সহজ মানুষ-সহজপাঠ (ঊনত্রিশতম পর্ব)

ধারাবাহিক গদ্য পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা।

ধারাবাহিকেরর পরবর্তী অংশ…

পদ্ম পাতায় জল(৩)

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়

মা সারদা ছিলেন সাক্ষাৎ দেবী । তিনি নিজেই
বলে গেছেন “ছোট থেকেই আমি কারোর দোষ
দেখতে পেতুম না। দোষ তো মানুষই করে “। তাকে
সেই ” দোষের ” রাস্তা থেকে, গুনের পথে, ভালোর পথে, সরল পথে, নিয়ে আসতে হবে।

সমাজে, সংসারে , ঘরে , বাইরে আমরা একে
অপরের দোষ ধরার জন্য মুখিয়ে বসে থাকি। আর এর থেকেই যত মতান্তর শুরু হয়। তোর
গাছের পাতা কেন আমার সীমানায় এসে পড়বে? তোদের বিড়ালটা এসে কেন আমাদের
রোদে- দেওয়া- বিছানায় শোবে? ধুন্ধুমার শুরু
হয়ে গেল দুই প্রতিবেশী র মধ্যে । দোষ ধরার
প্রতিযোগিতা। সব “তোদের “দোষ। ভালো কিছু
হলে – ” আমি ” আর ” আমার “। মন্দ কিছু
হলে ” তুই “, না হয় ” তোরা, না হয় ” তোদের ” দোষ।


    গাছের পাতা যদি প্রকৃতির নিয়ম মেনে সবুজ
থেকে হলুদ হয়ে গাছ থেকে ঝড়ে পড়ে, আর হাওয়া তাকে দোল খাইয়ে এনে ফেলে তোমার
সীমানার মধ্যে, তাহলে এটা কার দোষ? কে
এখানে দোষী ? ও বাড়ির নিরীহ বিড়ালটি তার
অভ্যেস মত, যদি একটু আরামের লোভে শুয়েই
থাকে কিছুক্ষণ তোমাদের রোদে – দেওয়া বিছানার ওপর – ওগো, কার কাছে অভিযোগ জানাবে? কে নেবে সেই অভিযোগ পত্রখানি?

