সু ব্র ত   ভৌ মি ক-র অণুগল্পের ডালি

পরিচিতি : জন্ম ১৯ নভেম্বর ১৯৬৫, বনগাঁয়। সঙ্গীতপ্রিয় ও পেশায় শিক্ষক সুব্রত ভৌমিক-এর আপাতত দুটি গল্পগ্রন্থ। ‘পর্ণা আজ বেরোবে’ (একুশ শতক) এবং ‘অন্তর ছিপে ওঠে না’ (উবুদশ)। সদ‍্য প্রকাশিত একটি অণুগল্পের বই ‘অণুগল্প সংগ্রহ’ (অভিযান পাবলিশার্স)। পুরস্কার পেয়েছেন ‘কবি বিশ্বনাথ মৈত্র পুরস্কার’, উদ্ভাস, ই-হিউম‍্যান, বহুস্বর। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ অণুগল্পের ডালি রইল পাঠকদের জন্য।

 

সু ব্র ত   ভৌ মি ক-র অণুগল্পের ডালি

 

অণুগল্পঃ এক

ভিড়ের চোখ 


নাক টানলেই একটা গন্ধ। কিছু পুড়ছে? সকাল হতেই ফের ছুটছি। কী পেতে জানি না। ছোটাটা নির্ঘাৎ একটু বেশি হয়ে থাকবে। ট্রেন ছাড়তে তখনও পঁচিশ মিনিট। অগত্যা এক কাপ চা, সঙ্গে দুটো বিস্কুট।

     নাহ্ , এখনও মিনিট কুড়ি। মানে হয়? ইদানীং এই এক সাজা। সারাটাদিন বেতনভুক সরকারি খাটান, খালাস হলে ফাঁকা। কে যেন ছিল। নেই। কিছু চেয়েছিলাম? ভুলে গেছি। নাকে-মুখে গুঁজে সকাল সাতটা বাইশ অফিসট্রেন ধরা এক শিরোধার্য জীবন।

     রাতে চাঁদ ডুবে যায়। আর কিছু না-পাওয়া জীবনটায় পাশে শোয়া বউ পাই। বউও আমাকে বা। এক ভালবাসাহীন তীব্র নৈকট্য। পোড়ে, পোড়ায়। অতঃপর এক ছারখার বিতৃষ্ণায় দুজন দুজনকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ভোঁস-ভোঁস ঘুম। ট্রেনে, অটোয়, বাসের রড ধরে — ঘুম-ঘুম। স্বপ্ন মরে গেলে ঘুম পায়। দেখা যায় না।   

     তো এভাবে তাকালাম।

     দেখি, ভ্যান্ডার কমপার্টমেন্টের কাছে একটা জটলা। একটা পুরুষকূল একটা বিষয়ের উপর আমস্তক হামলে পড়েছে। ব্যাপার কী? ব্যাপার রসালো। তাহলে তো দেখা দরকার। কর্তব্যও বটে। 

     কিন্তু না, দেখা অত সহজ নয়। অন‍্যদেরও একটা কর্তব্যবোধ আছে। অতএব জন্তুর মতো গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে ফাঁক খুঁজে মুখ গুঁজতেই থ। চোখ ধাঁধানো এক পরস্ত্রী! ধবধবে হাত-পা। রঙটা আলোর মতো চোখে লাগে। কিন্তু কী সব্বোনাশ, ব্লাউজের গলা ঠেলে বেরনো দুরন্ত বিভাজিকা থেকে ধীরে ধীরে আঁচল নামছে। আর পটাপট টাকা-পয়সা পড়ছে সামনে। কিন্তু কেন!

     পাশে প্রশ্ন ঠেললাম, ‘কী হয়েছে এর?’

     জবাব এল, ‘পুড়ে গেছে।’

     ‘সেকি, কী পুড়ে গেছে! ঘর-বাড়ি?’

