আজকের গল্পঃ “আয় তবে সহচরী”

পরিচিতিঃ নিমাই বন্দোপাধ্যায়।লেখালিখির সাথে পরিচয় দীর্ঘদিনের। কবিতা,ছোটগল্প প্রবন্ধ কিম্বা গদ্যে তাঁর মূল বিচরণ। তবে ইদানিং তিনি আধাত্মিক চেতনার সাথে সম্পৃক্ততার চেষ্টা করছেন। লিখেছেন বহু লিটল ম্যাগাজিনে। কর্মজীবন কাটিয়েছেন একজন করণিক হিসেবে। তাতেই বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসা ও চরিত্র পড়ার সুবাদেই লেখালিখির জগতে ডুব। গল্পকার এখন অবসর জীবনে বসে অবসরের গল্প লিখছেন।বাইফোকালিজমের জন্য তার আজকের গল্প।

 

আয় তবে সহচরী

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়

(এক)
কাপড়ের পাড়ের একাংশ দিয়ে চশমার লেন্স
পরিষ্কার করছিলেন মিসেস ছায়া চৌধুরী। রাজা-
মুন্নির মা, ভবতোষ বাবুর অর্ধাঙ্গিনী, সুনন্দ রায়ের
মেয়ে। মাস খানেক হল উনি এসেছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলে রাজা আর মেয়ে মুন্নি দুজনে’ই
প্রথম দিন এখানে এসে সব ব্যাবস্থা করে গেছে
মায়ের। এখানকার কতৃপক্ষকে মাসে মাসে টাকা
ওরাই পাঠাবে, পালা করে।
চশমাটা ওনার একটা স্মৃতির টুকরো। “বাইফোকাল”। স্বামীর পছন্দ করে দেওয়া। এটিই
ওনার প্রথম ” বাইফোকাল”। একই বৃত্তে নিকট-দূর….একই ছোঁয়ায় অতীত-বর্তমান….।

বৃদ্ধাশ্রমটা নতুন আর খুব সুন্দর খোলামেলা।
একটা সুন্দর ব্যালকনি আছে ওনার ঘরের পূর্ব
দিকে। রোদ উঠলে উনিই বোধহয় প্রথম দেখতে
পান। সামনে বিস্তৃত প্রাচীর, মধ্যে বিশাল এক
লোহার গেট। গেটের পাশেই রাধাগোবিন্দের মন্দির। এই ঝুল ব্যালকনিতে বসে সব দেখা যায়।

ঘরের মধ্যে প্রদীপ জ্বলছে। আলোয় ভরা চারদিক। কে যেন হঠাৎ এক ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে
দিলো আলোটা। ভাবছিলেন…।…ছায়াদেবী….।
অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, তুখোড় মেয়ে, অফিসার
স্বামী, অফিসের বিশাল বাংলো, আধ ঘন্টায় সব
ভেঙে তছনছ। ” সিভিয়ার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। ”
ভবতোষ চৌধুরী দিব্যলোকে চলে গেলেন।
ঝুল বারান্দায় বসে পিছনের কথাদের ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিলেন ছায়াদেবী। বৃদ্ধাশ্রমের পঁাচিলের পাশ দিয়ে চলে গেছে মেঠো পথ।গরুর
পাল বাড়ি ফিরছে বিকেলে, রাখালের তত্বাবধানে।
ভাবছিলেন, তিনিও এখানকার কতৃপক্ষের
তত্বাবধানে। গরুগুলোর মতোই নিরুত্তাপ, ছন্দহীন, সব থেকেও কিছু্নাই- হীন, এক ছন্নছাড়া
জীবন। গরুগুলো যেমন অভ্যেস মত চলে, তেমনই চলা। একা একা বাঁচা। এটাই বেছে নিতে হল শেষ পর্যন্ত।
মনটা একা একা ঘুরছে।একটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে ও মেঝেতে ঘুরছে।সেইদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রাজা- মুন্নির মা।
একটা টিকটিকি টক্ টক্ করে ডেকে উঠল।
ওটা কোথায় থাকে? অনেক খুঁজেছেন ঘরটার দেওয়ালে দেওয়ালে। খুঁজে পাননি। এই বৃদ্ধাশ্রমটি
একদম নতুন। নতুন বাড়িতে টিকটিকি আসে কোথা থেকে? তবে কী এটা ছায়াদেবীর মনের মধ্যেই থাকে? সেখান থেকেই মাঝে মাঝে ডাক দেয়? কে জানে!

(দুই)

স্নেহা ভট্টাচার্য। ছায়া দেবীর চেয়ে পুরানো আবাসিক, এই বৃদ্ধাশ্রমে। বয়স ৬০ – ৬২ র মধ্যে
হাঁটছে। আলাপ হলো সেদিন, লিফ্টে, নাবতে নাবতে। ওনার একটিই মেয়ে। পুত্র সন্তান নেই।
জামাই বাবাজীবন সেলসে। ঘন ঘন বিদেশ যেতে হয়। এদিকে মেয়েও বম্বেতে ONGC’ র সিনিয়র
এক্সিকিউটিভ। অতএব ওরা এটাই সাজেস্ট করল। বসত বাড়ি রাখার হ্যাপা অনেক। বিক্রির টাকা ব্যাংকে রেখে বৃদ্ধাশ্রমে। এদের পরিবেশ ভাল। সার্ভিস ভাল। রেটটাও মডারেট। মেডিকেল এর দিকটাও ঐ টাকাতেই কভার করছে। আর কি?
থাকো না ক’ দিন। দ্যাখো ভালো লাগবে। কত
নতুন মানুষ! যদি ভাল না লাগে…..তখন….না, ভালোই লাগছে। এক নতুন পটভূমি, নতুন আঙিনা, নতুন জগত। কত নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা চেনা জানা কথা আলাপ। এটাই বা কম কী? এখনো পর্যন্ত একুশ জন আবাসিক এখানে। সকাল সন্ধ্যায় দুবেলা তাদের সাথে কথা হচ্ছে ডিনার লাঞ্চের টেবিলে। ভালই, ভালোই লাগে…..।

৬৮ এর পবিত্র সেন। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর
দেড়েক। একটিই ছেলে। সেও স্ত্রীসহ পরবাসে।
অতএব। পবিত্রবাবু সেদিন নিজেই বলছিলেন
” ডি ভি সি’ র পবিত্র সেন
কে খায় তার পেনশন্ “। —- এটাই না
কি একসময় প্রবাদ ছিল। বল্লেন- ছেলে কে
বল্লাম ” কেন শুধু শুধু তোর বোঝা বাড়াবো? তুই
রাশিয়া জাপান আমেরিকা চাকরি নিয়ে চলে যা।
বৃদ্ধাশ্রম, সেবাশ্রম, ধর্মাশ্রম বুঝি না। খাব-দাব মৌজ করব। আজ এখানে আছি, ভাল না লাগলে
কাল ফুরুৎ। অন্য কোথাও ফুল হয়ে ফুটব। দীঘা
পূরী, বেনারস… । তুই ভাবিস না। ইউ এনজয়
ইওরসেল্ফ। ছেলে এখন দুবাইয়ে।

“— চলুন না স্নেহাদি, এইট্টিফোর এ কৌশিক গাঙ্গুলির একটা ভাল মুভি এসেছে। ” বিজয়া”। যদি যান, যদি কেন, চলুন না। একটা ওলা বুক করি তাহলে? আরও যদি কেউ যান..না। আর কেউ নেই। বাষট্টি চলেছেন আটষট্টির সঙ্গে। মুভি দেখতে। এটা বন্ধুত্ব, রোমান্স, নাকি একটু উচ্ছ্বাস খুঁজে নিতে? কে জানে? ভারতী একাই একটা গোটা ভারতবর্ষ। এখানকার অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার। সমস্ত আাবাসিকের তদারকির দায়িত্বে। কারুর কোনো সমস্যা মানেই ভারতী। সমাধানও ভারতীই। কার সকালে গরমজল লাগে, কার লাল চা, কার খালি পেটে ওমেজ, কার বেস্পতিবারে গোবিন্দের মন্দিরের জন্যে লাল বাতাসা। সব ভারতীর মুখের মধ্যে বসে আছে। শুধু বলার অপেক্ষা। সর্বদা হাসি মুখে হুকুম তামিল। আর সংবাদ পরিবেশনে এক্কেবারে ‘ আনন্দবাজার পত্রিকা। ‘ সবার ” মুস্কিল আসান “। ভারতীর কাছেই অনেক খবর পান ছায়াদেবী। ওর কাছেই শুনেছিলেন এক আবাসিক খুব অসুস্থ। দুবেলা ডাক্তার আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। তিন তলায় একদিন গিয়েও ছিলেন।ওনাকে দেখতে।অনন্যা দিদিমনির সঙ্গে। খুবই মিশুকে ভদ্রলোক। সত্যজিত তালুকদার। রিটায়ার্ড অংকের শিক্ষক। বল্লেনঃ “আসুন, আসুন। আমি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে সবাইকে ভোগাচ্ছি। সারাজীবন অংক শিখিয়ে গেছি ছাত্রদের, এখন নিজের হিসেবে গরমিল ধরা পড়েছে।রক্তে মিষ্টি, সঙ্গে উচ্চচাপ। কিডনি বেচারিরা দুজনেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। হৃদয়ের তাই মুখভার । বসুন বসুন দুজনে, ওই সোফাটায়। আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। সারাজীবন ছাত্রদের নিয়েই কেটেছে। ছাত্ররা কী দুষ্টু যে হয়! আমার সত্যজিত তালুকদার কে ওরা ছোট করে দিয়েছিল। এস. টি.। ওই নামেই সবাই এখনো চেনে। আমার গিন্নী বলতে পারেন অকালেই ভগবানের ঘরে অতিথি হিসেবে চলে গেছেন।আমাকে ফেলে। এবার বোধহয় আমার ডাক পড়বে।ছেলে আছে দুটি। একজন কানাডা, একজন আমেরিকায়। সময় বড় কম তাদের। এদিকে আমার সময় নিয়তির কাছে বাঁধা। অগত্যা এখানে। কতৃপক্ষকে জালাচ্ছি।ছেলেরা ফোনে খবর নেয়,তবে আমি ভাগ্যবান, আমার ছাত্ররা ভীষণভাবে আমার পাশে আছে। শীতটা পড়েছে খুউব। সবাই সাবধানে থাকবেন”।

কত আপনজনের মত কথা। কত সুন্দর আন্তরিক ব্যাবহার। ছায়াদেবীর বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠলো। মানুষটার দু দুটো ছেলে থাকতেও আজ বাবার রোগ শয্যার পাশে কেউ নেই।

(তিন)

বাষট্টি আর আটষট্টি পাশাপাশি দুটো সিটে। সিনেমা চলছে।প্রোজেকটারের হাল্কা বেগুনি আলো সাত রং ছড়িয়ে পড়ছে ওদের দুজনের মাঝে। রজতের কবিতার সূত্র ধরে বলা যায় “একটি হাত খুঁজে চলে আর একটি হাত”। একটাই পাখি আছে বোধহয় ওদের দুজনের পৃথিবীতে। সেটা ডাকছে। মাঝেমধ্যে। সেটা কোকিল না ডাহুক? কে জানে?
এটা প্রেম? না বন্ধুত্ব? না নির্ভরতা? ওরা কেউ জানে না। জানে এই রুক্ষ বালি-বালি জীবনে যদি একটা পরিষ্কার মেঘ ভেসে ওঠে! হঠাৎ করে।যদি ছেলেবেলার সরস্বতী পূজোর বাসন্তী রঙের শাড়ীটা নারকেল কুল খেতে শুরু করে! যদি একটাই ছাতার তলায় দুজনে বৃষ্টিতে ভেজে অকারণে, অসময়ে।
কত ভাবনার ভীড়। কত রকমের। এটা পাপ? না না, এটা মোহ। না, এটা কিচ্ছু না। একটা সময়- পার – করা সাঁকো। নড়বড়ে। বড্ড নড়বড়ে।
পবিত্র বলে উঠলেনঃ ” জানেন স্নেহাদি, কতদিন
পর হাল্কা হল মনটা। ধন্যবাদ আপনাকে। এখানে
আসতে রাজি হবার জন্য আর একবার ধন্যবাদ।
চলুন, বাইরে বেড়িয়ে জমিয়ে চা খাই কোথাও।”

একটা গোটা জীবন থেকে, একটা চব্বিশ ঘন্টার এলেবেলে দিন থেকে, একটা অনন্ত খন্ডকাল
থেকে, দু ঘন্টা দশ মিনিটের এক সিনেমা শো, আনন্দ দিতে পারে দু দুটো একাকী জীবনকে। এ
জন্যই আমাদের বাঁচতে হয়। বাঁচার অভ্যেস করতে হয়। এ জন্যই বোধহয় হাওয়া বয় চরাচরে। কেউ সেই হাওয়ায় শ্বাস নেয় বুক ভরে,কেউ সাহস পায় না। মুখ লুকিয়ে বাঁচে। স্নেহার ঘর অব্দি এগিয়ে দিয়ে নিজের আস্তানায় চলে গেলেন পবিত্র। একটা শচীন কত্তা (দেববর্মন)বেজে উঠল আটষট্টির ঘরে। একটা বিসমিল্লার সানাই সুর খুঁজে চলেছে বাষট্টির শূন্য বুকে।

(চার)

আজ চারদিন হল সত্যজিত তালুকদার কে স্থানীয় এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছেন বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ। মাথায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সুগার প্রেসার সবাই একসাথে অবাধ্য হয়ে উঠে- ছিলো। এস. টি’র ছেলেদের সাথে কথা বলেই এই সিদ্ধান্ত। জীবন পাখিকে ধরে রাখতে এখনো “ইনটেনসিভ কেয়ারে”। হয়তো ভেনটিলেশনে দিতে হতে পারে। ওনার ছাত্ররা পালা করে হাসপাতালেই আছে।
দীপু-ছটুর বাবা এখন ICU সেভেন। ওটাই ওনার নম্বর। দীপু – ছটু সময় পায়নি। অফিসের চাপ।কিন্তু ওনার একদম সাধারণ এলেবেলে ছাত্ররা
সারাক্ষণ আছে। ভাগ্যিস, এই ছাত্ররা অত্যন্ত সাধারণ চাকরি করে, তাই ছুটি পায়। এগিয়ে আসে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তারবাবুরা যখন যা বলছেন, ছাত্ররা তখন তাই যোগান দিচ্ছে ধারদেনা করে। পরে হিসেব মত সব মিটিয়ে দেবে দীপু-ছটু। ফোনে এমনই কথা হয়েছে। কিন্তু, আজ অবস্থা ভালো নয়। এস. টি. কোমায় চলে গেছেন। একটা আসন্ন মৃত্যুর সংকেত দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শহরের সব গাছগুলো আজ স্তব্ধ। কোনো পাতা নড়েনি। দোল খায়নি হাওয়ায়…
ব্যালকনিতে বসে সব খবর নেন ছায়াদেবী ভারতীর কাছ থেকে। কী হবে? যদি…, একটা
কিছু ঘটে যায়? কে নেবে এতো দায়ভার আপনজন, সন্তানরাই যে কাছে নেই।
এক অচেনা দেশে চলে গেলেন সত্যজিত বাবু।
জিৎ হলো না, হেরেই গেলেন নানা জটিল রোগের
কাছে। স্যারের ছাত্ররা সকলেই এসেছে, সৎকারে।
ওরা তৈরি। একটা বড্ড চেনা মানসিক উদ্বেগ ওদের সঙ্গী। দীপু-ছটুর সঙ্গে একটু আগে ওনার ছাত্রদের ফোনে কথা হয়ে গেছে। কানাডা আমেরিকাবাসী ছেলেরা জানিয়েছে, WhatsApp এ বাবার শেষ যাত্রার ভিডিও পাঠাতে আর দাহ-পর্বের লাইভ সৎকার- শো। চিতায় শোয়া বাবার শেষ ছবি।
“আজ বোধহয় রঙের দোকান আর মেঘলা
আকাশ দুজনেরই ছুটি। “ইন্টারনেটের কন্ডিশন ও
ভালো। সুন্দর সব ছবি উঠছে। যাচ্ছে আকাশ
পেরিয়ে। এই বদলে- যাওয়া দুনিয়ার পাশ দিয়ে,
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, এ লোক থেকে ও লোক,
দ্যুলোক ভূলোক দিব্যলোক গ্রহ-মণ্ডল নক্ষত্রমণ্ডল
পেরিয়ে, আরও দূরে, বহুদূরে – অজস্র সব
ঝকঝকে ছবি।
শূন্য আকাশের দিকে তাকালেন ছায়াদেবী।
রাজা- মুন্নির মা। নীল সাদা মেঘ কিচ্ছু নেই আকাশে আজ। আকাশটা আজ বড্ড ফ্যাকাশে।
তেজপাতার মত বিবর্ণ। “সব রং কেউ যেন
ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।” অনায়াসে।

সমাপ্ত

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *