ধারাবাহিক
পূর্ব প্রকাশিতের পর
লাউ কুমড়ো (দুই)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শুধু সহজ সরল সোজা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না ; তাঁর পর্যবেক্ষন শক্তি
ছিলো অসাধারণ। যেহেতু তিনি গ্রামের মানুষ,
তাই পুকুর নদী গাছ শাক সব্জি মাঠ ঘাট পাখি
পশু মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ,সব কিছু ,এত
খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে দেখেছেন, যে পরবর্তী সময়ে
সেগুলোর সুন্দর ব্যাখা করেছেন গৃহস্থ- জীবন এবং ধর্মজীবনকে একসাথে মিশিয়ে। সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য যা ভীষণ কার্যকরী। দক্ষিনেশ্বরে ঘরোয়া ধর্মালোচনায় ‘নিত্যসিদ্ধ’ কী, সেটা বোঝাতে ” লাউ কুমড়ো ” র প্রসঙ্গ এনেছেন। বলেছেন, ” যেমন ধর লাউ কুমড়ো। এদের আগে ফল তারপর ফুল। অন্য অন্য ক্ষেত্রে আগে ফুল, তারপর ফল। শুনিসনি লোকে আনন্দে বলে আমার গাছে ফুল এসেছে, এবারে আমার গাছে ফল ধরবে। ” অর্থাৎ যারা জন্মসিদ্ধ বা নিত্যসিদ্ধ তারা পূর্ব সংস্কার বশত ‘ফল’ পেয়েই গেছে। শুধু লোকশিক্ষার্থে ফুলটা ফোটানো। নিত্যসিদ্ধ যোগী আগে সিদ্ধ হয়ে তারপর সাধনা করেন। সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাঁদের যত সাধন ভজন। অনান্য ক্ষেত্রে সাধনায় পূর্ণতা পেয়ে তারপর ” সিদ্ধি” লাভ।
এ্যাতো গভীর এক ব্যাখা, কত সহজে বুঝিয়ে
দিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দুটি সামান্য গাছের
উপমায়। প্রাঞ্জল ভাবে। সরল ভাবে। সহজ
উপমায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন বিখ্যাত প্রকৃতিপ্রেমীও। ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ঈশ্বর সাকার না কি নিরাকার বোঝাতে প্রকৃতিকে টেনে এনে বলেছেন; “রাতের আকাশে কত তারা ফুটে থাকে দেখিসনি? তাদের কত সব নাম! ‘ অরুন্ধতী,
শতভিষা, স্বাতী, অহর্ষি, সপ্তর্ষি আরও কত কী!
কী সুন্দর লাগে রাতের আকাশে তাদের। যেই
সূর্যদেব উঠলেন গা ঝাড়া দিয়ে, আর তাদের
দেখা যায় না। রাতে তারারা সাকার – দেখছ চোখের আলোয়। দিনের আলোয় নিরাকার। কিন্তু আছে। তেম্নিঅজ্ঞান অবস্থায় ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারেনা মানুষ। তিনি সর্বভূতের মধ্যে, সর্বাবস্থায় আছেন। দেখার জন্য তোমার জ্ঞানচক্ষু চাই। তিনিই সাকার আবার তিনিই নিরাকার।
আবার বলেছেন – কোনো মানুষের হৃদয়ে যখন প্রেমের দোলা লাগে, ভালবাসার ঢেউ লাগে, ঈশ্বরীয় ঝড় ওঠে তখন সেই মানুষটা অনেকটা পথভোলা মৌমাছির মতো হয়ে যায়। তাকে চেনা যায় না। যেমন ” কালবৈশাখীর ঝড় এলে কোনটা আমগাছ আর কোনটা তেঁতুলগাছ দূর থেকে চেনা যায় না। মনে হয় সবুজের তোলপাড় সমারোহ। যে, যেরূপে তাঁকে দেখেছে, সে, সেরূপেই তাঁকে জানবে। তাঁকে চিনবে”।
“মনের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রেখো না। মনের মধ্যে কোনো বাঁকও রেখো না। মনকে সহজ পথে চলতে দাও। সরল হতে উৎসাহিত করো। আর মনের জোর হারিও না। বিশ্বাস হারিও না। বিশ্বাসে কী না হতে পারে? সাকার নিরাকার রাম কৃষ্ণ কালি ভগবতী সব তোমার ধ্যানে, তোমার ধারনায়, তোমার বিবেকে, তোমার বিশ্বাসে, তোমার চিন্তায়, তোমার চেতনায়, তোমার মনে, তোমার মননে। “এ সব ঠাকুরের উপদেশ। তাঁর শ্রীমুখের মঙ্গলময় বাণী।
“বিশ্বাসে মিলায় বস্ত, তর্কে বহুদূর “। ”এই বিশ্বাস” নিয়ে ঠাকুরের একটা গল্প শোনা যাক —
বিভীষণ একটি পাতায় ” রাম নাম ” লিখে একজনের কাপড়ের খুঁটে বেঁধে দিলেন। বললেন, সাগরের ওপারে যাবে তো? যাও না, কোনো ভয় নেই। মন্তর লিখে দিলাম। দিব্যি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাও। নৌকা জাহাজ কিচ্ছুটি লাগবেনি। সোজা চলে যাও। তবে ” বিশ্বাস ” রাখতে হবে। বিশ্বাস হারিয়েছ তো মরেছ। এক্কেবারে সমুদ্রের তলায় চলে যাবে। বিশ্বাস নিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে সেই লোক। ঢেউ এর ওপর দিয়ে। হেঁটে। চোখ সামনে রেখে। যাচ্ছে যাচ্ছে হঠাৎ, মন না মতিভ্রম, মানুষটার মনে সন্দেহ জাগল। কাপড়ের খুঁটে কী এমন বস্তু বাঁধা আছে একটিবার খুলে দেখি না! সন্দেহ………..অবিশ্বাস……..
খুলে দেখে, ওমা, মন্তর ফন্তর কিচ্ছুটি নয়। শুধু একটি “রাম নাম” লেখা এক টুকরো কাগজ। — এই? শুধু একটি রামনাম? যেই অবিশ্বাস, অমনি
বিশাল এক ঢেউ এসে গ্রাস করলে তাকে। তাই ঠাকুর বলেছেন বিশ্বাস হারিও না। অবিশ্বাসী মনে বড় সংশয়। মা সারদা ও বলেছেন, “যাদের মন সংশয়ী, তাদের বড় কষ্ট। “আর এক জায়গায় ঠাকুর আর একটি সুন্দর গুরু – শিষ্যর গল্প বলছেন। “সর্বভূূতে নারায়ণের ” গল্প। গুরু করুণামৃত দিয়েছেন, উপদেশামৃত দিয়েছেন শিষ্যকে। বলেছেন, সবখানে নারায়ন বর্তমান। সব মানুষের মধ্যে নারায়নের আবাস। এমনকি পশুপক্ষীদের মধ্যেও সেই এক এবং অদ্বিতীয় নারায়নের প্রকাশ। গুরু বলেছেন, শিখিয়ে দিয়েছেন, শিষ্যকে আর পায় কে? পথ দিয়ে হাতি চলেছে, গজানন, দুলতে দুলতে। উপর থেকে মাহুত বলছে ‘ রাস্তা থেকে সরে যাও। সরে যাও। ‘ হাতিটা বেয়াদব। পথ ছেড়ে তফাত যাও। শিষ্যের তখন মাথায় ঘুরছে ‘ সর্বভূতে নারায়ন ‘। সরবো কেন? আমিও নারায়ন, হাতিও নারায়ন। আমাদের মধ্যে তো কোনো বিরোধ নেই। শিষ্য সরলো না, উল্টে হাতির সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতি তাকে শুঁড়ে করে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। ভাগ্যিস রাস্তার ধারে একটা বুনো ঝোপের মধ্যে এসে পড়েছিল শিষ্য বাবাজী, তাই এ যাত্রায় বেঁচে ফিরলো। হাকিম কোবরেজি করে, ওষুধ- মালিস নিয়ে গা – ব্যাথা সারবার পর, গুরুদেবের কাছে এসে অভিযোগ করলে। সব শুনে গুরু মহারাজ বললেন– ভালো কথা, তুমিও নারায়ণ হাতিও নারায়ণ, আর মাহুতটি নারায়ণ নয়? মাহুত নারায়ণের কথা শুনবে না? মাহুত নারায়ণেরকথা শুনলে তো তোমার এই দুর্ভোগ হতো না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেনঃ “ঈশ্বরই সত্য। একমাত্র সত্য।” তাঁকে মাথায় নিয়েই মানুষকে বাঁচতে হবে।কাকে ধরে শোকে দুঃখে বিফলে বিমুখে উৎকণ্ঠায় হতাশায় নির্বিচল অবিচল থাকবো? কে যোগাবেন তোমার আমার মধ্যে নতুন আশার আলো? কে তিনি? আপদে বিপদে পড়লে কে অলক্ষ্যে সাহস দেবেন নতুন সংগ্রামের? কে সমস্ত বিবাদের স্থির মীমাংসা?
কে তিনি?
কে সমস্ত অন্যায়ের সীমাহীন সংশোধন? কে তিনি?
তিনিই ঈশ্বর।
তিনিই দেবতা।।
তিনিই ভগবান।।।
চলবে…