খানা-খাজানায়- “কাবাবের ইতিহাস”

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

কাবাবের ইতিহাস

সু ক ন্যা   দ ত্ত

 

মহঃ হুমায়ুন কবীর তার একটি কবিতায় লিখেছিলেন, –
“চিংড়ি-পোলাও, কোর্মা-কাবাব, ইলিশ মাছের ঝুল
অল্প এসব খেয়ে কি আর পেট হবেরে ফুল?
আরো নিয়ে আয় লাচ্ছি-মিষ্টি, ফালুদা আর শেক,
খাওয়ার সময় গিলতে আমি পাই যেন জোড়-বেগ!”
এই লাইনগুলোতে ভোজনবিলাসী বাঙালীর রসনাতৃপ্তির ইতিহাস ফুটে উঠছে। তবে নিজের উদরপূর্তিকে বাঙালি কেবল বাঙালিয়ানার গন্ডীতেই বেঁধে রাখেনি।দেশ বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন পদ এসে জুটেছে হেঁসেল এ। পথের ধারে গড়ে উঠছে চীনা, ইতালিও, মেস্কিকান, থাই প্রভৃতি খাবারের দোকান। আটপৌরে ভাত- ডালের বাইরে মানুষ একটু মুক্তি খুঁজছে । থালায় পঞ্চ ব্যঞ্জনে যোগ হয়েছে উপমহাদেশীয় খাবার৷ আজ সেই তালিকা থেকে তুলে আনবো কাবাবের ইতিহাস।

কাবার শব্দের অর্থ রোষ্ট।মধ্যযুগে তুরস্কের সৈন্য রা খাবারের জন্য পশু শিকারের পর সেগুলো কে তরোয়ালের মধ্যে গেঁথে আগুনে ঝলসে খেতো। ১৩৭৭ সালে তুরস্কের লিপিতে “কাবাব- ই ইউসুফ” শব্দটির অর্থ জানা যায়। হয়তো এই শব্দটির মাধ্যমে কাবাব কে বোঝানো হয়েছে। আবার পারস্য শব্দ ‘কম’ ও ‘আব’ অর্থাৎ ‘কম জল’ থকেই কাবাবের জন্ম বলে মনে করা হয়। এই নামকরণের কারণ হিসাবে বলা যায় কাবাব তৈরির সময় কোনোরকম জলের প্রয়োজন হয় না বলেই হয়তো এমন নামের উৎপত্তি।
অনেকে মনে করেন কাবাবের জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে। তবে রান্নার প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি ‘ক্ষেমকুতূহলম’-এ কাবাব পদটির উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়৷ রামায়ণ ও মহাভারতের মতো পৌরাণিক কাব্যেও কাবাবের উল্লেখ রয়েছে। যেখানে হরিণ ও খরগোশের প্রভৃতি প্রাণীর মাংস, খোলা আকাশের নীচে পোড়ানোর কথা বলা আছে। কূটনীতিক সাদ উর রহমান রচিত ‘ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বিস্তারিত জানা যায় কাবাব সম্পর্কে।সেখানে বলা হয়েছে কাবাব শব্দটি আরবি ‘কিবাব’ শব্দ থেকে এসেছে। নরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর আয়ুর্ব্বেদ সংগ্রহ বইয়ে বলেছেন,–‘ছাগাদির যকৃৎ প্রভৃতি কোমল মাংসে ঘৃত ও লবণ মিশ্রিত করিয়া তাহা শলাকায় গ্রথিত করিয়া ধূমরহিত অগ্নিতে পাক করিবে। ইহাকে পাকবিদগণ শূল্য-মাংস বলিয়া থাকেন। শূল্যমাংস- অমৃততুল্য, রুচিজনক, অগ্নিবর্দ্ধক, লঘু, কফঘ্ন, বায়ুনাশক, বলকারক ও কিঞ্চিৎ পিত্তজনক।’ গ্রীসের সান্তোরিনি দ্বীপে সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের নীচে চাপা পড়ে থাকা আশ্চর্য এক শহরের আবিষ্কারের ফলে ঝলসান কাবাবের ইতিহাস এক ধাক্কায় পিছিয়ে গেল অন্তত ১৬০০ পূর্বসাধারণাব্দ পর্যন্ত৷ কাবাবই শুধু নয়, একেবারে কপিবুক শিক কাবাব বা তুরস্কে যাকে বলে শিশ কাবাব৷ আক্রোতিরি নামের সেই শহরে (নামটা আধুনিক অবিশ্যি) পাওয়া প্রত্নবস্ত্তর মধ্যে কাবাবের শিক সাজানোর ব্যবস্থা সহ কুকুরের মুখওয়ালা যে উনুনটি পাওয়া গেছে তা থেকে সন্দেহের আর কোনও কারণই থাকতে পারে না যে আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগেও মিনোয়ান সভ্যতার শহুরে মানুষরা কাবাব-প্রিয়, এবং বিশেষ করে শিক কাবাব-প্রিয় ছিলেন৷ দেশে বিদেশে শিক কাবাবের উনুন হাজারও দেখা গেলেও ,এমন বাহারের উনুন বিরল। মধ্যপ্রাচ্যে হোমিনিন প্রজাতি দ্বারা আগুনের ব্যবহার করে রান্নার প্রমাণ ৭৯০,০০০ বছর আগেও পাওয়া গেছে।কমপক্ষে ২৫০,০০০ বছর আগেকার প্রাগৈতিহাসিক যুগে মাটির উনুন এবং প্রাণীদের পোড়া হাড় ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্য থেকে পাওয়া গেছে।আকরোতিরির মিনোয়ান বসতি খনন করে আগুনের ওপর শিক রাখার জন্য পাথর পাওয়া গেছে, যেগুলি খ্রিস্টপূর্ব ১৭শ শতকের আগে ব্যবহার হয়েছে। প্রাচীনকালে, হোমারের লেখা ইলিয়াড (১.৪৬৫) থেকে স্পিট (একটি লম্বা কঠিন দণ্ড, যা খাদ্য ধরে রাখতে ব্যবহৃত হয়)এর কথা জানা যায় যাতে  রেখে মাংস পোড়ানোর কথা পাওয়া গেছে।ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতেও স্পিটে এ পোড়ানো মাংসের কথা পাওয়া যায়।ইবনে সাইয়ার আল-ওয়ারাক এর দশম শতাব্দীর বাগদাদী বই “কিতাব আল-তাবিখ “, যেখানে পরম্পরায় পাওয়া মেসোপটেমিয়া, পারস্য এবং আরব খাবারের একটি মিশ্রিত রন্ধন প্রণালী আছে, সেখানে কাটা মাংসের কাবাব এর বর্ণনা রয়েছে, সেগুলি পাত্রে রেখে ভাজা বা আগুনে পোড়ানো। এই অঞ্চলে, ছোট ছোট খণ্ড বা মাংসের টুকরোগুলি রান্না করার পদ্ধতিটির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যেখানে কসাইয়ের দোকানে মাংসের ছোট ছোট টুকরো পাওয়া যেত এবং যেখানে রান্নার জ্বালানী তুলনামূলকভাবে খুব কম পাওয়া যেত, সেই শহরগুলিতেই এগুলি কার্যকর হত। তুলনামূলকভাবে ইউরোপে, যেখানে বনজ সম্পদ অনেক বেশি, সেখানে মাংসের বড় বড় টুকরো একসাথে পুড়িয়ে রান্না করা হত প্রকৃতপক্ষে, লোহার শিকে মাংস গেঁথে আগুনের উপরে রেখে রান্না করার কথা বহু সংস্কৃতিতে পাওয়া গেছে। যেমন অ্যান্টিকুচো, যেটি ইউরোপ এবং এশিয়ার সাথে যোগাযোগের অনেক আগে থেকেই দক্ষিণ আমেরিকায় রান্না করা হত।

তবে, ইংরেজিতে, কাবাব বা শিশ কাবাব বলতে কখনও কখনও একটি রন্ধনসম্পর্কীয় শব্দ হিসাবে ব্যবহার হয়, যেটি কোনও শিকের উপরে ছোট ছোট মাংস রান্না করাকে বোঝায়।  কাবাব মূলত পারস্য এবং তুরস্কের মধ্যযুগীয় রান্নাঘরে তৈরি মাংসের বিভিন্ন খাবারগুলির সাথে সম্পর্কিত। যদিও শব্দটির উৎস প্রাচীনকালের সঙ্গে সম্পর্কিত, তুর্কিরা একে জনপ্রিয় করে তুলেছিল, যেগুলি লোহার শিকে রান্না করা হত, তবে স্টু, মাংসের বল এবং অন্যান্য ধরনেও রান্না হত। মুসলিম প্রভাবের সাথে সমান্তরাল ভাবে এই খাবারটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মরক্কো ভ্রমণকারী ইবন বতুতার মতে, দিল্লি সুলতানির সময় (১২০৬-১৫২৬) রাজবাড়িতে কাবাব পরিবেশিত হত, এমনকি সাধারণ মানুষেরাও প্রাতঃরাশে নানের সাথে এটি উপভোগ করত।কাবাবের রন্ধন প্রণালী স্থানীয় রান্নার শৈলী এবং অভিনবত্বের সাথে গৃহীত হয়েছে। অাধুনিক কাবাবের জন্ম তুরস্কে হলে ও কাবাব আফগানদের হাত ধরে ভারতে আসে। বর্তমানে নানান ধরণের কাবাব লক্ষ্য করা যায়।
কয়ুন কাবাব, ভেড়ার মাংস ঢাকা সহ পাত্রে রান্না হয়।এছাড়া ও কোবান কাবাব,হাক্কি ওস্মান কাবাব, খুসবাসি কাবাব, শিস কাবাব, স্টিম কাবাব,
শামি কাবাব, রেশমি কাবাব, চাপলি কাবাব, , বিহারি কাবাব, টিক্কা কাবাব, পেশওয়ারি কাবাব, , কিমা কাবাব, পসন্দি কাবাব, ডোনার কাবাব, ডাগস কাবাব, মাছের কাবাব, বটি কাবাব, কাকরি কাবাব, টেংরি কাবাব, কস্তুরি কাবাব , হরিয়ালি কাবাব ও ভারতে পাওয়া যায়। স্বাদযাপনে বাঙালি সব সময়ই এগিয়ে। রসনায় পাল তুলে পাড়ি দেয় টক- ঝাল- মিষ্ট র দেশে। নিত্য নিত্য আবিষ্কার করেন নানা মহাদেশের স্বাদকে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *