খোয়াবের স্মৃতিকথা
কলমেঃ প্রা ন্তি কা স র কা র
জীবন মানেই অবসরে এক ঝাঁক স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসা। ফেলে আসা দিনগুলোর সুখকর রোমন্থন গুমোট বাঁধা ব্যস্তবাগীশ দিনগুলোর মাঝে মিঠে স্নিগ্ধ হাওয়ার মতোই মনকে ভরিয়ে তোলে। তাছাড়া কথায় বলে স্মৃতি শতত সুখের হয়।
“স্মৃতিকথা ” শব্দটা শোনা মাত্রই তাই ফিরে গেলাম নিজের শৈশবে, যেখানে হাজারো হাজারো স্মৃতি ছড়িয়ে আছে ফিরে দেখা দিনগুলোর আনাচে কানাচে। আমাদের বাড়ি ছিল মফঃস্বলে । বলতে গেলে মফঃস্বলের প্রায় শেষ সীমানায়, যেখানে এক মেঠোপথ মফঃস্বল ও গ্রামের মাঝে নীরব সন্ধি স্হাপন করেছিল। দুদিক বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে তামাটে রঙের মেঠোপথ না জানি গ্রাম বাংলার কতো স্মৃতিকে ধারণ করেছিল নিজের মধ্যে।
এই পথেই গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে ধান আসতো আমাদের বাড়িতে। আউস, বোরো, আমন বিভিন্ন সিজন অনুযায়ী আরও কত কী! শুধু ধান এলেই তো হলো না, বাড়িতে ধান ওঠার আগে নিতে হতো নানারকম প্রস্তুতি। সেই সময়টাকে যেন একটা সাজো সাজো রব ঘিরে রাখতো তার আবেশে। গোটা উঠোনের ঘাস পরিস্কার করে, উঠোনের গায়ে গোবর জলের মোটা প্রলেপ লাগানো হতো। যদিও ভোর বেলায় উঠোনে কচি ঘাসের ডগায় শিশিরের উপস্থিতির বদলে ধূসর উঠোন দেখলে মনটা একটু মোচড় দিয়ে উঠতো তবুও ধান ওঠার আনন্দ শিশু মনের সেই কষ্টকে ম্লান করে দিত নিজের উপস্থিতির জোরালো আভাসে।
ধানের বীজ বপন থেকে শুরু করে ধান কেটে বাড়িতে আনা পর্যন্ত এই গোটা প্রক্রিয়াটা দেখভাল করতো স্হানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। এই কাজে পুরুষ ও মহিলা উভয়েই যোগ দিত। মহিলাদের বেশভূষার ক্ষেত্রে যেটা লক্ষ্য করেছি, তারা হাঁটু অবধি কাপড় পড়তো এবং তাদের উর্দ্ধাঙ্গে শোভা পেত লম্বা হাতাওয়ালা শার্ট। কেউ কেউ আবার কোলের শিশুকে কাপড় বা গামছা দিয়ে কষে পিঠের সাথে বেঁধে কাজ করতো।
মেঠো পথ ধরে চলা ধান বোঝাই গরুর গাড়ির ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ যেন দিনের শুরুতেই মনকে এক ভালো লাগার আবেশে ভরিয়ে তুলতো। সারি দিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে গরুর গাড়িগুলো সেই সোনালী ধানের পাহাড়কে সমতলে নামিয়ে রাখতো আলতো হাতের স্পর্শে খুব যত্নে। উঠোন জোড়া সেই ধানের পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে চলতো আমাদের ফেলে আসা শৈশবের লুকোচুরি খেলা। কখনো কখনো সেই ধানের গাদাকে নিজেদের ভিটেমাটি সাজিয়ে চলতো কল্পনার নানারকম জাল বোনা।
এই ধানকে ঝেড়ে গোলা বন্দী করার দায়িত্ব ছিল মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কয়েকজন খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। জীবন ও জীবিকার তাগিদেই তারা সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে আমাদের নদীয়ার বাড়িতে আসতো। তাই এই মানুষগুলোর থাকা খাওয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্হা করতে হতো। বলতে গেলে এই ধান ওঠাকে কেন্দ্র করেই কয়েকদিন ধরে বাড়িতে একটা উৎসবের আমেজ খেলা করতো। উঠোনের এক দিকে একটা বিশাল বড় মাটির উনুন তৈরী করা হতো। তাকে ল্যাপা মোছা করে এমনভাবে সাজানো হতো , যেন মনে হতো কোন্ এক নববধূ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সংসার জীবনের সমস্ত বিষাদ, জ্বালা, যন্ত্রনা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার জন্য। বড় বড় চেরাই করা কাঠ সেই ঢাউস উনুনের মুখের ভেতর নির্বিকার চিত্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতো। নববধূর (উনুনের) বোধকরি সংসার জীবনের সকল সাধ আহ্লাদ , স্বপ্ন সেখানেই ধূলিসাৎ হয়ে মুঠোভরা ছাইয়ে পরিণত হতো।
বলতে গেলে প্রায় সারারাত ধরেই এই ধান ঝাড়ার কাজ চলতো। দিনের আলো ফুরিয়ে এলে বড় হ্যাজাক লাইট জ্বেলে ধান ঝাড়া হতো। তবে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ঘন্টা দেড় দুইয়ের জন্য ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়াটা ছিল সেই সময়ের একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই তখন হ্যারিকেন, কূপি এইসবের সাহায্য নিতে হতো। হ্যারিকেনের আলোর সাথে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক খোলা আকাশের নীচে রাতের পরিবেশটাকে যেন আরও অদ্ভুত এক রহস্য রোমাঞ্চে ভরিয়ে তুলতো। অন্যদিকে বড় বড় হাঁড়ি কড়াইয়ের গায়ে লোহার খুন্তির আওয়াজ রাতের নিঃস্তব্ধতাকে যেন বারবার ম্লান করে দিতে চাইতো।
তখনকার দিনে গ্রাম বাংলার মানুষগুলোর মাঝে অন্যরকম একটা সরলতা লক্ষ্য করতাম। অন্যকে যথাযোগ্য সম্মান দেয়া, সম্ভ্রম রেখে অপরের সাথে কথা বলা, যেগুলো হয়তো সময়ের সাথে সাথে খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে। এই ধান ঝাড়ার দিনগুলোতে সন্ধ্যার পর এইসব মানুষদের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতো নানারকম গল্পচারিতা। তাদের কাছ থেকে যেমন তাদের দেশ গাঁয়ের গল্প শুনেছি, তেমনি দাদুর থেকেও জেনেছি পূর্ব বাংলার কিছু কথা।
আমার দাদুদের আদি বাড়ি ছিল ওপার বাংলার ময়মনসিংহ জেলায়। দাদুর কাছেই শোনা তখনকার দিনে দাদুদের বড় বড় টিনের চৌচালা ঘর ছিল। বাইরে থেকে আগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সেইসময়ে আলাদা বৈঠকখানার ব্যবস্হা ছিল। সাধারণত এই বৈঠকখানার অবস্হান হতো বাহির বাড়ি প্রাঙ্গণে। বাড়ির মহিলারা বেশীরভাগ অন্দরমহলে থাকতেই স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। তাই বাইরে থেকে আগত অতিথিদের দেখভালের যাবতীয় দায়িত্ব থাকতো বাড়ির পরিচারকের ওপর। শুনেছি বাড়ির মহিলারা নাকি বাড়িতে থেকেই শিক্ষা গ্রহন করতেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই জন্মস্থান ও পরিচিত ভিটেমাটিকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানিয়ে তাঁদের এক বস্ত্রে এপারে এক নিরাপদ জীবনের খোঁজে চলে আসতে হয়। কেননা ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধে তখন সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা। পরের দিন থেকে পাসপোর্ট কার্যকর হবার আগে এপারে আসার শেষ সুযোগ ,তাই পৈতৃক ভিটেমাটির মায়া ছিন্ন করেই রিক্ত হস্তে তাঁদের পাড়ি দিতে হয়েছিল এপারের উদ্দেশ্যে। সে এক ভয়ঙ্কর রাতের কথা, যা আজ ইতিহাসের পাতায় কেবল স্মৃতি হয়েই রয়ে গেছে। এই স্মৃতি যাঁদের কাছে একদিন চরম বাস্তব ছিল, সেই মানুষগুলো আজ আর পৃথিবীতে নেই কিন্তু তাঁদের বলে যাওয়া সেই গল্পগুলোই যেন অনবরত স্মৃতির পথ বেয়ে আজও বয়ে চলেছে আমাদের রক্তে, মজ্জায় মজ্জায়।
আমার ঠাকুমার দাদা চাকরি সূত্রে কলকাতাতেই থাকতেন। সেই সূত্র ধরেই দাদুরা নদীয়া জেলার চাকদহে নতুন করে বসবাস শুরু করেন। এই চাকদহ নামটার সাথে লোকমুখে একটা পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। শোনা যায় ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যধামে আবাহন করে আনার সময় তাঁর রথের চাকা এই সমভুমিতে আটকে যায়। সেই জন্য এই জায়গার নামকরণ হয়েছিল চক্রদহ। পরবর্তীতে এই চক্রদহ থেকে পরিবর্তীত হয়ে তা হয় চাকদহ (চাকদা)।
শুনেছি দাদুরা যখন প্রথম চাকদহে আসেন তখন এই এলাকার লোকবসতি খুবই কম ছিল। চারিদিকে বেশ জঙ্গলের উপস্হিতি লক্ষ্য করা যেত। এছাড়াও বন্য জীবজন্তুর আক্রমণের আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যেত না। তাই প্রথম প্রথম বাঁশের মাচার ওপর ঘর করে তাঁদের বসবাস করতে হয়েছিল। চাকদার বাড়িতেই একটা বড় পুকুর আছে, যেখানে আগে বাঘ জল খেতে আসতো, বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই এই ঘটনার অনুমান করা হয়েছিল। পরে অবশ্য এই এলাকায় আস্তে আস্তে ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে।
এছাড়াও তখনকার দিনে বাড়িতে ডাকাত পড়ার একটা গল্প লোকমুখে প্রচলিত আছে। এখন মনে হতেই পারে ডাকাতি তো এখনকার দিনেও হয়, তাহলে এ আর এমন কী অভিনব ঘটনা! আসলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তখনকার আর এখনকার ডাকাতির ব্যাপারে কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। বড়দের কাছেই গল্প শুনেছি, সেই সময়ে নাকি ডাকাতরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে যে বাড়িতে ডাকাতি করতে যেত ,সেখানে চিঠি পাঠাতো। চিঠিতে ডাকাতি করার দিন ও তারিখের উল্লেখ করার সাথে সাথে সাবধান বানীও দেওয়া থাকতো যাতে এই কথা পাঁচ কান না হয়। শুনেছি তখনকার দিনের ডাকাতরা নাকি যথেষ্ট মার্জিত স্বভাবের ছিল। সেই সময়ে আজকের মতো ব্যাঙ্কের লকারে গয়না রাখার তেমন চল ছিল না। বাড়ির মহিলারা বুদ্ধি করে চাল, ডাল রাখার কলসির ভেতরেই তাদের প্রাণাধিক প্রিয় গয়নাগুলোকে লুকিয়ে রাখতো। তবে যাদের ভয়ে এই গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া, তাদের যে সেইসব গুপ্ত রত্নভান্ডার সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা ছিল , তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পেশা হিসেবে এই ভয়ঙ্কর পথকে বেছে নিলেও তারা যে একেবারেই মনুষ্যত্বহীন ছিল, তাও বলা যায় না। শুনেছি ডাকাতি করার আগে তারা বাড়ির মহিলাদের সবচেয়ে প্রিয় গয়নাখানা নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি দিত এবং বাড়ির মহিলাদের ‘মা ‘ বলে সম্বোধন করতো।আরও শুনেছি ডাকাতরা নাকি ডাকাতির পর ঐ মেঠোপথ ধরেই ধান ক্ষেতের মাঝ বরাবর গিয়ে রাতের অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে যেত।
আর আজ যখন কংক্রিটের নীচে চাপা পড়া সেই পথ ধরে সো সো শব্দে গাড়ি ছুটে যায়, অবাক হয়ে দেখি সময়ের পরিবর্তনকে। ফাঁকা ধান ক্ষেতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়ি, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তার ধারের ছোট ছোট হোটেলগুলো যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় সভ্যতার অগ্রগতিকে। ইতিহাসের বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে চলি এক ঊর্বর ভবিষ্যতের খোঁজে। যে ইতিহাস আজ “স্মৃতিকথা” হয়ে বারবার ধরা দেয় শৈশবের স্মৃতির পাতায়।
আজ নিজের কিছু স্মৃতিকথা লিখতে বসে কবি গুরুর একটা লেখার কথা খুব মনে পড়চ্ছিল। তারই কয়েকটা লাইন তুলে ধরলাম এই লেখায় …
” কত কী যে আসে কত কী যে যায়
বাহিয়া চেতনা বাহিনী,
আঁধারে আড়ালে গোপনে নিয়ত
হেতা হোতা তারি পড়ে থাকে শত
ছিন্ন সূত্র বাছি শত শত
তুমি গাঁথ বসে কাহিনী
ওগো একমাত্র, ওগো অগোচরা,
ওগো স্মৃতি — অবগাহিনী “।।
আজ যা বর্তমান, কাল তাই অতীত হয়ে ধরা দেবে ভবিষ্যতের স্মৃতির পাতায়। হয়তো আমার মতোই কেউ আবার সেদিন তার স্মৃতিকে তুলে ধরবে নতুন কোন স্মৃতিকথায়।