     ‘আজ্ঞে না, বুক।’

     গন্ধটা তাহলে বুক পোড়ার? তাই দেখতে এই ভিড়? কিন্তু গন্ধটা আসছে কোত্থেকে? না, ভিড় কিছু দেখতে পায় না। যেন ভিড়ের কোনও মন নেই, কান নেই, চোখ ফোটে না। শুধু ছোটে। অতএব ফের ভিড় ঠেললাম, ‘ইস, কে পোড়াল, দেখি দেখি—‘ ব’লে কোনোক্রমে মাথা ঢোকাতেই মানুষ না, আর একটা পুরুষ বাড়ল।

     দেখি, বুকের উপর একটা পোড়া দাগ। কিন্তু গন্ধটা সেখানকার নয়। তারও ভিতরে কোথায় ধিকিধিকি পুড়ছে বউটা।

 

অণুগল্পঃ দুই

চিহ্ন


সারাদিন ফোটোটার সামনে ধূপধুনো, জলমিষ্টি, পুরোহিত ডেকে অনুষ্ঠান। তখন কিছু না। রাত বারোটা নাগাদ বালিশে মাথা ঠেকিয়ে আনমনে যেই একটু ভাবতে যাবে, কানে এল, ‘কী রে, এখনও ঘুমোসনি?’

অরু চমকে উঠল, ‘মা তুমি!’

আলনায় এখনও মায়ের শাল। তাকে ওষুধের কৌটো।

অরু শশব‍্যস্ত হল, ‘এসো এসো। খাটে বোসো।’

মা ম্লান হাসল, ‘না রে, আমার কি আর এঘরে বসতে আছে?’

‘বসো তো। কিচ্ছু হবে না।’

ড্রেসিংটেবিলটার সামনে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে মায়ের ফোটো। গলায় রজনীগন্ধার মালা। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল। আজ মায়ের মৃত‍্যুবার্ষিকী। ফোটোটার ভিতর থেকে মা বেরিয়ে এসে সসংকোচে খাটটার একপাশে একটু বসল। মা’র গলাটা কী শান্ত হয়ে গেছে। এমন শান্ত গলায় আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘তোরা সব ভালো আছিস?’

‘হ‍্যাঁ।’

‘আমার কথা আর মনে পড়ে?’

‘মাঝে মাঝে।’

মা ফের হাসল।

হাসিটা কথার মতো। কাঁটা ফোটা। হয়তো এই কারণে যে, ক-দিন আগেও এই মা ছাড়া কারও একদণ্ড চলত না। অরুর মনে আছে, একবার মায়ের সঙ্গে সে প্লেনে করে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। অরু তখন ছোটো, বছর পাঁচ। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখে, মা নেই। তাকে না বলে সিনেমায় চলে গেছে। অমনি ছেলের কী কান্না, অভিমান! শেষমেশ ছোটোমামাকে সিনেমা চলাকালীন মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে তবে শান্ত করতে হয়।

সেই মা! সেই থেকে অরু ঠিক করে, ঘুমের মধ‍্যে মাকে আর কাছ-ছাড়া করবে না। জড়িয়ে থাকবে। তবু সেই হাত সরিয়ে মা চলে গেল। ভাবতে ভাবতে অরু কথা বলে উঠল, ‘আমাদের ছেড়ে কোথায় চলে গেলে, মা?’

উত্তর এল, ‘যেখানে ছিলাম।’

‘আর এখানে যে ছিলে?’

‘সে তো মায়া।’

অরু চুপ করে গেল। পাশের ঘরে বউ আর মেয়ে ঘুমিয়ে। এঘরটা মায়ের। এখন অরু শোয়। অরুণাভ নাথ, ছোটো ছেলে। বাকি দুই দিদি আর দাদা বিয়ে করে বাইরে থাকে। মা ডাকলেই সব ছুটে আসত। তাকে ঘিরে আনন্দ করত, হৈহৈ করত। ফেরার দিন মা’র চোখে জল।

সেই কথা মনে করিয়ে অরু এবার প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘সবই কি মায়া, মা? একটুও কি সত‍্যি ছিলে না?’

অমনি আর কথা নেই।

আর কোনও উত্তর এল না।

‘মা-আ…মা-আ? শুনতে পাচ্ছ? বলো না, তুমি কি সত‍্যিই একটুও ছিলে না?’ বলে অরু এবার তাড়াতাড়ি উঠে বসল। আলো জ্বালাল। কিন্তু কোথায় কে! দেখল, শুধু যে জায়গাটায় মা বসেছিল, বিছানার চাদরটা একটু কুঁচকে আছে।

 

অণুগল্পঃ তিন

রঙ


আরও একটা হর্ষরোল উঠল, ‘হোলি হ‍্যায়।’ কোনও একটা রঙখেলার দল আবির ওড়াতে ওড়াতে দূর থেকে আরও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ‍্যে পাড়ার ক’টা ছেলে অভয় মাস্টারের বাড়ি ঢুকে পড়ে ডাকল, ‘মাসিমা-আ, নীলা কোথায়?’

     জানা গেল, সে দরজা-জানলা এঁটে বসে আছে। কিছুতে বেরোবে না।

     ‘বসাচ্ছি।’ ব’লে শেখর পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়ির পিছনদিকে গেল। তারপর জানলায় উঁকি মেরে বলল, ‘এ‍ই যে ম‍্যাডাম, দরজা খুলুন।’

     উত্তর এল, ‘না।’

     ‘কেন?’

     ‘তুমি ভূত করে দেবে।’

     শেখর হাসল। 

     হয়তো ঠিক, দিনটায় রঙ লেগে যায়। এখানে-ওখানে, পাঁচিলের গায়ে। শেখর পাড়াত দাদা। নীলাকে মাঝেমধ‍্যে কলেজে পৌঁছে দেয়। ডাকলে চৌকাঠ অব্দি আসে। 

     সম্পর্কের সেই নড়বড়ে সেতু বেয়ে খানিক এগোতেই নীলা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ দু’হাত বাড়াল। তারপর শেখরের দু’গালে আচ্ছা ক’রে ভুসোকালি মাখিয়ে দিয়েই জানলা বন্ধ। কানে ঝরনার মতো খিলখিল হাসি। কিছুতে আর দরজা খুলল না।

     শেখর চুপ। বিমূঢ়। হনহন করে সঙ্গীদের মধ‍্যে ফিরে এল। তারপর বাড়ি এসে ডলে ডলে মুখ ধুলো।

     তাতে রঙ মোছে, দিন মোছে না।

     এভাবে আরও কিছু বসন্ত বয়ে গেল ইছামতীর তিরতির জলে।

     #

     নীলা এখন ডিভোর্সি, বেরোয় না।

     বেশ ধনী-ঘরে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দেড় বছরও টিকল না। এবারের বসন্তে বাপের বাড়ি। 

     শেখর সেই। প্রতি বছরের মতো এবারও রঙ হাতে প্রণাম করতে এসেছে। ‘মাসিমা’ ব’লে হাঁক পেড়ে পায়ে আবির দিল। তারপর নীলা ছাদে আছে শুনে উঠে গিয়ে দেখল, পিঠে এক ঢাল চুল ফেলা। মোছা কপাল। হাতে-মুখে কোথাও রঙের ছিটে নেই। ইস্, রঙখেলার দিন কি এমন পরিষ্কার মুখ মানায়? ভেবে শেখর পা টিপে পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দু’হাতে আবিরটা নিয়ে হঠাৎ নীলার সারা মুখে লাগিয়ে দিল। রঙ লেগে গেল চোখে, মুখে, স্বামীর জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরা ক্ষত’য় …

     নীলা চমকে উঠল, ‘এ কী করলে!’

     শেখর হাসছে। বলল, ‘শোধ।’

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *