বাবুই পাখি
প্র দী প ভ ট্টা চা র্য
সেদিন নাতিকে বাবুই পাখি, বাবুই পাখির বাসা জোনাকি এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে খুব সমস্যায় পরেছিলাম। জোনাকি কি কেমন দেখতে এসব বােঝাতে গিয়ে সমস্যা। আমি এখন আর জোনাকি দেখিনা। বাবুই পাখি, বাবুই পাখির বাসাও দেখিনা। আমি যেখানে বড় হয়েছি সেই দিনহাটায় খুব সামান্য কিছু বাড়িতে বিদ্যুৎবাতি ছিল। লেখাপড়া থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকার ঘােচাতে লক্ঠন একমাত্র ভরসা ছিল। মায়েরা রান্নাঘরের কাজ কর্ম লম্ফ দিয়েই করতাে। বাড়িতে কোন বিয়ে বা ঐ জাতীয় কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে হ্যাজাক বা পেট্রোম্যাক্স ভাড়া করা হােত। বাড়িতে হ্যাজাক জ্বললে আমরা ছােটরা সবাই হ্যাজাকের চারপাশেঘুরতাম। সাধারণ সময় সন্ধা হলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর হাজারে হাজারে জোনাকি জ্বলছে নিভছে। এখন যেমন পলিউসান তখন এতাে পলিউসান নিশ্চয়ই ছিলনা তাই রাতের আকাশে সন্ধাতারা, সপ্তর্ষিমন্ডল, ছায়াপথ, ভােরে ধ্রুবতারা আর অগনিত নক্ষত্ররাজী সুন্দর দেখা যেত। সন্ধে হলেই তারা দেখা যেত।
আমরা খেলতাম এক তারা মাটি-বটি, দুই তারা বেগুন-বটি, তিন তারা নাহি ভয় চারতারায় ঘরে ওঠ।” এখন ভাবলে অবাক লাগে। এখনতাে আকাশ দেখাই সমস্যা। আমরা চাদের যােলকলাই দেখতে পেতাম। যােলকলা শেষে পুর্ণিমা। পূর্ণিমার মােহময় আলাে অপূর্ব। পূর্ণিমার দিন আমাদের খুব আনন্দ হােত। আবার অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা নারকেলের খােলার মধ্যে মােমবাতি জ্বালিয়ে টর্চ বানাতাম। জানাকি কি শুক্লপক্ষ কি কৃষ্ণপক্ষ সব-সময়েই সম্ধের পর হাজারে হাজারে দেখা যেতাে। অন্ধকার রাতে মনে হােত হাতের কাছে অসংখ্য গ্রহ-তারা ঘুরে বেরাচ্ছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা এই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য থেকে বঞ্চিত। জানিনা এখনও গ্রামাঞ্চলে জোনাকি দেখা যায়। নাকি। নাকি জোনাকি অবলুপ্ত পতঙ্গ! আর একটা বিষয় বুঝতে পারছিনা এখন বাবুই পাখিও দেখিনা বাবুই পাখির বাসাও দেখিনা। দু-চারটে সুপুরি গাছ যাও বা আছে কিন্তু তাতে বাবুই পাখির বাসা দেখিনা। সুপুরি গাছে অথবা নারকোল গাছের ডালে অনেকগুলাে করে বাসা ঝুলছে। কি যে ভাল লাগতাে দেখতে। আস্তে আস্তে এরকম অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। বৌ কথা কও পাখি, এখন আর দেখিনা। নিশ্চয়ই যেখানে গাছপালা জঙ্গল অনেক বেশী, সেখানে নিশ্চয়ই দেখা যায়। খেলাধুলােয় ব্যাতিক্রম নয়। মােবাইলে নানা ধরণের গেম এখন শিশু কিশােরদের অন্যতম আকর্ষণ। আমাদের ছােটবেলায় সব ছেলে মেয়েদেরই মাটির সাথে মাঠের সাথে সম্পর্ক ছিল। আমরা সবাই স্কুল থেকে আসার পর নাকে মুখে গিলেই আশে পাশের মাঠে অথবা ধানকাটা হয়ে গেছে এমন ফাকা খেতে চলে যেতাম। এক্কা-দোক্কা’ ‘গো ছুট’, ‘ডাংগুলি’, ‘দাড়িয়াবাধা’, ‘বুড়ি ছিঃ’, ডাঙ্গা কুমীর- এসবই ছিল আমাদের খেলা। এখনকার বেশীরভাগ ছেলে-মেয়েরা এসব খেলার নাম শােনেনি। অবশ্য ওদের কোন উপায় নেই। সকাল সাতটায় স্কুলে যায় তিনটে নাগাদ এসে খেয়ে আবার ছুটতে হয় টিউশনে ফলে ওদের আর মাটির কাছাকাছি যাওয়া হয়না। আমি অবশ্য মনে করিনা যে এটা ওদের পক্ষে ভাল না। ওরা তাই করছে এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে বাস করে, এই আত্মসৰ্বস্যতার যুগে বাস করে ওরা এক একজন বিবেকহীন পুতুলের মতাে হয়ে উঠেছে। অন্ততঃ আমার তাই মনে হয় আমার ছােটবেলার সাথে এখনকার সবচেয়ে বড় যে পার্থক্যটা আমার চোখে পড়ে তা হােল পারস্পরিক সৌভ্রতৃত্ব আন্তরিকতা। সবাই মিলে একসাথে খেলার ভিতর দিয়ে পরস্পরের সাথে পরস্পরের যে সখ্যতা, যে আন্তরিকতা গড়ে উঠতাে তা এখন প্রায় দেখিনা। এখনকার শিশু, কিশােররা বেশীরভাগ অংশ যে সামান্য সময় পায় তা ব্যয়িত হয় নিজের স্মার্টফোনে গেম খেলায় অথবা ঘরে বসে টিভিতে কোন পছন্দের অনুষ্ঠান দেখে।
যেখানে শুধুই আমি। একাকী। একাকিত্বই এখনকার শিশু কিশােরদের সঙ্গী। ফলে সৌভ্রতৃত্ব গড়ে উঠছে না। এটা একটি সমাজের একটি দেশের পক্ষে খুবই বেদানাদায়ক। এই বিচ্ছিন্নতা সর্বধর্ম সম্প্রতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুবই অন্তরায়।
আমার মনে আছে মান্দু মিঞা আমাদের মান্দু চাচা। বাবার সাথে খুবই সখ্যতা ছিল। আলাউদ্দিন ডাক্তার প্রায় প্রতি সন্ধায় আমাদের বাসায় আসতেন, আরাে দু-একজন নিয়মিত আসতাে সবাই মিলে গল্পগুজব করে রাত নয়টা-দশটা নাগাদ যেতাে। আলাউদ্দিন চাচার ছেলে ফয়জল আমাদের খুবই বন্ধু ছিল। আমরা একসাথে খেলাধুলাে করতাম। একসাথে স্কুলে যেতাম। হিন্দু-মুসলমান এসব কিছু কখনও ভাবিনি অথবা ভাবার বিষয় বলে মনেও হয়নি। আমার কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে আলাউদ্দিন চাচা এবং ফয়জল আমাদের বাড়িতে শনিপুজোর সিন্নি খেয়েছে। কোন সংকোচ ছিলনা। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম বাবুই বাসা আর জোনাকি। কিন্তু আরাে কত কিছু যে হারিয়েছি। অনেক কিছুই এখন স্বপ্ন মনে হয়। হয়তাে অন্য প্রসঙ্গ মনে হবে তা হলেও পরিবর্তনটা খুবই চোখে পরে। সেটা হােল জন্মদিন উদ্যাপন। সময়ের সাথে জন্মদিন পালনের খােলনলচে পাল্টে গিয়ে ভালবাসার উষ্ণ পরশ কি হারিয়ে গেল। জন্মদিনের অনুষ্ঠান তখনও গরীব বড়লােক সবার বাড়িতেই হােত। আয়ােজনেও খুব একটা পার্থক্য ছিলনা। জন্মদিন মানেই থালা ভর্তি পায়েস সাজিয়ে দিয়ে বাবা-মা বাড়ীর সব গুরু জনেরা ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। শঙ্খ বাজতাে, কপালে প্রদীপ ঠেকিয়ে সন্তানের মঙ্গল কামনা করতেন। গরীব বড়লােক ভেদেথালা ছােট বড় হতে পারে কিন্তু উপাচার একই থালা ভর্তি পায়েস ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ। এখন অবশ্য পায়েসের রেওয়াজ আছে তবে তা নিছকই গৌন বিষয় হয়ে পরেছে। মানুষের চাওয়ায় কিছু যায় আসেনা।তবুও আমাদের বিশ্বাস মা-বাবার পরম স্নেহের শুভকামনার আশীর্বাদ নিশ্চয়ই ফলপ্রস হয়। আজকের দিনে জন্মদিনে অন্যান্ন বাহ্যারম্বরে ধান দূর্বার আশীর্বাদ খুবই গৌণ অথবা অপ্রয়ােজনীয় হয়ে পরে। কেক, বেলুন হ্যাপি বার্থ ডে গানে স্নেহাশীষ” শব্দটা যে বেমানান। এছাড়াও জন্মদিনে উইশ করাটা একটা স্টেটাস-এর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মােটের উপর আমার চোখে জন্মদিনের সেই প্রানবন্ত এবং অকৃত্তিম স্নেহ-ভালবাসার জায়গাটা বাহ্যারম্বে এবং অনেকটা লােকদেখানাের প্রবণতা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ধান, দূর্বা, প্রদীপের থালা হাতে মা-র আশীর্বাদের পরম মমতাময়ী ছবি। এরকম আরাে অনেক কিছুই খুঁজে পাই যা আমাদের সময়ের সাথে মেলাতেই পারিনা। সে সবকথা অন্য কথা অন্য সময় বলা যাবে।