তাই এখানে আজকে , মা সারদার সেই যুগান্তকারী উপদেশটি উল্লেখ করি, যার প্রথম
দুটি লাইন আমাদের মত সাধারণ মানুষদের জন্য বলা, আর শেষ লাইনটা জগত বাসীর উদ্দেশ্যে বলা। আর সম্ভবত এটিই মায়ের জগত
সংসারকে দেওয়া তাঁর অন্তিম উপদেশ। এটি তিনি বলেছিলেন এক গৃহী ভক্তকে। ” যদি শান্তি চাও , মা,কারও
দোষ দেখো না, দোষ দেখবে নিজের। জগতকে
আপনার করে নিতে শেখ , কেউ পর নয় মা,
জগৎ তোমার। “
উপদেশটি মা সারদা শুরুই করেছেন “শান্তি ” র বানী দিয়ে । সমাজে, সংসারে আজ শান্তির বড়
অভাব। মা জানতেন অশান্তির একটাই কারণ আর তা হলো দোষ ধরার প্রবনতা। তাই তিনি
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শান্তির পথ নির্দেশ
করেছেন প্রথম অংশে।
আর উপদেশটির দ্বিতীয় অংশে ” সমগ্র জগতকে আপন আত্মার আত্মীয়, আপনজন
ভাবতে, শিক্ষা দিয়ে বলেছেন,– তা হলে দেখবে
জগত তোমার কাছে সহজ হয়ে গেছে। যা শাশ্বত সত্য। চিরন্তন সত্য।কবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় —- “সকলের তরে
সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
যদি আমরা ভাবি দোষটা তো আমারই, তাহলে
কিন্তু অনেক গোল মিটে যায় । তাই মা বলেছেন
‘ দোষ দেখবে নিজের। ‘ কত গভীর আর গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ মা সারদার। যদি ভাবি সত্যিই তো,ওর সঙ্গে সঙ্গে আমারও তো এখানে
দোষ রয়েছে, একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে তাহলে কিন্তু সমস্যা অনেক হাল্কা
হয়ে যায় । আর এই মানসিকতা তখনই আসবে
যখন তুমি ভাববে ” কেউ পর নয় মা, ” – সবাই
তোমার আপন। এমনকি এই পার্থিব জগত, তার
সমৃদ্ধি, তার সম্পদ, তার মানুষজন, তার পশুপাখি, তার ভূমি, তার পট, তার পটভূমি সর্বত্র
তোমার ও একটা ‘ আপন’ ভূমিকা রয়েছে।অলক্ষ্যে। তুমি হয়ত সোজাসুজি দেখতে
পাচ্ছ না। তবে অস্বীকার ও করতে পারবে না।
এটাই আন্তর্জাতিক চিন্তা ধারা, যা মা সারদা আজ থেকে দেড়শো বছরের ও আগে তাঁর মননে
এনেছেন । এটাই পরম বিস্ময়ের ! এই বোধ,
এই ভাব, তাঁকে বিশ্বমাতৃত্বের আসনে বসিয়ে দিয়েছে । একজন লেখাপড়া না জানা,শিক্ষার
আলো- না- ঢোকা এক অত্যন্ত সাদামাটা গ্রামের মেয়ে কী অসামান্য চিন্তা বহন করে এসেছেন, মনে মনে – এই গোটা জগত ব্রহ্মান্ড আমার।
আমার চিন্তার বস্তু। আমি অংশীদার এই বিশ্ব –
মাতৃত্বের । তাই সত্য সত্যই, মা সারদা , তাঁর
অন্তরের ভালবাসার প্লাবনে, মাতৃত্বের মহিমায়
সারা জগতকে আলোকোজ্জ্বল করে গেছেন।
★★
যে উপদেশ টি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করা
হলো সেটি মা উচ্চারণ করে ছিলেন তাঁর মহা –
প্রয়ানের মাত্র পাঁচদিন আগে। মা’র শরীর তখন
অত্যন্ত খারাপ।কোনো ভক্তকেই মায়ের সাথে
দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সে সময় মা’ র ভক্ত, অন্নপূর্ণার মা নামে পরিচিতা এক মহিলা,
মার ঘরে ঢুকে মা’ কে দর্শন করতে না পেরে,

দরোজার বাইরে বসে অঝোর নয়নে কাঁদছিলেন। পরিস্থিতি তখন যা ছিলো সেখানে
উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারছিলেন মা ‘ শেষ যাত্রার’ জন্য তৈরি হচ্ছেন। এক অস্বস্তিকর
পরিস্থিতি ।উদ্বেগপূর্ন বাতাবরণ।

হঠাৎ, মা, তাঁর শয্যায় পাশ ফিরলেন আর ঠিক
তখনই তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অন্নপূর্ণার মায়ের
দিকে।ভক্তটির কান্নাকাটি দেখেই মা সারদা বুুঝে
গেছিলেন তাঁর সেবকরা তাকে তাঁর কাছে যেতে
নিষেধ করেছে । আর সেজন্যই এতো অশ্রু বিসর্জন। মা সারদা হাতের ইশারায় তাকে কাছে
ডাকলেন । অন্নপূর্ণার মা, মায়ের কাছে গিয়েই তাঁর পদতলে পড়ে বলতে শুরু করল “মা, তুমি
চলে গেলে আমরা কী নিয়ে থাকবো? “
জবাবে মা সারদা বললেন, ” তুমি তো ঠাকুরকে
দেখেছ, তোমার আবার ভয় কী ? ” তারপর
কিছুক্ষণ পর স্থির শান্ত কণ্ঠে বললেন, — তবে
একটি কথা — ” যদি শান্তি চাও মা, কারোর
দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগতকে
আপনার করে নিতে শেখো,কেউ পর নয় মা,
জগত তোমার”।
★★

মা সারদার সন্তানদের উদ্দেশ্য, মা’ য়ের উচ্চারিত
শেষ উপদেশটি পাবার জন্য, আমাদের কৃতজ্ঞতা
জানানোর দরকার -সেই বিশিষ্ট ভক্তিমতী মহিলা
‘অন্নপূর্ণার মা’ কে। কেননা, তিনিই সেদিন আমাদের
সকলের হয়ে মা’ য়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মার অবর্তমানে আমাদের কী হবে?

আমরা, যারা ঠাকুর – মা- স্বামীজীকে সর্বদা
মনে ধারণ করে আছি, তাঁদের পুন্যময় জীবন –
কথা পাঠ করি বা লেখালিখি করি — তারা মায়ের
এই উক্তিটির সঙ্গে ভীষণ ভাবে পরিচিত । অজস্র বার পাঠ করেছেন। কারোর কারোর তো
বোধহয় মুখস্থ হয়ে গেছে।
কিন্তু একটু গভীর ভাবে যদি ভাবেন- তাহলে
দেখবেন এই ক’ টি লাইন উপদেশের কী বিপুল
ব্যাপ্তি। কত গভীরতা!
আমি আগেই বলেছি, তোমার গাছের পাতাটি
যদি আমার সীমানার মধ্যে এসে পড়ে অথবা
তোমার পোষা বেড়ালটি যদি এসে জুটে যায়
আমাদের বিছানায়? তাহলে কার ” দোষ “?
এই দুটো ছিলো অত্যন্ত হালকা উদাহরণ । আরও
অনেক অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায়। যা অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক।

ছোট ভাই বাড়ি বিক্রি করতে চায়না। পিতৃভিটে।
পিতৃভূমি প্রোমোটারকে দেব না। গোঁ ধরে বসে
রইল। বড় ভাই সুপার কিলার যোগাড় করলো।
ভাইকে জাহান্নামে পাঠাও। তার ” দোষ ” কি? সে
একটা সাবেকি আদর্শ ধরে বসে আছে।
খবরের কাগজ খুললে এমন খবর প্রায় প্রতিদিন
পাওয়া যায় ।
কলেজে পড়তে এসেছি। সিনিয়র দাদাদের
কথামতো বিশ্রী গালাগাল দিতে পারব না। শুধু
এই” দোষে ” জুনিয়র ছেলেটিকে শারিরিক নির্যাতন করে হাসপাতাল পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
এর নাম না কি নবীনবরণ অনুষ্ঠান!
এমন দোষে দোষী- মানুষদের শুভবোধ আর শুভ
বুদ্ধির দিকেই মা সারদার নির্দেশ, ” যদি
শান্তি চাও, মা, কারোর দোষ দেখো না। দোষ
দেখবে নিজের ।… ”
মায়ের, শুধু এই একটি মাত্র উক্তির ওপর ভিত্তি করে, এই কয়েকটি লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে, বেশ
কয়েকটি মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান,রাষ্ট্রবিজ্ঞানএবং নীতিবিজ্ঞানের
মোটা মোটা পুস্তক লেখা যেতে পারে । শুধু
আমাদের আর ‘ অন্নপূর্ণার মা’ কে নয়– এ উপদেশ সবার জন্য । ” যারা এসেছে , যারা আসেনি আর যারা আসবে অনাগত ভবিষ্যতে —
এ মহাবাক্যটি সব মানুষের শান্তির রক্ষাকবচ।

চলবে…

তথ্যসূত্র : ১) “জন্ম জন্মান্তরের মা” সারদা সে
বালিকা।। দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত।। পৃ: ১৯৩।।
২) দুটি বাণীর আলোকে মাতৃদর্শন।। তরুণ গোস্বামী।। পৃ: ৩৯১।।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *