লক্ষ্মীপাঁচা৯-র মিথ মন্দির
লেখা ও ছবিঃ দে ব লী না রায়চৌধুরী ব্যা না র্জী
মন্দির তো শুধু ধর্ম নয় প্রাচীন ইতিহাসেরও ধারক ও বাহক। আবার মন্দিরের পুরনো শরীরের মধ্যে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস বা গৌরবের কথা মানবদেহে রক্তের মতো বইতে থাকে। তাই শুরু করছি মন্দির-মিথ। তাতে ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস ছাড়াও আজলা ভরে তুলে নেব কিছু অবিশ্বাস্য বিশ্বাসের কথা। লক্ষ্মীপুজোয় আজ বলি কোজাগরী লক্ষ্মীমন্দিরের মিথ-কাহিনী।
ভর পরা, দেবাংশী, চামুণ্ডার মুখোশ পরিধান, মহাযজ্ঞ – কেমন লাগছে কথাগুলি পড়ে? বুকের ভেতরে ছ্যাৎ করে ওঠে? ভারত তথা বাংলার কোণায় কোণায় ছড়ানো আছে অজস্র মিথ , লোককথা, লোকাচার আর বিশ্বাসের কথা। লুকানো আছে বললেও বোধহয় খুব ভুল হবে না । তারাপীঠ থেকে 12 কিমি দুরে, বীরভূমের ঘোষগ্রামে এমনই এক মন্দির বিশ্বাস ও বাস্তবের মাঝে কুয়াশায় মোড়া নরম আলোর মতো জেগে আছে। মন্দিরটি কোজাগরী লক্ষ্মী দেবীর। ইতিহাস ও মিথের রঙে মিশেল এই মন্দির।
পথের দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত, যেন নরম সবুজ কার্পেট । আর তার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই দেখা পাওয়া যায় খোলামেলা বেশ বড় একটি মন্দির। কথিত আছে, অনেক কাল আগে কাছের দীঘিতে ভেসে আসে একটি কাঠের টুকরো। এক সাধারণ চাষী, নাম দয়াল ঘোষ, স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওই কাঠের টুকরো থেকে তৈরি করেন এক লক্ষ্মী মূর্তি। কামদেব ব্রহ্মচারী বলে জনৈক ব্রাহ্মণের সাহায্য পান দয়াল ঘোষ । শুরু হয় পুজো। বেশ কিছুকাল পরে কান্দির রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ নির্মাণ করেন এই মন্দির। এক কাঠের লক্ষ্মী মূর্তি যার পায়ের কাছে ‘ধন’ রূপী কন্যা ও ‘কুবের’রূপী পুত্রকে আর বাহন প্যাঁচাকে দেখা যায় ওই এক-কাঠের বিগ্রহে। সময়ের সাথে মূর্তিও নষ্ট হতে থাকে। তবে এমনি এমনি পরিবর্তন করা যায় না তা। ফি-বছরও তা হয় না। রাজবাড়ির কোনো রাজপুরুষ বা উত্তরাধিকার স্বপ্নাদেশ পেলে একই ছাঁচে তৈরি হতো লক্ষ্মী প্রতিমা।
কিন্তু শুধুই এইটুকুই নয়। এবার বলি মন্দিরের সাথে জড়িয়ে থাকা অবাককরা এক গাঁথা, যা তারাপীঠের মন্দির নির্মাণের আগে থেকে একইভাবে চলে আসছে। একটা আছে এক চমকপ্রদ প্রথা।
মন্দিরটি দেবী লক্ষ্মীর ঠিকই কিন্তু এখানে প্রতিবছর রথের দিন চামুণ্ডার ভর পরে এক দেবাংশীর উপর। দয়াল ঘোষের নামেই গ্রামের নাম ঘোষ গ্রাম। আনুমানিক 2500 লোকের বাস এই গ্রামে। তার মধ্যে আছে দেবাংশী ও তার পরিবার। স্থানীয় মানুষের ও পুরোহিতদের বক্তব্য দেবাংশী কে তা ঈশ্বর নির্দেশ করেই দেন। তাকে পরিয়ে দেওয়া হয় “উতুরি” বা উত্তরীয়। এটা অনেকটাই পৈতার মতো। ছোটবেলা থেকেই তার বিশেষ ক্ষমতার জন্য তাকে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। রথের দিনে ঘটা করে পুজো হয় এখানে। আর দেবাংশী পরিবারের একজন মানুষ দুই দিনের উপবাস রেখে, পুজোর আগেই আসে মন্দিরে।
রথের দিন খুব ভোরে, পুজো শুরু হয়। দেবাংশীকে পরানো হয় ‘চামুণ্ডা’ মুখোশ। ওই ভারী মুখোশ মুখে এঁটে দেবাংশী ভরে পরেন। সেই দেবাংশী তখন যেন কোন মন্ত্রবলে বলতে থাকেন কৌতূহলী মানুষের জীবনে লুকিয়ে থাকা অতীত বা না দেখা ভবিষ্যতের কথা। আর জনতার ভিড় দেখতে থাকেন বিজ্ঞান ও যুক্তির গন্ডির বাইরের কিছু ক্রিয়াকলাপ। এক দেবাংশী গত হলে , আবার ওই পরিবারের কেউ একই ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলে এই পরম্পরা, অজানা কোন দৈব ইচ্ছায়।দেবত্ব না কুসংস্কার, আচার না বিশ্বাস – নাই বা গেলাম সেই আলোচনায় । বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এই রীতি মেনেই জীবন যাপন করছে ওখানকার মানুষ না জানি কতকাল ধরে।