চাষ হয়। গরমের সময় কফি গাছের কাণ্ডে ‘হোয়াইট স্টেম বোরার’ কীটের প্রাদুর্ভাব এড়াতে নির্দিষ্ট মাপের লাইম সলিউশন দিয়ে স্নান করাতে হয় কফিগাছকে। নইলে খেতের পরে খেত কফিগাছদের এই সাদা পোকার দৌরাত্ম্যে খড়ের মতো ছিবড়ে হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আকছার ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন পোকামাকড়ের জন্য কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। কফি গাছের সঙ্গে এলাচ গাছের বন্ধুতা অপরিহার্য। আর বর্ষাকালে এই কফিবাগানে এলাচ গাছের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে বিষাক্ত গোখরোর দল। একসময় এই সাপের কামড়ে শ্রমিকদের এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মৃত্যুর হার ছিল খুবই ভীতিজনক। যদিও বর্তমানে সাপ ধরার বিভিন্ন কৌশল খাটিয়ে মৃত্যুর হার কমেছে।
যতই বিদেশ থেকে দামী কফি আমদানি হোক না কেন, ভারত ও সংলগ্ন এলাকার সমস্ত কফির চাহিদা পশ্চিমঘাট পর্বত এলাকা থেকেই পূরণ হয়। ফলে বাবাবুদান আজও আমাদের মাথার ওপরে দাঁড়িয়ে খুশির হাসি হাসছেন, আমি নিশ্চিত। তাঁর সাদা দাড়ি হাওয়ায় উড়ছে, আর চোখের মণি আনন্দে জ্বলজ্বল করছে—দেখতে পাচ্ছেন তো? অনেকে বলে থাকেন, কফির সেই সাতটি বীজ তিনি নাকি দাড়িতে লুকিয়েই এদেশে এনেছিলেন। লাঠি হোক বা দাড়ি, এই পার্থক্যে কী যায় আসে আজ আমাদের? এক কাপ কফি হলেই আমরা নিশ্চিন্ত হই।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *