সহজ মানুষ সহজ পাঠ(ছাব্বিশতম পর্ব)

ধারাবাহিক গদ্যঃ পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

পরবর্তী অংশ 

হে মহাজীবন

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়

দেবাদিদেব মহাদেব কৈলাসে বসে অনন্ত আত্মশক্তির চিন্তা করছেন। শিবশম্ভুর পাশে আছেন নন্দী। শিবের শক্তি হিমালয়- কন্যা মা ভগবতী, স্বামীর সঙ্গে এই অন্তর্মুখী ভাবনার গতিস্রোত অনুধাবন করছেন। সমগ্র জগতবাসীর চিন্তা তাঁদের। আকাশ বাতাস পাহাড়ের কোল ঘেঁসে থাকা অরন্যানীও যেন আজ মহাদেবের সঙ্গে চিন্তামগ্ন। পাহাড়ি ঝর্ণার উচ্ছ্বাস যেন কিছুটা হলেও ম্রিয়মান। এমন সময় গোটা পাহাড় প্রকৃতি কাঁপিয়ে এক গগনভেদি আওয়াজ! কী হলো? উৎকন্ঠিত মুখে নন্দী জিজ্ঞেস করলেঃ “কীসের এত ভয়ানক আওয়াজ প্রভু?” যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে শিবশম্ভু একবার এই মহাজগতটাকে দেখলেন তাঁর চোখ মেলে। তারপর বললেন, “রাবণের জন্ম হলো।”

নন্দী বিচলিত হলেন একটু। দেবী দুর্গা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন তার জন্য এত
ভয়ানক আওয়াজ কেন? এটা কিসের ইঙ্গিত?
ঠিক তখনই আবারও একই রকম বিভৎস কর্ণভেদী শব্দ। নন্দী জিজ্ঞেস করলে “প্রভু, — এবার কিসের শব্দ? “শিব হেসে বললেন, “এবার রাবণ বধ হল”।


এই কাহিনীটি বলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কিভাবে
জীবজগত নিত্য ঈশ্বর থেকে সৃষ্টি হয়ে জলের
বুদবুদের মতো ‘কিছুকাল’ পরে আবার ঈশ্বরেই
সমাহিত হয়ে যায় — সেই প্রসঙ্গে আমাদের
বুঝিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ, গীতাতে বলেছেন, ” আমি অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতে কী ছিল, কী আছে এবং পরে কী হবে সবই জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।” আবার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তৃতীয় পান্ডব কৃষ্ণসখা অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহিত করতে বলেছেন, আমরা দুজনেই পরস্পর পরস্পরকে জানি।
দুজনেই বহুবার এই জগতে, অতীতে জন্ম নিয়েছি, তুমি সে সব আগেকার জন্মের কথা ভুলে গেছ কিন্তু আমি ভুলিনি “। সাধারন সংসারী মানুষ যদি অতীত মনে রাখতে পারতো, তাহলে জীবনে কারোর কোনো গোল থাকতো না। বরং আগের
জন্মের ভুলভ্রান্তিগুলো এ জীবনে সে সংশোধন করে নিতে পারতো। সদিচ্ছা থাকলে গড়ে নিতে পারতো অনেক কিছু। যেমন এক ত্রুটিহীন, স্বচ্ছ, সুন্দর, আদর্শ এবং প্রীতিময় জীবনধারা। তাই ভগবান সব ভুলিয়ে দেন। ভুলিয়ে দেন গতজন্মের গতিধারা।

★★

এই যে আমরা আজ আলোচনা করছি, কাল- খন্ডকাল- মহাকাল- অনন্তকাল এসব নিয়ে,ঠাকুর
এই প্রসঙ্গে এটাই বলেছেন যে, ” জীব নিত্য
ঈশ্বর থেকেই জন্ম নিচ্ছে আবার স্বল্পকাল পরে
ঈশ্বরেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মধ্যে কিছুটা সময়
জলের বুদবুদের মত ভেসে বেড়াচ্ছে জলের মধ্যেই। অর্থাৎ আমাদের জন্ম, কর্ম এবং বিলোপ
সবই ঈশ্বর থেকে, ঈশ্বরের মাঝে এবং ঈশ্বরেই।

