নি ত্য র ঞ্জ ন দে ব না থ-র ছোট গল্প অতনু স্যার

 

পরিচিতিঃ  নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়।পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের Accountant General এর অধীন Divisional Accounts Officer পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।তাঁর প্রথম গল্প চেতনা ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬-এর এপ্রিলে প্রকাশ হয়। তারপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্যে, মাতৃশক্তি, দৈনিক স্টেটসম্যান,যুগশঙ্খ, একদিন, সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্য কীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে তার চারটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।দীর্ঘদিন ধরে “শতানীক” সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করে আসছেন তিনি। আজ বাইফোকালিজম্-র পাতা তাঁরই একটি ছোটগল্প দিয়ে সাজানো হল।

 

নি ত্য র ঞ্জ ন   দে ব না থর ছোট গল্প

অতনু স্যার

দিল্লি রোড ধরে অফিস থেকে ফিরছিলাম। রাত নটা বেজে গিয়েছে। আমি একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চিপ এক্সিকিউটিভ। লোভনীয় স্যালারি যেমন দেয় তেমনি কাজের দায়িত্ব। নামকাওয়াস্তে দশটা-ছ’টা ডিউটি হলেও কোনও দিনই আটটার আগে অফিস লিভ করতে পারি না। বিশেষ করে আমাদের মত দায়িত্ব পূর্ণ পদে যারা আছে।বেশিরভাগ সাব-অর্ডিনেট স্টাফরা ফাইলের কাজ কমপ্লিট করে শেষ মুহূর্তে কম্পিউটারের মাধ্যমে পুট-আপ করে । সেসব ফাইল একটু না দেখেতো সই করে ছেড়ে দেওয়া যায় না। ফলে সাড়ে সাতটা থেকে আটটা হয়েই যায়। আজ যেমন আটটা বেজে দশ মিনিটে বের হলাম। একটা ক্রিটিক্যাল ওয়ার্কের ফাইল স্টাডি করতে গিয়ে মাথাটা একটু ঝিম মেরে আছে বিকেল থেকে। ড্রাইভারকে বললাম, একটা ভালো চায়ের দোকান দেখে দাঁড়াবে তো। একটু চা খেয়ে নেব। যদিও আমার বাড়ি চুঁচুড়া স্টেশনের কাছেই। আর মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে পৌঁছে যাব। তবু একটু খোলা আকাশের নিচে চা সিগারেট খেয়ে নিতে ইচ্ছে করল। দিল্লি রোডের দু’ধারে যে ধাবাগুলো আছে ,দু’দণ্ড বসলে যেন মনে হয় প্রাচীন কালের সেই হরপ্পা-মহেঞ্জদরো যুগের কোনো এক পানশালায় বসে আছি। তখন কি এমনটা ছিল? কেন মনে হয় জানি না। তবে মনের এক প্রশান্তি টের পাই। যদিও এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।
দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বাইরের খাটিয়ার উপর চুপচাপ বসে আছি। বৈশাখের শেষ। প্যাচপ্যাচে গরম।তবে এখানটায় ফ্যান নেই তবু দিব্যি লাগছে। প্রকৃতির কি মহিমা। মৃদু মৃদু হাওয়া, ফ্যান, এসি কে হার মানায়। আস্তে আস্তে খদ্দের বাড়ছে। যত রাত গভীর হবে লোকজনের আনাগোনা বাড়বে।এক একজন এক একরকম ইচ্ছা নিয়ে আসে। তড়কা তন্দুরি রুটি বা মাংসের সঙ্গে কেউ লাল তরল, কেউ বা গাঢ় দুধের চা–যার যেমন মর্জি। চারিদিকটা দেখছিলাম। রুটি তড়কার খদ্দেরই বেশি। একটা-দুটো টেবিল ব্যতিক্রম। সেডের বাইরে কিছু চেয়ার ও খাটিয়া পাতা আছে। এখানে আমার মত শুধু চায়ের খদ্দের। হঠাৎ একটা টেবিলে এক বয়স্ক লোককে দেখে চক্ষু স্থির। কিছুটা দূর থেকে দেখছি তো, চোখের ভুলও হতে পারে। তাঁর বসা, খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে যেন ঠিক আমার প্রিয় অতনু স্যারের মত। যিনি আমার জীবনের ধ্রুবতারা বলা যায়। তাঁর কথা জীবনে ভোলার নয়। কাছে যেতেই আমি হতবাক ! সত্যিই আমার স্যার।এখানে কেন খেতে এলেন? খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে খুবই ক্ষুধার্ত।
এক সময় স্যার বললেন, ” এই আর দুটো রুটি দাও।”
মালিক বয়কে বলল,” বলে দে, আর দেওয়া যাবে না।”
তৎক্ষণাৎ দ্রুত গিয়ে মালিককে বললাম, যা যা খেতে চায় দিয়ে দিন।আমি সব পয়সা মিটিয়ে দেব।”
মালিক বললেন,”দেবেন তো? একজন এসে বলল, ওঁকে এক প্লেট তড়কা ও দুটো রুটি দিন, আমি পয়সা দিচ্ছি। বলেই কোন ফাঁকে যে কেটে পড়ল,টেরই পেলাম না।”
আমি একটা দু’শো টাকার নোট বার করে বললাম,”এই নিন এটা রাখুন। লাগলে আরও দিচ্ছি। যা খেতে চাইবে তাই দেবেন, আমি বাইরের খাটিয়ায় বসে আছি।”
ভাবছি অন্য কথা। স্যার এখানে এলেন কি করে? বাড়ি চন্দননগর। অত্যন্ত মেধাবী এবং বনেদি পরিবারের সন্তান। আমাদের স্কুলের ফিজিক্সের টিচার ছিলেন। সারা দিনরাত ফিজিক্সের নানা বই, জার্নাল পড়তেন। এম.এস.সি করে পি.এইচ.ডি করেছেন। স্যারের সবদিক ভাল হলেও একটা দিক আজকাল অচল। যেমন স্পষ্টবাদী তেমনি অপ্রিয় সত্য মুখের ওপর বলে দিতে দ্বিধা করেন না। ফলে শত্রু বৃদ্ধি।অনেক চাকরি পেয়েও টিকে থাকতে পারেন নি। একদিন স্কুলের হেড স্যারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে তুমুল কান্ড। সেদিন অন্য স্যারেরাও তাঁর স্বপক্ষে একটি কথাও বলেন নি। অপমানিত হয়ে দুম করে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন। একবারও ভাবলেন না তাঁর চলবে কি করে? ওঁর একমাত্র ছেলে অত্যন্ত মেধাবী। খড়গপুর আই আই টি তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।


আমি তখন ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিন মনে হল স্যারের কাছে যদি ফিজিক্সের কোচিং নিতে পারি নিশ্চিত রেজাল্ট ভাল হবে। কারণ উনি যেভাবে বোঝান একেবারে জলবৎ তরলং। শেখানোর টেকনিকই আলাদা। এখনতো উনি বাড়িতেই থাকেন সারাদিন। চলে গেলাম একদিন। ভাবিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে যাবেন। সেই শুরু। কাকিমাও আমাকে খুব ভালোবাসতেন। বিএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলাম। স্যারের কোনো সময় জ্ঞান ছিল না। দু’ঘন্টা-তিন ঘন্টা-চার ঘণ্টা ধরেও এক নাগাড়ে পড়াতেন। টিউশন ফিজ নিতে চাইতেন না। আমি জোর করে কাকিমার কাছে দিয়ে আসতাম। এমএসসি পড়াকালীনও স্যারের কাছে নিয়মিত পড়তে যেতাম। ফলে এমএসসিতেও টপার হয়েছিলাম। স্যারের কাছে না পড়লে কোনো মতেই সম্ভব হতো না।
ধাবার একটি ছেলে এসে বলল,” স্যার, তিনশো চল্লিশ টাকা হয়েছে। আর আপনাদের চায়ের দাম পঞ্চাশ টাকা।”
আমি দাম মিটিয়ে স্যারের কাছে এলাম। গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। বললাম, “স্যার কেমন আছেন? আমায় চিনতে পারছেন?”
স্যার বললেন,” আরে দীপঙ্কর, তোকে চিনবো না? অনেক দিন তোর দেখা নেই।শুনেছি বড় অফিসার হয়েছিস।তা এখানে কোথায় এসেছিস?”
“সবই আপনার আশীর্বাদ স্যার। এদিক দিয়েই ফিরছিলাম, একটু চা খাবো বলে নামলাম।”
“আশীর্বাদ টাসিরবাদ নয়, নিজের যোগ্যতায় পেয়েছিস। তোর মত মেধাবী ছাত্র খুব কমই পেয়েছি। তোরা যদি ভালো চাকরি না পাস, তাহলে কারা পাবে?”
“চলুন স্যার, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরবো।”
“পৌঁছে দিবি? চল, তবে কি জানিস, সুনন্দা চলে যাবার পর বাড়িটাতে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ নিঃঝুম, কেমন খাঁ খাঁ করে। এমনিতে আমি কোলাহল থেকে একটু নিরিবিলিই পছন্দ করি। মনের মত পড়াশুনা করতাম।কিন্তু এখন ওই শুন্য বাড়িতে একদম টিকতে পারছি না।”
আমি অপ্রস্তুত। প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর পর স্যারের সঙ্গে দেখা। কাকিমা কি তাহলে ছেলের কাছে আমেরিকা চলে গেলেন? স্যারের কথাবার্তা সহ্য করাও মুশকিল। আমার সম্মুখেই দেখেছি কাকিমাকে জোর ধমক-ধামক দিতেন। হয়তো আর মেনে নিতে পারেন নি। তবুও বলব কাজটা ঠিক করেন নি।ছেলেও নাকি বাবার জন্যই দেশে আসে না।”
আমি বললাম,” কাকিমা কি তাহলে টিটোর কাছে আমেরিকা চলে গেছেন?”
” নারে, সুনন্দা গত সেপ্টম্বরে না ফেরার দেশে চলে গেছে। পেটে ক্যানসার ধরা পড়ে শেষ মুহূর্তে। অনেক ডাক্তার দেখালাম। এস এস কে এমে ভর্তি ছিল। এত দ্রুত অবনতি হবে কল্পনাও করতে পারিনি। হঠাৎ একদিন হার্টফেল করে চলে গেল। পৃথিবীতে একমাত্র ওই আমার আপন মানুষ ছিল রে। আমাকে বুঝতো, ভালোবাসতো।আর কেউ আমাকে বুঝল না এটাই বড় দুঃখ। ছেলেটা পর্যন্ত সরে গেল। মা থাকতে রেগুলার টাকা পাঠাতো। এখন টাকা পাঠানো দূরের কথা ফোন করলে পর্যন্ত ধরে না, এমনই কুলাঙ্গার ছেলে।”
স্যারের কথা ভেবে আমি শিউরে উঠছি। যে মানুষটা সারাজীবন মেজাজে দাপটের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন, তাঁর আজ এই পরিণতি? গাড়ি প্রায় স্যারের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। বিষাদ মনে আমি চুপচাপ বসে আছি। এলোমেলো অনেক ভাবনা আসছে কিন্তু কি বলে সান্ত্বনা দেব বোধগম্য হচ্ছে না।
