যাত্রার স্মৃতি ও তার অলিগলি

প্রদীপ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৫২ সালে কোচবিহার জেলার দিনহাটায় ।দিনহাটায় স্কুল জীবন শেষ করে শিলিগুড়িতে কলেজ জীবন শুরু।বর্তমান বাসস্থান শিলিগুড়ি পুরসভার 31নং ওয়ার্ডে সুকান্তপল্লীতে । ৭০ এর দশকের শুরু থেকেই নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তী কালে গল্প , কবিতা ও প্রবন্ধ উত্তরের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই করোণা আবহে ঘরে বন্দি । ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি বিশেষ করে এবারের পূজোর পরিমণ্ডলে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ।

 

যাত্রা

প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য  

তার গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য যাত্রার চমক, যাত্রার কৌলিন্য হারিয়ে ফেলার জন্য যাত্রা দল বা এর সংগঠন না করা, সময়, প্রযুক্তি মননের পরিবর্তন এ সবই যাত্রাকে বিপুল জনপ্রিয়তার আসন থেকে নামিয়ে এনেছে। প্রকৃতপক্ষে শহুরে এবং গ্রাম-বাংলার নানা নামে নানা ধরণের যাত্রার জনপ্রিয় ছিল অবিশ্বাস্য। শহুরে বড় যাত্রাগুলাের সবচেয়ে বড় আকর্ষন ছিল কনসার্ট। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলত কনসার্ট। যাত্রা শুরুর আগে অন্তত -ঘন্টা ধরে চলত এই পর্ব। যাত্রা তখন শুরু হয়তো রাত দশটার আগে না। কনসার্ট শুরু হত তার আধঘন্টা আগে। দিনহাটা মহকুমা হলেও খুবই ছােট। জনবসতিও কম। কনসার্ট শুরু হলে তার শব্দ দিনহাটার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শােনা যেত। সেটা অবশ্য বেশী রাত বা স্বল্প জনসংখ্যার কারণে। তখন ভারত পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) মাঝখানে লালমনিহাটে রেলওয়ে সেতু উঠলে সে শব্দও শােনা যেত। অবশ্য রাতে। রাত ৪টে নগাদ একটা ট্রেন আসত। সে শব্দ শুনে সময় বোঝা যেত। আমাদের ছােটবেলায় বিনোদনের অন্যতম এক উপকরণ ছিল যাত্রা। ছােটবেলায় অবশ্য আনন্দের জন্যই যাত্রা দেখতাম। কিন্তু এখন বুঝি যাত্রা জনসংযােগের মাধ্যমে জনগনের কাছে কোন বার্তা পৌঁছানের অন্যতম মাধ্যম। এই শক্তিশালী মাধ্যমটি হারিয়ে গেল তথবা টিম টিম করে জ্বললেও তার গৌরব সম্পূর্নতঃ অস্তমিত। এখন বুঝতে পারি যাত্রা যেমন বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহ হত তেমনি যাত্রা লোকশিক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যদিও তৎকালীন যুগে যাত্রার প্রধানতঃ তিনটি ধারা ছিল। প্রথম ধারাটি ছিল সামাজিক ও পারিবারিক, দ্বিতীয় ধারাটি রাজা বদশাদের নিয়ে আর তৃতীয় ধারাটি ছিল দেব-দেবীর গুণকীর্তন। তখন ছ-সাত বছর বয়স হবে। দিনহাটায়, আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল বুড়ির গড়। গড়ের উপরে সমতল জায়গায় বহু জীর্ণ ছােট একটা ঘর তার মধ্যে একটা ঠাকুর। সারা বছর কেউ তাতে পুজো দেয়না। বছরে একবার সময়টা ঠিক মনে নেই, তবে শীতকালে পূজোটা হত। কালী-পূজোর পরেই হত। গ্রাম্য পরিবেশ বলে ঠান্ডাটা একটু বেশীই পড়তাে। যাই হােক বছরে ঐ একবার বেদীতে নতুন ঠাকুর বসতাে আর বুড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে পাশে আলাউদ্দিনের জমিতে এক মাস ব্যাপী মেলা চলত। আর প্রধান আকর্ষণ ছিল আশে পাশের গ্রাম থেকে আসা যাত্রা দল। ওরা কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা এই জাতীয় পালাগুলাে করত। নিমাই সন্ন্যাস, নৌকা বিলাস, কংসবধ এসব যাত্রা লােকের ভীষণভাবে ‘ভাল লাগতাে এরা সবাই খুবই গরীব ঘরের দরিদ্র।

এই যাত্রা করে তাদের কিছু রােজগার হত। এই যাত্রাগুলাে তখন আমাদের মনের উপর ভীষণ প্রভাব ফেলত । দেখ গাে চাহিয়া। নদীয়া ছাড়িয়া যাই গাে- এই গানের সাথে সবার সাথে আমরাও কেঁদে ফেলতাম কংস বধ। আবার দীক্ষা নেবার পর গুরু দক্ষিণা দেবার জন্য নিমাই দুয়ারে ভিক্ষায় বের হলে সবাই টাকা পয়সায় ভিক্ষার থালা ভরিয়ে দিত এবং সবই মুণ্ডিত মস্তক নিমাইকে প্রণাম করত। গ্রাম্য অভিনেতা হলেও সকলের মাথায় হাত ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করত। ওরা যেখানে থাকতো সেখানে গিয়ে দেখতাম যে নিমাই, রাবন, কংস, সীতামাতা, রাধা সবই এক সাথে বিড়ি টানছে। বেশ মনে আছে রূপবান বলে একটা যাত্রা (গ্রামীণ যাত্রা) সুপার ডুপার হিট হয়েছিল। রূপবান যাত্রার নামে ভাঁড় উপচে পরতো। গ্রামের ছোট ছোট দল হোক বা শহরের বড় দল হোক, তখন যাত্রার ধরণটা প্রায় একই ছিল। ঠিক মাঝে আর তার চারদিকে দর্শকের বসার আসন। আসন বলতে চারদিকে খড় বিছিয়ে তার ওপরে ত্রিপল পেতে দেওয়া হত। ‘আগে আসো আগে বসাে এই ছিল নিয়ম। টিকিটের দামও একইরকম ছিল। এই নিয়মই দীর্ঘদিন ছিল। নট নাটিরা চারদিকে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করত। কত অভিনেতা, অভিনেত্রীদের নামে যাত্রা মঞ্চে দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। মনে আছে ছোট ফনি,বড় ফনি, নিতীশ গাঙ্গুলি, দিলীপ রায়, জোৎস্না বিশ্বাস, পরশীল বেলা সরকার, শেখর গাঙ্গুলি, শাস্তিগােপাল, শহর দলের যাত্রাগুলোর মধ্যে “সােনাই দিঘি” ছিল সুপার ডুপার হিট। সােনাই আর ভাবনা কাজী অসামান্য জনপ্রিয় ছিল। ৭০-এর দশকের শুরু থেকে যাত্রায় দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। প্রথমতঃ চারিদিকে ঘুরে অভিনয় করার পরিবর্তে বেশীরভাগ সময় নাটকের মতাে একদিকে মুখ করে অভিনয় করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেল ফলে সামনের দিকে বসার আগ্রহের কারণে বসার টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি পেল। এছাড়া ধীরে ধীরে যাত্রার আসরে চেয়ারের আগমন ঘটালো। ফলে দেখে সর্বশক্তিমান কৃষ্ণকে প্রণাম করতাম। ‘সিরাজদ্দৌলা দেখে বাড়িতে এসে নিজেকে সিরাজ ভেবে বসতাম। একটু ডানপিটে ছিলাম তাই বন্ধু, খেলার সঙ্গি বাছাকে মীরজাফর বানিয়ে বাড়ির উঠোনে কচুরীপানার নিচের অংশ অর্থাৎ কচুরিপানার শিরা-উপশিরার কালােচুলের মতো অংশ দিয়ে নকল দাড়ি-গো বনিয়ে যাত্রা খেলতাম। গ্রামীণ এই যাত্রা আমাদের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করত। স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক পর্যন্ত যাত্রাকে অতীব গুরুত্বপূর্ণমাধ্যম বলে মনে করতেন। যা ক্রমশ নাটকের ঢং-এ পরিবেশিত হতে শুরু করল। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল যার অমৃত। হারিয়ে গেল ক্লারিওনেট, হারিয়ে গেল প্রম্পটার, হারিয়ে গেল যাত্রাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে থাকা আরাে কত স্মৃতি। খদ্দরের বড় চাদর গায়ে যাত্রা দেখতে যাওয়া অথবা যাত্রা শােয়ে ঠান্ডায় চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরা সবই হারিয়ে গেল। অনেককাল আগেই যাত্রার গা থেকে মাটির সোঁদা গন্ধ হারিয়ে গেছে। আমার ছোটবেলার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য খুবই মনে পড়ে তখন কি শহর কি গ্রাম প্রত্যেক যাত্রাতেই অভিনেতা অভিনেত্রীরা প্রতিবার মঞ্চ থেকে নেমে যাবার সময় একই বাণী (ডায়লগ) বার বার বলতে বলতে বেরিয়ে যেতেন। দর্শকরাও খুশি হয়ে হাততালি দিত। পরে শুনেছি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এ কাজ করার কারণ তারা যত বেশীবার হাততালি পাবে তত বেশি তারা জলপানি পেত আমি চিরদিন সময়ের সাথে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে এসেছি। অবশ্য আমি না মানলেও আধুনিকতার রথ নেমে থাকতাে না। তবুও মাঝে মাঝেই মনে হয় পেট্রোম্যাক্সের আলোয় গ্রামের যাত্রাগুলাে যে নির্মল আনন্দের সম্ভার ছিল আজকের সে শিল্প হারিয়ে গেলাে। আধুনিকতার পিছনে ছুটতে ছুটতে আমরা আমাদের সুমহান সংস্কৃতির শিকড়গুলাে এক এক করে কেটে ফেলছি না তাে?

লেখা পাঠাতে পারেন

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *