শঙ্খশুভ্র পাত্র-র কবিতাগুচ্ছ
কারুকথা
ইতিপূর্বে বলিনি — যা উপভোগ্য, যোগ্য বিবেচিত ৷
আমাকে সমূহ ক্ষমা, বেঁধে রাখো চর্যাপদে, আর
দিনের প্রথম সূর্য, রক্তাভ কুসুমে সুরভিত
হাওয়ায় ছড়ালে প্রীত, সাক্ষরিত, মাটির দুয়ার…
ইতিপূর্বে বলিনি সে-পূর্বাকাশ, কার্নিসের ধারে
মেঘের মেদুর ছায়া, ছেঁড়া-ছেঁড়া, অল্প অভিমানী
ধাক্কা দিলে এই বুঝি — ঝরে পড়ে, অসংবৃত দ্বারে
দু’হাত বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলে — বাণী…
ইতিপূর্বে বলিনি সে- পাণ্ডুলেখ, প্রতীক্ষা কাতর
দীক্ষার্থে সাধনা এই : একা-একা অসংবেদী গৃহ
স্বীয় লোকজন ভুলে কীরকম উদাসী, পাথর
হয়ে গেছি দিনেদিনে — কথামৃত, অন্তরাল প্রিয়…
ইতিপূর্বে বলিনি সে-কারুকথা, দারুময় ঘোর
অসম্পূর্ণ হাত দু’টি — কে না জানে ! আওজানো দোর…
ভুল
আদৌ ফুল কি ছিল ? এত ফুলকি দেখিনি জীবনে !
দোলাচলে অস্তাচলে— মেঘে-মেঘে অপূর্ব বাহার
কে পাঠাল ভালোবেসে— আলোকিত বেদনার ভার
আমি কি সইতে পারি ? শিশুর মতন অকারণে
কেঁদে উঠি ৷মুছে দাও— এই দু’টি চক্ষুধরাতল…
পরাজিত সুখ— আমি বিজয় চাই না কোনওখানে ৷
আবেগ মুহূর্ত— ওই কালোমেঘে, লালনের গানে
যেন এক মহাবিন্দু—ছুঁয়ে আছে সুরের গজল ৷
যে-তুমি আঁধারমতি, ভূমিকাবিহীন তারাদেশ
মাথা পেতে নাও ঢেউ— নদীর অধিক, উপচার
মন্ত্র সেই সরস্বতী, শাদাপাতা— অহেতু প্রচার…
সেতুর সকাশে এসে খুঁজে পাও ভোরের আবেশ ৷
ভুল কি কখনও ভোলে ! এত ফুল, ফুলকির কাছে
আমার সমস্ত মন— আনন্দ-বেদনা হয়ে আছে ৷
একমেবাদ্বিতীয়ম্
একে না নজর মেলে, দু’য়ে কিন্তু ধুয়ে যায় মন ৷
তিন ভিন্ন অনিশ্চিত, দেখা তো দূরের কথা, সাড়া
মিলিবে না কোনওদিন, লিলিফুল, তুমি নির্বাচন
মধুর বচনে বুঝি জয় করে নেবে মশিয়াড়া ?
শিয়রে নিঝুম চাঁদ, হিমঝরা-হেমন্তের ডাকে
পাতাটি ভিজিল, লেখা, মনোগত হয় নাই, জাদু…
নগরে কবিতা এত, গাঁয়ের ধুলোয় আজ তাকে
বেদনাবিহিত করো— একে যে মেলে না কৃপা, সাধু ৷
অসি-মসি-শশীতারা— মাঝখানে কাগজের সেতু
কুয়াশা বিভোর— সাদা, শূন্যমন, বিরহিত-রাই…
পারাপার— একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ, তিনে সেই হেতু
চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে— কী আশ্চর্য ! লালন গোসাঁই ৷
একে না নজর মেলে, দু’য়ে কিন্তু ধুয়ে যায় মন…
রুক্ষমাটি,দুঃখ-ব্যথা, আমাকে জাগাও ত্রিভুবন ৷
প্রথার বাইরে
প্রথার বাইরে কিছু কথা থাকে — আঁকিবুকি টেনে
নিজেকে জাগাব, সুখী, আদ্যোপান্ত — এই মনোভাবে
রেকাবে রেখেছি ফুল, সুচন্দন — উপচার মেনে ৷
পূজার্চনা, উজাগর দৃষ্টিখানি বয়ে ঠিক যাবে
তোমাকে উদ্দেশ্য করে ৷ “বেবুশ্যে” বুঝি না আমি,ধিক্ ৷
দিকভ্রান্ত বলে তুমি শান্ত করো তাকে বারেবারে,
”বাহবা” পাওয়ার মতো লিখি নাই স্থুল, শারীরিক…
রাগে রি রি ছিরিখানি মানায় কি গজমোতি হারে ?
মতিভ্রমে আমিও মজনু সাজি লায়লার প্রেমে,
“মজিনু” ভুলেছি কবে— “ওলো, সই” কই না তো আর
হইহই করে তাকে বেঁধেছি তো আধুনিক ফ্রেমে
তবে কি কথার জাদু ? দাদুরে মেতেছে অভিসার !
প্রথার বাইরে কিছু কথা থাকে — পিছুডাক মানি,
না বুঝিলে নিরুপায় — হাওয়ায় ভাসুক কানাকানি…
কী হবে অধিক ?
কী হবে অধিক ? ওই ‘ধিক’ বাক্যে ভূমিষ্ঠ প্রণাম
আজ রেখে যাব কায়কল্পে — কেন না যুগান্তকাল
গল্পের গথিক গেঁথে কতখানি বাঁচা যায় ! নাম —
এক যশোকাঙ্ক্ষা, সুখ ৷তীব্র হলে সব বেসামাল ৷
এই যে বিনত, গ্রাম্য ৷ ভ্রাম্যমাণ — মূর্ধণ্য চিহ্নিত
হরিণীর কাছে যত ডালপালা — কস্তুরী আবেশ…
শিরোধার্য করে নিলে — ভালবাসা — সহজে নির্মিত
চতুর্থ চরণে এসে থেমে যায় অরণ্যপ্রদেশ ৷
পাতাঝরা মধ্যরাত, হেমন্তের মর্মরিত ঘুম
শিশিরে ভিজছে ৷স্বপ্ন… একাকার ঢেউ, সেই মন
ও আমি পারি না, স্থির, তার কাছে থাকতে নিঝুম
শব্দে বাঁধি আদিগৃহ, অত:পর মহানিষ্ক্রমণ…
কী হবে অধিক ? ওই ধিকবাক্য, নদী-নারী-নাম…
লুম্বিনী ঘুমিয়ে আছে ৷ শেষরাত, তোমাকে প্রণাম ৷
অন্ত্যমিল
মিল হোক — অন্ত্যমিলে ৷ এই তো চেয়েছি টানটান…
কাজিয়া কখনও নয় — সহজিয়া সুরে এসো, শুভ ৷
তাৎক্ষণিকের লোভে কিছুতে মেলে না প্রাণ — ধ্রুব,
মাটির সেতারে আজও অনাদিকালের সেই গান
বেজে ওঠে শুশ্রূষায়, ভালবেসে বুকে তাকে ধরো ৷
অধরা, ধরার স্বাদ কে না জানে, ধারা বিগলিত
এই তো, এসেছ লয়ে, আলয়ে প্রদীপ নিবেদিত ৷
বেদনা-ব্যাকুল স্পর্শে তমসা ভুলেছে ঘর, পরও ৷
সমতা, ক্ষমতা নয় — তাকে আমি মমতার পাশে
বসিয়েছি চিরকাল ৷সম্মিলিত, হাতে-হাত রেখে ৷
যেভাবে মুহূর্ত জ্ঞানে — বিমূর্ত গভীর রাত থেকে
কবিতাকে তুলে আনি — নিজেকে ছড়াই চারপাশে ৷
সেইমতো শুদ্ধমতি — মিল থেকে অন্ত্যমিলে আজ
তোমাকে বসাবো ছন্দে— হৃদয়ে বাজুক এসরাজ ৷
প্রিয় সম্পাদক
প্রকাশিত নয় ৷ তবু ভুল করে সে-কবিতা ফের
আপনাকে পাঠিয়েই — অনুতাপে জর্জরিত হই ৷
তাই আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে আপনাকে চুপিচুপি কই :
আমি না-তেমন কবি, অধিকন্তু, কথা-আলাপের
পক্ষেও সুবিধাহীন ৷ মুসাবিদা — এইটুকু জানি ৷
ইমেল ঠিকানা চেয়ে ডাইরিতে টুকে রাখি নাম ৷
এ-এক দুরন্ত নেশা — এ-আমার কবিতা ইনাম,
কায়মনোবাক্যে বুঝি —লেখা জল, লেখা মাত্র পানি ৷
এ-ব্যতীত আমি আর কীভাবে বলবো ভালবাসা ?
বিভাবে ছড়িয়ে দিই আমার সকল শিশুমতি…
প্রকাশিত নয়, তবু সে-লেখার কিছু একটা গতি
হলে তো পাঠক খুশি, উপরন্তু, এই আলো-ভাষা
দু-চোখে জাগিয়ে রাখি— যুক্তকরে জমে ওঠে ক্ষমা…
আমার কবিতা হোক — পাখির ডাকের তরজমা ৷