★পূর্ব প্রকাশিতের পরঃ
মা সারদা,এক উজ্জ্বল মাতৃমূর্তি (দুই)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
মা সারদার কাছে গৃহস্থ ঘরের,ধনী ঘরের গৃহিনীরা
যেমন এসেছেন তঁার মুখের দুটো কথা শুনতে
তেমনই সমাজের বারাঙ্গনারাও দুচারজন এসেছেন। মায়ের কাছে ছোট বড় নেই, উচ্চ নীচ নেই। মূর্খ পন্ডিত নেই, ধনী দরিদ্র নেই। মা বলেছেন ঃ ” মানুষ জন্ম থেকে কোনো বিশেষন্
নিয়ে জগতে আসে না। এসে বিশেষন্ অর্জন করে। মানুষের কর্মই তার পরিচয়। নিন্দা, চর্চা,
করতে পারে সবাই। তাকে সঠিক পথ দেখাতে
পারে ক’ জনে? দেখো, ঠিক ঠাক পথ পেয়ে সে
মানুষটা বদলেও যেতে পারে। ”
তাই তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কে বলতে পেরে
ছিলেন “মা, বলে ডাকলে তো আমি কাউকে
ফেরাতে পারবো না।” তিনি যে মা, সকলেই
তাঁর আপন আত্মজ। ‘পেটের ছেলে’। অনন্ত
দৈবীশক্তি না হলে এমন আধার হয় না। তাঁর
আত্মা ছিলো সর্বদা স্নেহশীল, পবিত্র, পূণ্যতোয়া
গঙ্গার বারিধারার মত নির্মল। যে সেইসময় তাঁর
ব্যাক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছে, সেই উদ্ধার হয়ে
গেছে। দৈবী শক্তির গুনে তাঁর মন এমন শুদ্ধ এবং
পবিত্র থাকত সব সময়, যে তিনি জপ- ধ্যানে; ও
সংসারের সাধারন কাজে কর্মে সমানভাবে
সমানতালে বিভোর থাকতে পারতেন। আবার
যখন পূজায় বসতেন তখন এমন অপূর্ব তন্ময়
থাকতেন যে সে সময় তাঁর দেহবোধ ও থাকত না। মা সারদার কাছে ধ্যান করা, বা গৃহকর্ম
করার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিলো না। বলেছেন;
“ঘর ঝাঁট দিচ্ছ বা ন্যাতা টানছ মাটির দাওয়াতে
সব কাজ টা ভাববে গোবিন্দের কাজ করছি। পূজা ভেবে করবে। তাহলে মনে আনন্দ পাবে,
কাজে বিরক্তি আসবে না। “
দক্ষিনেশ্বরে থাকা কালীন শ্রীমা সারদা একবার
বলেছিলেন; “তখন আমার মন এমন ছিলো যে
দক্ষিনেশ্বরে কে যেন রাত্রে বাঁশি বাজাত। শুনতে
শুনতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠত। মনে হত ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বুঝি বা সত্যি সত্যিই বাঁশি বাজাচ্ছেন- অমনি সমাধি হয়ে যেত। শ্রীমায়ের
এই পবিত্র মনঃসংযম সেই অনন্ত আত্মশক্তিরই
স্ফূরণ। সেই অদ্ভুত ও অপূর্ব আত্মশক্তি তাঁকে এমন ভাবে ঘিরে থাকত যে নিশ্চিত মৃত্যুও তাঁকে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াতো।সে ব্যাপারে একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনার কথা এখানে বললে আপনাদের ভালোই লাগবে। এটি একটি সত্য ঘটনা। সেই ডাকাতে- কালি, ডাকাত সর্দার আর তেলোভোলো’র মাঠের শিউরে ওঠা গল্প কাহিনী। মা সারদা দক্ষিনেশ্বরে যাচ্ছেন গঙ্গাস্নানে। তখন কোনো যানবাহন এর ব্যাবস্থা ছিলো না। যারা বিত্তশালী ধনী তারা পালকি ব্যাবহার করতো। মা সারদা ছিলেন অত্যন্ত গরীব ঘরের। জয়রামবাটি থেকে দক্ষিনেশ্বরে পায়ে হেটেই যেতেন। পথ বিপদসংকুল। চোর ডাকাত আর ঠ্যাঙারে দের ভয়! দিনের আলোয় লোকে দল বেঁধে যাতায়াত করতো। সূর্যদেব ডুব দিলে কেউ রাস্তার হাঁটতো না। আর ওই পথেই পড়ত একটা ভয়ের মাঠ “তেলোভোলোর মাঠ”। সেবার মায়ের সঙ্গে ছিলেন জয়রামবাটির কিছু আত্মীয়, বন্ধু, আর বাড়ির লোক কয়েকজন। ডাকাতদের ভয়ে সবাই দলবেঁধেই যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মা সারদা পিছিয়ে পড়ছিলেন নিজের শারীরিক অক্ষমতার জন্যে। তখন তিনি কিশোরী। দলের মধ্যে কনিষ্ঠা। ওই ভয়ের- মাঠটা পার হতে পারলে কিছুটা বিপদমুক্ত হওয়া যায়। তাই সবাই জোর কদমে এগোতে লাগল আর বারবার মা পিছিয়ে পড়তে লাগলেন। তখন মেয়েদের পায়ে চটি জুতো পরার চল ছিলনা। খালিপায়ে ওই মেঠোপথে যেতে মায়ের পায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। মা ভাবলেন, তিনি বারবার পিছিয়ে পড়ছেন আর শুধু তাঁর অক্ষমতার জন্য বাকি সবাই কেন বিপদে পড়বে?
মা বললেনঃ তোমরা সব পা চালিয়ে এগিয়ে যাও। আমার জন্যে তোমরা সবাই কেন বিপদে পড়বে?
তারকেশ্বর চটিতে আমি ঠিক তোমাদের ধরে নেব।
আমার জন্যে ভেবো না। যিনি জগজ্জয়ী জগজ্জননী সবার ভাবনা তাঁর একার। তিনিই তো সবার ভাবনা নিয়ে বসে আছেন। আর বলছেন,”আমার জন্যে ভেবো না”। কিন্তু ‘ভাবনা ‘সাক্ষাৎ এসে হাজির হলো। সূর্য গেল পাঠে। তেলোভোলোর বিস্তীর্ণ মাঠ এখনো সামনে পড়ে রয়েছে। মা এগোতেই পারছেন না। পা চলছে না। চলবে কী করে? পায়ে যে ফোস্কা! কে যায়? হুংকার দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো এক
ডাকাত দম্পতি। “একা একা কোথায় যাচ্ছো তুমি?” মা সারদা দেখলেন, কালো কষ্টিপাথরের মত চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে মাকড়ি চোখ দুটো লাল জবার মতো। হাতে মস্ত এক লাঠি। মা সারদা বুঝতে পারলেন এরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে এসেছে। কিন্তু তিনি তখন একা।অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তঁার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।
মা সারদা ডাকাত রানির হাত দুটো ধরে বললেনঃ
“আমি তোমাদের মেয়ে সারদা গো! যাচ্ছিলাম
তোমাদের জামাইয়ের কাছে। দক্ষিনেশ্বরে। অন্ধকারে পথ হারিয়েছি। ভাগ্যিস তোমরা এসে
পড়লে! না হলে কী যে হতো মা! ”
এমন শিশুসুলভ সরল মিষ্টি কথায় ডাকাত দম্পতি থমকে দাঁড়ালো। তারা দেখলো এক আশ্চর্য দৃশ্য। অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হয় এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্যে। ডাকাত হলেও তারা ভাগ্যবান। কিছু
পূন্য তাদের সন্চয়ে অবশ্যই ছিলো। তারা দেখলো তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মা ভবতারিণী। ঠিক আর পাঁচটা মাকালির জাগ্রত জলজীয়ন্ত রূপ যেন। রূপকথার রাজ্যি! অনেকটা ওদের তোলোভোলোর মাঠের মা কালিকা সুন্দরী। কিন্তু এটা এক ক্ষনিকের বিদ্যুৎ চমক যেন।একবারই চোখের সামনে দেখা। মূহুর্তের মধ্যে আবার সেই গ্রামের মেয়ে। গঙ্গাস্নান যাত্রী। মা রূপ লুকিয়ে নিলেন চকিতে। এটা কী তাহলে মনের ভুল? দুজনেই কী একসাথে ভুল দেখলাম? নিষ্ঠুর ডাকাত দম্পতির হৃদয়ে দৈবী ঝড় উঠলো। এ আমরা কাকে হেনস্তা করতে যাচ্ছিলাম? এতো সাধারণ মেয়ে নয়! এ তো সাক্ষাৎ দেবী! তারা মা সারদার ক্ষতির কথা তো ভাবলোই না, উল্টে মা’ কে খাইয়ে, সেবা করে, সারারাত পাহারা দিয়ে বিশ্রামের ব্যাবস্থা করে, পরে রাত্রে শোবার বিছানা পেতে মাথার হাত বুলিয়ে সন্তান স্নেহে যত্ন করে, পরদিন সঙ্গীদের সাথে মিলন ঘটিয়ে, তবে তারা নিজেদের আস্তানায় ফিরে গেলো।সবই মায়ের লীলা।ফিরে গিয়ে তারা তাদের গ্রামের সঙ্গীদের বললেঃ “সেই সন্ধ্যায় আমরা কী দেখলাম জানিস? ঠিক আমাদের তোলোভোলোর- মা- ডাকাতে -কালি। মূহুর্তের মধ্যে আকাশে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেইচোখ ধাঁধাঁনো আলোয় দেখলাম সাক্ষাৎ মা কালি। চকিতের মধ্যে সব বদলে গেল। মনে হল ছুটে গিয়ে একডালা লাল জবা ফুল, আর বেলপাতা নিয়ে এসে ওই রাঙা শ্রীচরণকমলে মুঠো মুঠো করে দিই। কিন্তু আমরা পাপী কি না, তাই মা রূপ বদলে ফেললেন পলকের মধ্যে।
সঙ্গীরা শুধালে ঠিক অমনি দেখলে? একদম মা কালীর মতো? তবে তোমরা উদ্ধার হয়ে গেছো।
হলেই বা চকিতে দেখা, দেখা তো পেয়েছ, একটু
দেখাও দেখা, অনেক দেখাও দেখা। কোনো ফারাক নেই। যা সামান্য, তাই অসামান্য। যা চকিত তাই চিরকালিক। জল জলই। পুকুরের
মৃদু ঢেউএ যে জল, সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত ঢেউএ
সেই একই জলের দাপাদাপি। হ্যাঁ রে, সাক্ষাৎ মা জগদ্ধাত্রী। স্বয়ং জগজ্জননী। তবে, ভয়ংকরী নন। লোল জিহ্বা নন। রক্ত চক্ষু নন। মুণ্ডমালাধারিণী নন। রক্ত – বসনা নন। একেবারে আমাদের ঘরের মা। নিজের মা। আপন মা। সনাতনী। অভয়দাত্রী। সারদাসুন্দরী। প্রেমময়ী। কৃপাময়ী। দু’চোখে শুধুই ভালোবাসা। আগামী দিনের নিমন্ত্রন। আত্মার আমন্ত্রণ। সুন্দরের বিচ্ছুরণ। মঙ্গলময়ী করুনাময়ী পবিত্রতাস্বরূপিনী……..
।। জয় মা সারদা সরস্বতী।।
★★★ শেষ ) ★★★
★আগামী বৃহস্পতিবার অন্যকিছু অন্য অনুভবে…