বুদবুদ জলের মধ্যেই সৃষ্টি হয়। এর উৎস হল জল। সৃষ্টির পর কিছুটা সময় সে জলের মধ্যেই
স্বচ্ছন্দ স্বাধীন স্বাভাবিক ভাবে জলেই ঘোরাঘুরি
করে। তারপর কালের নিয়মে জলের মধ্যেই
বিলীন হয়ে যায়। যেখান থেকে শুরু সেখানেই
সমাপ্তি। ঈশ্বরে শুরু আবার ঈশ্বরেই শেষ।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপমা আর উদাহরণ দিতেন
কথায় কথায়। তাই বলা হয় ” উপমা রামকৃষ্ণস্য”।
কথামৃতে ঠাকুর বলেছেন, ” যে দুধের কথা কেবল
শুনেছে – সে অজ্ঞান। যে দুধ খেয়েছে তার জ্ঞান
হয়েছে আর যে দুধ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তার বিজ্ঞান
হয়েছে। ”
অর্থাৎ যে ঈশ্বরের কথা কেবল শুনেছে, সে অজ্ঞান। যে ঈশ্বর দেখেছে তার জ্ঞান হয়েছে, আর
যে দিনরাত সর্বদাই ঈশ্বরে লিপ্ত, ঈশ্বরে একাত্ম
সেই প্রকৃত ঈশ্বরদর্শী, অর্থাৎ বিজ্ঞানী।

তাঁর চোখে দেখা পরিমন্ডল এতো বিশাল এবং
তার থেকে যে দর্শন তিনি খুঁজে বের করেন তা
এককথায় অনন্য। তেমনই বলেছেন, ” যেমন
পায়ে কাঁটা ফুটেছে। তখন আর একটি কাঁটা
জোগাড় করে এনে দ্বিতীয় কাঁটাটি দিয়ে প্রথম
কাঁটাটি তোলা। অর্থাৎ জ্ঞান- কাঁটা দিয়ে অজ্ঞান
কাঁটা তুলে ফেলা পরে দুটো কাঁটাই ফেলে দেওয়া।
তখন ঈশ্বরের সংগে একীভূত, শুধু দর্শন।

রাবণের জন্ম আর রাবণ বধ – এই দুটোর মধ্যে
বহু যুগের ব্যাবধান। অনেক অনেক ‘ কালের ‘
ফারাক। এই ” কালের ” দৃষ্টি আর দর্শন বুঝতে
গেলে ঠাকুরের দৃষ্টিকে আমাদের অনুসরণ করতে
হবে। মানুষ যাকে ” কাল ” বলে, ঠাকুরের দৃষ্টিতে
তা আপেক্ষিক। কোন্ প্রেক্ষিতে আমরা ঘটনা
দুটি দেখছি? তা আগে বুঝতে হবে।
আমাদের কাছে এই দুটো ঘটনার মাঝে অনেক
কিছু রয়ে গ্যাছে। যেমন, রাবণের উত্থান, শ্রীরাম
চন্দ্রের আবির্ভাব, রাম- সীতার বিবাহ পর্ব, রাজা
দশরথের কৈকেয়ীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, তার ফল
স্বরূপ রামচন্দ্রের বনবাস, সীতাহরণ, হনুমানের
বীরত্ব, রাম- রাবণের যুদ্ধ – কতো কী! কিন্তু কৈলাসে? দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটল প্রথম ঘটনার
খানিকক্ষণ পরে। ব্যাক্তিগত কাল – তার চেতনার
উদ্ভব ব্যাক্তির মনে। আর অন্য” কাল” টি দীর্ঘস্থায়ী। এটি আত্মার শক্তি ও মনের ওপর প্রতিফলিত। একেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ “মায়া — ঈশ্বরের মোহিনী শক্তি।”

।।তথ্যসূত্র।।

ক) কথামৃত।। দ্বিতীয় খন্ড।। পৃষ্ঠা ৬৫৫খ) “উদ্বোধন” -শারদ সংখ্যা ১৪২৭।। পৃষ্ঠা ৬৯৪

চলবে..

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *