অলক জানার গুচ্ছ কবিতা
সহজাত দ্রাঘিমা পাঠ
গোলির মোড় থেকে ভেসে আসে পরিত্রাহি রিক্সার হর্ণ, পুরুষপাঞ্জা ও রিক্সার যুগপৎ
অঙ্গের আর্ত প্রদাহে ক্রমশ তীক্ষ্ণধার মার্চের দুপুর। গন্তব্যের নিকটে আসা বাসেদের তাগাদ-তাড়ায় খুববেশি মনেপড় যায় স্কুল লাইফের ভুলভাল অবোধ একরোখ। কতকিছু সঙ্গে নিয়ে
প্রহরপাঠের একঘেয়ে বিষাদ, চায়ের ক্যাটলির ধোঁয়ায় উড়ে চলে যায় মহাশূন্যে, দুপুর মানেই ছাপা-অক্ষর বইমেলা, যেখানে কয়েকটা ড্যাংরা কাকের নিরবধি উত্তরাধিকার চলে—
অগ্নি ও আশ্রয়
ব্রেকাপের পরই তার গীটার শেখার কথা মনে পড়েছিল, ভালোলাগা কী আর বলেকয়ে আসে? অকারণ কিছু দ্বন্দ্ব চিরকাল, কেমন ভেতর ভাঙতেই ব্যস্ত। এই সব অমসৃণ উচ্চারণ- মিসাইল, সুরে বাঁধার বিশ্বস্ত চেতনাকেও চোট করে, দুটো পা দাঁড়ের নিয়মে টেনে চলেছে শরীরের স্তব। পাড়ের দেখা আছে বলেই প্রতিটি যাত্রাই অবিরাম ও অগ্নস্রোত, হয়তো মৃত্যু অথবা নির্ভরযোগ্য কোন আশ্রয়, তেমন—
শ্রেষ্ঠ সংহারক
আমরা যখন পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ মন্ত্রক নিয়ে ভাবছি তখন আমাদের পোষা বেড়াল আবার গর্ভবতী,
ওর হয়ত বিশদে জানা নেই, বিয়ে মানে একটি নারীকে প্রতিদিন ধর্ষণ করার সামাজিক স্বীকৃতি অথবা ছাড়পত্র।
কোন কালেই সংসার বলে কিচ্ছু ছিলোনা, এভাবেই তৈরি মহানিষ্ক্রমণ প্রথার কৃষ্ণগহ্বর, প্রতিটি আবাসন কালগুণে প্রতীক্ষালয়ের আদলেই তৈরি, ফলত ভালোলাগার জন্মজ অসুখে মধ্যিখানে একটু বিরতি মাত্র, সন্তান উৎপাদন, খাই খেটে চিন্তা নাই মোটে-র খপ্পরে কেবল আটকে থাকা। সুযোগমত সংগোপন পালিয়ে বেড়ানোর বিলাসিতা, কর্তব্য আর মুগ্ধ মুখের আড়ালে থেকে গেছে চিরকাল, এর পরেও রাষ্ট্র অটল, পর্ণছবি সহযোগে গলা পেরিয়ে যাচ্ছে বাংলামদ, বিরতিহীন অবিচল বারুদদ্বেষ, রক্তক্ষরণের ভ্রুকুটি ! এসবের একটিও বিড়াল সমাজের না দরকারী আচার, গেরস্থের ওপর অপেক্ষার আস্থা রেখে ভুলে যায় দাঁত ও নখের সুচারু ব্যবহার, অথচ আমরা মানুষ, বিড়ালের স্বভাব ছাড়িয়ে ক্রমশ হয়ে যাচ্ছি হায়না।
লতামঙ্গেস্কর
আমি অভিমানে ধার নিয়েছি তোমার সুর, অনুরাগেও হেরফের নেই, বিরহের ঘা মেরামত হলে ফের হেঁটে যাই যখন যেদিকে কবিতা ডাক দেয় ! নির্ভুল সত্যও কখনো কদাচিৎ প্রতারিত, এসব কিছু কাহিনি কড়চা আমার ঝুলিতে সযত্ন গচ্ছিত–তুমি নির্ভেজাল সূর্যোদয় ভোরের মতো সত্য, যে সুরে সকাল রচিত হয় তার নাম ভারতবর্ষ।
দণ্ডভোগ
কী দারুণ টান ছিল শুরুর দিকে
একঝাঁক উড়ন্ত পাখির চঞ্চলতা মেশানো আগ্রহী সতর্কতা, পাঠক মগ্নতায় যত শীঘ্র নিজেদের পড়ে নেওয়া যায়। কার কি পছন্দ অপছন্দ ইচ্ছে অনিচ্ছের বাতিক, তেমন সব সংবেদনশীলতা। এভাবেই তৈরি একটি দেশ, একটি পরিবার একটি সম্পর্কও। শুরুর থেকে সময় দীর্ঘ হলে আশকারায় গাছাড়া স্বভাব, বরাদ্দের দণ্ডভোগ খরচ না হলে সহজ মৃত্যু
কে কবে উপহার পায় ?
বাসযোগ্য পুরের আয়ু
গণিতের পাশে রাখা আছে আমার সর্বাধিক অক্ষমতা, তাই জোড় সংখ্যার বিশুদ্ধ মাতৃত্বের কাছে দিনেন দিন বেড়ে যায় ঋণ, ঠকে-ঠকানোর সারবন্দি খেলার চক্রব্যূহে যে কোনদিন ঈশ্বরকেও দাঁড়াতে হয়। তখন নিজের ওপর ক্রোধের ১১০ ডিগ্রি জ্বর বসন্ত প্রস্তাবে ডেকে যায় কোকিল। রক্ত-কাম, আবেগের ঘরোয়া শরীর বেঁচে থাকার লোভে পথে ফেলে আসে বোঝা, যেটুকু ছায়ায় বাড়ি আসে, যেটুকু বাসা নেয় মনে তার কাছে পরাজিত আমি ও আমার সযত্ন শৃঙ্খলা, এভাবেই অল্পস্বল্প ভালোবাসার অপচয় কাছেদূরে থাকতে চায় বলে পৃথিবী এখনো বিশ্বস্ত বাসযোগ্য।
এই সময়
পাখিদের উড়া বারণ, হাওয়ার সারা শরীরে ধুলোর ঘা, ফলত সকাল-বিকেল গান রেওয়াজে গলা থেকে বেরিয়ে আসে সিরাম ভেজা রক্তের আর্তি। আততায়ী আকাশে পিরামিড তলার গুমোট, অবস্থান পালটে নিচ্ছে কালপুরুষ ও বিশুদ্ধ কতিপয় পারিবারিক তারা এখন টকসেন বৃষ্টির অতিথি দৌরাত্ম্য, বিব্রত বেসামাল সভ্যতা নির্ণায়ক জনতা ! পাখি ফুল আকাশে বাড়ন্ত চালের সংকোচ, এসব সামলে দু-একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসে ভুবনপাড়া।
অস্ত্রের কবিতা
আকর ও হাতুড়ির যৌথ তালিমে হিংসার তীক্ষ্ণতম পাঠগ্রহণ, পরে লাগাদার গলা ও ধড় কাটতে নামাতে খুনের চূড়ান্ত তকমা লাভ,
আঘাত অবহেলার নির্নিমেষ উজ্জ্বলতায় অস্ত্র
কেমন শাসকের রক্ষাকবচ, সময় কোথায় যে প্রেমিক হবে ? সাধু বা সুশীল যে কেউ হাতে তুলে নিলে বিপত্তির বাঁধ ভেঙে অনিবার্য রক্তের হোলি, এক একটি রাষ্ট্র অস্ত্রের নিচে চাপা পড়লেও প্রেমির হাতের ফুল কী দুঃসহ চিরদিন !
সরস্বতীবার
স্পর্শে তো অমরত্ব ছিলো, নাগাল ছাড়িয়ে হেঁটে যায় বাসন্তীশাড়ি, ছায়া-রৌদ্রের জরুলে ফুসমন্তর ভাসে, কাঁসরঘণ্টার শুভেচ্ছা সফর ছাড়িয়ে বাতাসে টুপটাপ নূপুরের গান—
কবিকে যথার্থ অনুবাদের একমাত্র পাঠক তুমি
একাকার অখণ্ড বাক্যে আসাই প্রসন্ন মেধা
কিসের অন্তরায়ে ভণিতার টিলা রচনা করো ?
আশ্চর্য উন্মুখ, পারদ নিয়মে এলে অনিবার্য কেটে যায় বীণার তার, এমন অনর্থ সরস্বতীকে মানায় না।
আশ্চর্য রুমাল
নিজের অবস্থান থেকে অন্য আর একটি অবস্থানের কথা সহজ ও হালকাবোধে ভাবা যতেই পারে, মন্তব্য খিল্লিখেউড় জলভাতের মতোই আওড়ানো যায়—অপরিণত বোধ,
এরকমটা কে ভেবেছিল ? এমন নয় অমন হলেই ভালো হতো,আমার ক্ষেত্রে হলে এই অনর্থ ঘটতেই দিতাম না, অন্যভাবে সাজাতাম, গুছিয়েই হতো সবকিছু, তিলধারণ অভিযোগ অনুযোগের জায়গা থাকতো না। আসলে সবই আগে থেকে সাজানো গচ্ছিত, পরিস্থিতিগুলো একটু পোশাক বদল করে আসে বলে অনুচিত এবং অস্বস্তির পারদ চড়ে যায়, নিয়তি নামক ললাটলিখন মুছে ফেলার মতো আশ্চর্য রুমাল নিদেন মানুষের হাতে থেকে ঈশ্বর সেই শুরু থেকেই কেড়ে নিয়ে গেছেন।
গুপ্তরোগ
পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণরেখা মুছে গেলে সম্পর্ক
মেরামতি সূচক শব্দবন্ধের ইন্তেকাল ফরমালো, বোঝাপড়ার গন্তব্য না জানি বিভাজিত, নাগাল ছাড়িয়ে বয়ে যায় রাস্তা ও সময়। যৌবন বরাবরই খুব পিচ্ছিল, অভিমুখহীন, যে কোন নাব্যতার হাতছানি ইশারায় তির তির বয়ে যেতে পারে। কোন কোন ছায়া পরিচিত নির্ভরযোগ্য মনে হলে পাশাপাশি একটু হেঁটে যাওয়ার বিরতি, যে যার গন্তব্যে সরে দাঁড়ালে
চৈতন্য লাভ ও মোহভঙ্গ আত্মদর্শন।
যাত্রী
কাটা ধানের গুচ্ছের মতো নিঃস্ব কিছু অতীতমুদ্রা
নিষ্ক্রিয় অঙ্গের আচরণে আমরণ থাক্, কর্ষণ কৃষিকাজ চলুক দেদার, পরিচর্যা প্রাণায়ামে ক্ষতমুখে প্রত্যয়ী শস্য হাসে। এভাবেই জরুরি গার্হস্থ্য পাঠক্রমে, মনোযোগী সময়
সচেতন ভুলে যায় মহানগরের সুচতুর রঙে, ভেজামুখ।
কিছু অপরাধ শামুক স্বভাবে ঢেকে রাখার চেষ্টা নিয়ে নীরবতায় নোঙর করে পৃথিবীর যাত্রী সকল—
এক তপস্যার নাম অপেক্ষা
জলের চেতনায় ভেসে যাচ্ছে ফুল বেলপাতা বিষণ্ণ হোমের কাঠ, আনন্দের রঙ ফিকে হলে
উঠোন ঘরে চৌকো আয়োজন, চেয়ে থাকার ঠিক একটি বছর কিংবা আরো কতদিন—-
এক তপস্যার নাম অপেক্ষা যাপন, এর মধ্যিখানে ধ্যান ভাঙার জন্য অজস্র ছলনা
পিছু পিছু গুটি পায়ে ফিসফাস, সময় তুলে রেখে ব্যস্তসমস্ত দু’হাতে খরচ হয়ে যায় পরমায়ুর প্রহরমুদ্রা, তোমার নীরবতা একটি ভাসানের মতো, আলোর আঘাতে যদি ফিরে আসো পাথরে হবে আবাদ, পাপড়ি চেয়ে বড়োবেশি নম্র হবে গাছগাছালির সমস্ত অস্থির কাঁটা।