গাড়ি স্যারের বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াল। আমি বললাম, ” স্যার, আপনি বরং আমার বাড়িতে চলুন। আমার বাড়িতে আলাদা ঘর আছে।একেবারে সেপারেট ব্যবস্থা। নিজের মত থাকবেন, যত ইচ্ছে পড়াশুনা করবেন। আর আমার ছেলেটাকে একটু সাইন্সটা দেখিয়ে দেবেন। আমার পুত্র এবার ইলেভেনে পড়ছে। আপনার গাইড পেলে ওর উপকার হবে আমি নিশ্চিত।”
স্যার এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। কিছুটা স্বস্তি পেলেও অস্বস্তিও কোনো অংশে কম নয়। বাড়িতে স্ত্রী নিশা কেমন ভাবে নেবে। এখন সব নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। তাতেই সকলে অভ্যস্ত। অপরিচিত এক্সট্রা লোকের ভার–অপছন্দ করবেই। তারপর রেগুলার থাকবে।খাওয়া-দাওয়া করবে—খুশি না হওয়াই স্বাভাবিক। তবু ছেলের উন্নতির কথা ভেবে নিম রাজি বলা যায়।
তিন মাস যেতে না যেতেই বিপত্তি। বেশ চলছিল। ছেলে যে তরতর করে এগুচ্ছে দুদিন ওর পড়া ধরে বুঝে গিয়েছি।বেশ নিশ্চিন্ত ছিলাম। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি আবহাওয়া থমথমে। আঠারো বছরের ওপর ঘর-সংসার করছি। অভিজ্ঞতা বলছে কোনো একটা ঝড় বয়ে গেছে। স্ত্রীর গোমড়া মুখ দেখেই টের পাচ্ছি। একটু ফ্রেস হয়ে সবে বসেছি। নিশা চা দিয়েই বলল, “তোমার আদর্শ মাস্টার আজ টিটোকে মেরেছে। এত বড় সাহস আমার ছেলের গায়ে হাত দেয় ! আজই ওকে তাড়াবে নাহলে কিন্তু তুলকালাম হয়ে যাবে বলে দিলাম। “
“কেন? মেরেছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে? স্যার তো পাগল নন যে শুধু শুধু মারবেন?”
“যে কারণই হোক টিটো ওঁর কাছে আর পড়বে না ব্যাস। আমি কিন্তু আজ রাত থেকেই খাবার পাঠানো বন্ধ করে দিলাম। সন্ধেতে চাও পাঠাই নি। তুমি যাও আগে ওকে বিদেয় করে দিয়ে এস।”
টিটোকে ডেকে যা শুনলাম, স্যার একটা প্রবলেম বোঝাচ্ছিলেন, তখন টিটোর মোবাইলে একটি মেসেজ আসে।তার রিপ্লাই দিতে গিয়ে কয়েক মিনিট সময় যায়। তাতেই স্যার রেগে গিয়ে জোরে এক থাপ্পড় মারেন। এতে স্যারের কোনো অন্যায় দেখছি না। পড়ার সময় অন্য দিকে নজর যাবে কেন? রাগ তো হবেই। কিন্তু টিটো মানতে নারাজ।আজকালকার ছেলে, আদরে আদরে মানুষ। সে স্যারের কাছে আর পড়বে না,স্পষ্ট বলে বেরিয়ে গেল।ওদিকে নিশা গুম হয়ে আছে। প্রথম থেকেই নানা ছুতো খুঁজছিল। উটকো ঝামেলা বিদেয় করো। এবার একটা ছুতো পেয়ে গেছে, সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গেলে আপোষ করা ছাড়া উপায় কি? কিন্তু স্যার কে আমি কিভাবে বলব ভেবে কোনো কিনারা পাচ্ছি না।
স্যারের ঘরে ঢুকতেই স্যার বললেন,”আয় আয় দীপঙ্কর। জানি তুই আসবি। কি বলবি তাও জানি। ঐ দেখ,বইপত্র গুছিয়ে বেঁধে রেডি করে বসে আছি একমাত্র তোর অপেক্ষায়।”
আমি বললাম, ” কি বলব স্যার, আজকালকার ছেলে।আদরে আদরে মানুষ হয়েছে তো।”
“জানি, সেটা আমিও মাঝে মাঝে ভুলে যাই। শাসন করে ফেলি। এরজন্য অনুতপ্ত বা ক্ষমা চাইতেও পারি না,এটাই আমার চরিত্রের দোষ। আচ্ছা চলি।”
আমি বললাম, “এক মিনিট দাঁড়ান স্যার। এক্ষুনি আসছি।” বলেই ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে দশ হাজার টাকা এনে স্যারের হাতে গুঁজে দিলাম। ” এটা রাখুন স্যার।”
স্যার টাকাটা নিয়ে হা হা করে হাসতে লাগলেন। “আমাকে ঘুষ দিচ্ছিস? ছাত্র মাস্টারকে ঘুষ দিচ্ছে?” বলেই টাকাটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে হন হন করে হাঁটা দিলেন।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *