বাঁশবনে সূর্য
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
ভদ্রলোকের হাঁটতে যথেষ্টই কষ্ট হচ্ছিল। ডিসেম্বরের শীতেও তাঁর কপালে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘামই জানান দিচ্ছিল তিনি ক্লান্ত। হাঁপিয়ে পড়েছেন। কষ্টটা একসময় আর চেপে রাখতে পারলেন না। বলেই ফেললেন – ‘এভাবে আর কতক্ষণ হাঁটিয়ে মারবেন মণিবাবু?’
সঙ্গের জন মণিময়বাবু অর্থাত্ মণিময় চৌধুরী আশ্বস্তের সুরে বললেন – ‘আর বেশিদূর না সজলবাবু। চলে এলাম বলে। আর মিনিট পাঁচেক। ঐ যে নদীটা দেখতে পাচ্ছেন – ওটা পেরোলেই সামনের যে গ্রামটা। ওখানেই সূর্যশেখরবাবুর বাড়ি।’
-‘পাঁচ মিনিট, পাঁচ মিনিট করে তো আধঘণ্টার পথ নিয়ে চলে এলেন। এতটা যখন পথ জানতেন তখন তো রিক্সা-টিক্সা কিছু একটা করে নিলে ভালো হতো।’ কপালের ঘাম রুমাল দিয়ে মুছে ক্লান্ত সজল সান্যাল কথাগুলো বললেন।
মণিময়বাবু হাসলেন সজলবাবুর কথা শুনে। বললেন – ‘রিক্সা-টিক্সা আবার কোথায় পেলেন এখানে?’
-‘কেন? যেখানে বাস থেকে নামলাম, ওখানে রিক্সা পাওয়া যেত না?’
-‘না মশাই না, এখানে এস কিছু মেলে না। দেখলেনই তো ছোট বাস স্টপেজ একটা। ক’জনই বা ওঠানামা করে বাসে? যে দু’চারজন ওঠানামা করে তারা সব পায়ে হেঁটেই গন্তব্যস্থলে চলে যায়। কেউ কেউ সাইকেলে যাতায়াত করে। আর রিক্সা যে চলবে সেরকম রাস্তাই বা কোথায়?’ বললেন মণিময়বাবু।
-‘ও’। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সজলবাবু। আর শব্দটা মুখ থেকে এমনভাবে বেরিয়ে এল যেন গ্রামের দীনতাকেই কটাক্ষ করল।
মণিময়বাবুর দৃষ্টিতে সেটা এড়াল না। বললেন – ‘সজলবাবু এরকম কেন করছেন আপনি? গ্রামে বেড়াতে আসছেন-একটু আধটু হাঁটবেন না-তা কী কখনো হয়?’
কথাটার মধ্যে একটা বাঁকা অর্থ ছিল। সেটা না বোঝার মতো অত বোকা সজল সান্যাল অন্তত নন। লজ্জা পেয়ে বা অন্য কোনো কারণেই হোক ভাবলেন – এ ব্যাপারে কথা বাড়িয়ে বিশেষ লাভ নেই। আর মণিময়বাবুকে দোষ দেওয়াও ঠিক হবে না। কারণ গ্রামে বেড়াতে আসার ইচ্ছেটা এবার তারই হয়েছে। মণিময় তার সঙ্গী মাত্র।
এই তো গত পরশুদিনই হঠাত্-ই সজলবাবু বলে ওঠেন – ‘আচ্ছা মণিময় বড়োদিনটা এবারে একটু বেড়াতে গেলে কেমন হয়?’
সঙ্গে সঙ্গে মণিময়বাবু সম্মত হয়ে বলেছিলেন – ‘বেশ তো চলুন না। কোথায় যাবেন বলুন দিঘা-পুরী দার্জিলিং’-
-‘না-না-না’ বাধা দিয়ে উঠেছিলেন সজলবাবু। বলেছিলেন – ‘ওসব জায়গায় নয়। ও ঘোরা হয়েছে। এবারে একটু জম্পেশ করে গ্রামে ক’দিন ঘুরে আসি চলুন।’
-‘গ্রামে যাবেন!’ বলে কিছুটা অবাক হয়ে তির্যকপূর্ণ চোখে সজলবাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন মণিময়বাবু।
-‘ওভাবে তাকাচ্ছেন যে? আপনার কী বিশ্বাস হচ্ছে না? সত্যি বলছি গ্রামে একবার বেড়াতে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছে।’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে সজলবাবু জানতে চেয়েছিলেন – ‘গ্রামে আপনার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই? কিংবা কোনো আত্মীয়-স্বজন?’
-‘বন্ধু-বান্ধব! দাঁড়ান’- এরপর মিনিটখানেক ভেবে নিয়ে মণিময়বাবু বলে উঠেছিলেন – ‘হ্যাঁ, পেয়েছি, সূর্যশেখরবাবুর বাড়ি গেলেই হয়।’
-‘সূর্যশেখর! কে সে?’
-‘কেন এর আগে নামটা শোনেননি আপনি? কাগজে-টাগজে আজকাল লেখেটেখে যে।’
-‘কাগজে খুব লেখে! ও সূর্যশেখর সামন্তর কথা বলছেন? ওনার অনেক লেখাই তো আমি পড়েছি। কি দারুণ সব লেখেন।’
-‘লেখাগুলো দারুণ সব হলে কি হবে। দারুণ জায়গায় কিন্তু থাকেন না। একেবারে একটা অজ পাড়া-গাঁয়ে থাকেন।’
-‘বলেন কি!’ বিস্মিত হয়েছিলেন সজলবাবু।
একমুখ হাসি নিয়ে গর্বের সঙ্গে মণিময়বাবু বলেছিলেন – ‘তবে আর বলছি কি। আজকালকার দিনে গাঁয়ে বসেও যে ওরকম সাহিত্য রচনা করা যায় – সূর্যশেখর সামন্ত তার উদাহরণ।’
-‘গ্রামে যাবার লোভ তো আমার আরো বেড়ে গেল মণিময়বাবু। বিশেষ করে সূর্যশেখরবাবুকে দেখার লোভ। আচ্ছা, সূর্যশেখরবাবুকে আপনি চেনেন?’
-‘চেনেন বলছেন কী? সূর্যশেখর যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একসাথে পড়েছি। লেখালেখির দিকে বরাবরই একটা ওর একটা ঝোঁক ছিল। তখন কী জনতাম একদিন সত্যি সত্যিই এতবড়ো লেখক হয়ে উঠবে। আমাকে প্রায় সময়ই সূর্যশেখর কী বলত জানেন?’
-‘কী?’ সজলবাবু জানতে চাইলেন।
মণিময়বাবু বললেন – ‘সূর্যশেখর বলত, জানিস মণি, আমার না গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে একেবারে ভালো লাগে না। কেমন যেন মায়াবী আকর্ষণে গ্রাম আমাকে সর্বদা টানে। আমি তো জয়েন্ট এন্ত্রান্সে চান্স পেয়ে চলে এলাম কলকাতায়। সূর্যশেখর ভালোভাবে পাশ করে ওখানকারই কাছাকাছি একটা কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পাশটাশ করে স্কুলে মাস্টারিও পেয়ে গিয়েছিল। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য সাধনাও চলছিল। সেই সূর্যশেখর একজন নামকরা লেখক আজ।’
মুগ্ধ হয়ে কলিগ বন্ধুর কথাগুলো একমনে শুনে যাচ্ছিলেন সজলবাবু। মণিময়বাবুর কথা বলা শেষ হলে তিনি বলেছিলেন – ‘আরে! এরকম একজন বিখ্যাত মানুষ আপনার বন্ধু-আগে তো বলেন নি। চলুন সূর্যশেখরবাবুর গ্রাম ঘুরে আসা যাক একবার। ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়ও হবে, আর গ্রাম বেড়িয়ে আসা যাবে।’
-‘কিন্তু একেবারে গণ্ডগ্রাম, ভালো লাগবে তো আপনার? নানান অসুবিধা ফিল করবেন। তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিলে হবে না। জেনে রাখবেন সবাই সূর্যশেখর সামন্ত নয়।’
-‘না-না, আপনাকে দোষ দেব না। গ্রামে বেড়াতে যাব বলেছি যাব। আপনি নিয়ে যাবেন।’
-‘তাহলে আর অসুবিধা কী। আগামী পরশুদিন রওনা দেব।’ মণিময়বাবু বলেছিলেন।
দুই
সেই একেবারে পাকাপাকি কথা। আর গ্রাম বেড়ানোর উদ্দেশ্যে সজল সান্যালের বেরিয়ে পড়া। সাথে কলিগ বন্ধু মণিময় চৌধুরী। হাওড়া-সন্ধিপুর এক্সপ্রেস বাসটা যখন ওদের নামিয়ে দিল তখন সূর্য সামান্য হেলে পড়েছে। শীতের রোদ মরতে শুরু করেছে। মণিময়বাবু ঘড়ি দেখলেন। বেলা আড়াইটে। এরই মধ্যে উত্তুরে হিমেল হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। ছোট্ট বাস স্টপেজটা ছেড়ে সজলবাবুরা মাঠের মাঝখান বরাবর চলে যাওয়া রাস্তাটায় উঠলেন। দু’পাশে সবুজ আলুর ক্ষেত। গাছ এখনো সেরকম বড়ো হয়নি। পায়রার চোখের মতো চোখ তুলে সবে দু’চার করে পাতা ফেলা শুরু করেছে।
রাস্তাটা অনেকদিন মেরামত করা হয়নি। এবড়ো-খেবড়ো। এখানে সেখানে ছোট-বড়ো গর্ত। বহুদিন আগে বোঝা যাচ্ছে মরাম ফেলা হয়েছিল। কিছু কিছু জায়গার মোরাম উঠে গিয়ে মাটি বেরিয়ে পড়েছে। তাতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দুর্বার ঝাড়। গরুর গাড়ি চলে রাস্তার দুধার একেবারে বেখাপ্পা জঘন্য। দু’একবার হোঁচট খেতে খেতে সজলবাবু নিজেকে সামলে রেখেছেন। আবার একবার হোঁচট খেতে গিয়ে বললেন – ‘রাস্তাটা ভীষণ খারাপ!’
মণিময়বাবু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন – ‘এখন তো তবু অনেক ভালো দেখছেন। বছর দশেক আগে এলে চলতেই পারতেন না। এই রাস্তাটা তো আগে ছিল না। মেঠো একটা আলপথ ছিল। এখানকার পঞ্চায়েত মাটি ফেলে মোরাম দিয়ে রাস্তাটা বানিয়েছে। এখন ভেঙে চুর হয়ে গেছে। ভোট এলে দেখবেন ঠিক মেরামত হয়ে যাবে। পঞ্চায়েত ভোটে এগুলো একটা বড়ো ইস্যু।
মণিময়বাবুর কথাই ঠিক হল। কয়েক মিনিট এগোতেই নদীটা পড়ল। নদীতে তেমন জল নেই। হাঁটুর নিচে। তবু বুট মোজা পরে তো পেরনো যায় না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও খুলতে হল। প্যান্ট গুটিয়ে উপরে তুলতে হল। একটি মধ্যবয়সী মহিলা গা ধুচ্ছিল ঘাটে। কাপড় খুলে। হঠাত্ দুজন অপরিচিত ভদ্রলোককে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল সে। কোনরকমে তাড়াতাড়ি করে সায়াটাকে বুকের উপর তুলে পিছন ফিরে সরে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে।
-‘দেখছেন শীতের জল কী ঠাণ্ডাই না হয়ে আছে।’ মণিময়বাবু বললেন জল পেরোতে পেরোতে।
সত্যিই জলটা বড়ো ঠাণ্ডা লাগছিল সজলবাবুর। জলে পা দেওয়া মাত্রই একটা শিরশিরে অনুভুতি পা থেকে মাথা অবধি উঠে গেছে তার।
মণিময়বাবুর কথা মতোই নদীর পরই গ্রামটা পড়ল। একটা গাড়ি চলাচলের মতো রাস্তা ঢুকে গেছে গ্রামের ভিতর। ধুলোয় আর বালিতে একেবারে মাখামাখি। বর্ষায় যে এ রাস্তা কাদায় ভরে যায় তা ধুলোর পাহাড় দেখেই বুঝতে পারছিলেন সজলবাবু। ধুলোটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে কোনরকমে পা ফেলে ফেলে দুজনে এগোতে লাগলেন।
গ্রামে ঢোকামাত্র ঠাণ্ডাটা যেন আরও বেশি করে অনুভূত হল। অজস্র গাছ-গাছালি আর ঝোপে-ঝাড়ে ভরা গ্রাম। সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে পড়ল তা হল বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের মধ্যে মধ্যে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানকার বাড়ি ঘরগুলো সব। বিকেলের রোদ এখানে আর বেশি করে মরা। ঘনবদ্ধ বাঁশগাছের ঝাড় সূর্যের আলোকে যেন আড়াল করে রেখেছে। তারই মধ্যে ফাঁক-ফোকর দিয়ে যেটুকু রোদ পড়ছিল উঠোনে দেখা গেল সেখানে মাদুর কিংবা তালাই পেতে লোকজনেরা শুয়ে বসে গল্প করছে। মেয়েরা অনেকে রোদ পিঠ করে দুপুরের আহার সারছে। তাদের পিঠের চুল এলো করা।
এক জায়গায় দেখা গেল বেশ কিছু মানুষের জটলা। কিশোর-তরুণের সংখ্যাই বেশি। একটা খড়ের চালাযুক্ত বড়ো ঘরের সামনে একটা বাঁশ দিয়ে মাইকের চোঙ টাঙানো। দু’একটা পান দোকানও রয়েছে। মাইকে একটি কিশোর কন্ঠে ঘোষণা চলছে আজকের ছবি-তার মানে ভি ডি ও চলছে। সজলবাবুদের বুঝতে অসুবিধা হল না। পাশ কাটানোর সময় ওদের দুজনকে দেখে কেউ কেমন বিস্মিত হয়ে তাকাল। সজলবাবুর জায়গাটা অচেনা হলেও মণিময়বাবুর চেনা। তাই সূর্যশেখর সামন্তর বাড়ি খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট হল না।
তিন
উঁচু ভিটের উপর পাকা একতলা বাড়ি। কয়েকটা সিঁড়ি গেট পর্যন্ত উঠে গেছে। বাম দিকে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। কয়েকটা বাহারি ফুল ফুটে আছে। ডানদিকের খামারটাতে ধান সহ খড় পালুই করে গাদা দেওয়া। বাড়ির ডিজাইনটা বেশ আধুনিক।
গেটের মুখ দিয়ে মণিময়বাবু হাঁক পাড়লেন—‘সূর্যশেখরবাবু বাড়িতে আছেন?’ একবারের বেশি ডাকতে হলো না।
-‘কে’? বলতে বলতে সূর্যশেখরবাবুর স্ত্রী করবীদেবী ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। মণিময়বাবুকে এক পলক দেখেই চিনতে পেরে গেলেন। হেসে বললেন—‘আপনারা! আসুন- আসুন, ভেতরে আসুন’। বসার জন্য দুটো চেয়ার পেতে দিলেন বারান্দায়।
চেয়ারে বসতে বসতে মণিময়বাবু বললেন,–‘যাক, আপনি তাহলে আমায় চিনতে পেরেছেন।’
-‘কেন চিনতে পারবনা। চেহারায় আপনার তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি। একটু যা মুটিয়েছেন। তবে ওনাকে–’
-‘উনি সজল সান্যাল। আমার সাথে একই অফিসে কাজ করেন। আর সজলবাবু—ইনি হলেন সূর্যশেখরের স্ত্রী করবীদেবী।’ নমস্কার বিনিময় করে করবীদেবী চলে গেলেন। এলেন আবার অল্পক্ষণ পরেই। বললেন বাথরুমে জল গামছা রেখেছি। মুখ হাত ধুয়ে নিন। যা ধুলোর সময় চলছে।
সজলবাবু বললেন—‘সূর্যশেখর বাবুকে দেখছি না তো।’
করবী দেবী বললেন—‘উনি তো স্কুল থেকে এখনো ফেরেননি। আপনারা চা জল খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিন—ততক্ষণে উনি ঠিক চলে আসবেন।’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
মণিময় আর সজলবাবু বাথরুমে গেলেন। মুখে হাতে পায়ে জল না বুলালেই নয়। বাথরুম থেকে ফিরে দেখেন ওদের বসার চেয়ার দুটোতে দু’টো ধুতি পড়ে আছে। আতিথেয়তার মাত্রাতিরিক্ত আয়োজন দেখে রীতিমতো বিস্মিত হলেন
সজলবাবু। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাড়িটাকে তিনি এতক্ষণ দেখছিলেন। সবকিছুতেই একটা আধুনিকতার ছোঁওয়া। গ্রামেও অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে তাহলে। রাস্তায় আসতে আসতেও বেশ কিছু পাকা বাড়ি চোখে পড়েছে তাঁর।
আধ ঘণ্টা গেল না। করবীদেবী রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মণিময়বাবুদের ডেকে নিয়ে গেলেন সূর্যশেখরবাবুর পড়ার ঘরে। বেশ সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো ঘর। ঝরঝরে তকতকে। একটা টেবিল। তাতে বাংলা ইংরেজি কয়েকটা পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ে। খাটিয়ার পাশে দেওয়াল আলমারিতে অজস্র বই। গ্রামের কোনও বাড়িতে এই বই থাকতে পারে সজলবাবুর জানা ছিল না।
-‘কখন খেয়ে এসেছেন তার ঠিক নেই। পেট তো খিদেই জ্বলছে। আগে কিছু মুখে দিন।’ বলে টেবিলের ওপর দুটো খাবারের থালা রাখলেন করবীদেবী। কাচের গ্লাসে দিলেন জল। থালা ভর্তি সুজি, পরোটা আর আলুভাজা।
-‘এত খাবার!’ বলে অবাক চোখে করবী দেবীর দিকে তাকালেন সজলবাবু।
করবীদেবী বললেন—‘এত আর কোথায়। এই তো সামান্য। গল্প করতে করতে খাওয়া হয়ে যাবে দেখুন।’
মণিময়বাবু পরোটার এক টুকরো চিবোতে চিবোতে বললেন—‘নিন নিন খেয়ে নিন। দেখুন না খেয়ে—মুখের স্বাদটাই পাল্টে যাবে। গাওয়া ঘিয়ে তৈরি পরোটা আর ঘরের আলুর ভাজা। একেবারে দেশী জিনিস। বেশি খেলেও শরীর খারাপ করবে না। কলকাতায় এই সব জিনিস আর পাবেন না মশাই।’
পেটে সত্যিই খিদে ছিল। তবু যতটা না খাচ্ছিলেন তার থেকে বেশি অবাক হচ্ছিলেন সজলবাবু। এবাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে তার অবাক হওয়ার পাল। এতবড় একজন বিখ্যাত লোকের স্ত্রী—সে কী না নিজের হাতে করে খাবার তৈরি করে খেতে দিচ্ছে অতিথিকে! কোন ঝি চাকর নেই। নেই এটা আন, সেটা কর বলে কোন আদেশ। গ্রাম বলে কি এখনো বেঁচে সেই আগের পুরানো দিনের গৃহিনীপনা? তাঁর শহর কলকাতায় এটার কি আর দেখা মিলবে কখনো?
জলখাবার শেষে চা পান পর্ব চলছে—সূর্যশেখরবাবু বাড়ি ঢুকলেন। পুরনো মান্ধাতা আমলের সাইকেলটা সাথে। সেটা ঢোকাতে গিয়ে গেটের শিকে লেগে ঝনঝন করে উঠল। সাইকেলের শব্দ শুনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেরিয়ে এসেছেন মণিময়বাবু। পিছনে করবীদেবী। মণিময়বাবু বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন—‘সেই পুরানো আমলের ভাঙা সাইকেলটা এখনো রেখেছিস? মায়া ছাড়তে পারিসনি মনে হচ্ছে। ওটা ফেলে দিয়ে একটা নতুন সাইকেল কেন না।’
বক্তার দিকে তাকাতেই একগাল হাসির ঝলক উঠল সূর্যশেখরবাবুর মুখে।
-‘আরে মনি, তুই! কখন এলি?’
-‘অনেকক্ষণ এসেছি রে। এসেই তোর ঘর দখল করে বসে আছি। আর এখন করবীদেবীর দেওয়া গরম গরম চা আয়েশ করে পান করছি।’ মণিময়বাবু হাসতে হাসতে বললেন।
সূর্যশেখরবাবুর ঠোঁটের কোণে আবারও মৃদু রেখা ফুটে উঠল। বললেন—‘বেশ করেছিস। তুই আসাতে খুব আনন্দ পেলাম রে। এখন তো আর খোঁজ খবর রাখিস না। মনে পড়েছে এই ঢের। তা ভালো হয়েছে। কাল তো ছুটি আছে। চুটিয়ে গল্প করা যাবে।’
সাইকেলটা বারান্দার এক কোণে রেখে দিয়ে এসে সূর্যশেখর বাবু আবার বললেন ‘একটু আগে সাইকেলটার কথা বলছিলি না। দেখ পুরোনো হলে কি হবে। কলকব্জা এখনো ঠিক মজবুত আছে। পথের মাঝে বিপদে অন্তত ফেলে দেবে না।’
-‘তাই।’ মুচকি হাসলেন মণিময়বাবু তাঁর বন্ধুর কথা শুনে।
-‘হ্যাঁ, পুরানো আমলের লোকের মত। সত্তর পেরিয়ে গেলেও তারা যেমন শক্ত কর্মঠ, পরিশ্রমী থাকে। এই সাইকেলটাও সেইরকমই সার্ভিস দিচ্ছে। উপরের রঙটা চোটে গেলে কি হবে কাঠামো কিন্তু শক্তই আছে। নড়বড়ে হয়ে যায় নি।’
কথাটা যখন সূর্যশেখর বলছেন তখন ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন সজল বাবু। সজালবাবুর দিকে তাকাতেই মণিময়বাবু পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন—‘এ হচ্ছে সজল সান্যাল। ইঞ্জিনিয়ার, আমার কলিগ। একেবারে শহুরে বাবু। গ্রাম দেখার শখ হয়েছে। এরই জন্যে আসা।’
সজলবাবু নমস্কার করলেন। প্রতি নমস্কার করে সূর্যসেখার বাবু বললেন—‘ভালো, শুনে খুব খুশি হলাম।’
-‘তাই নাকি! আমার মতো তাহলে অকাজের নেশাটাও আছে। কি ঠিক বলছিনা সজলবাবু। লেখালেখি তো অকাজই—তাই না?’বলে হেসে উঠলেন সূর্যশেখরবাবু।
হেসে উঠলেন সজলবাবুও। উত্তর দেবেন কি মুগ্ধ নয়নে সূর্যশেখরবাবুর কথা গুলো শুনছিলেন। সত্যিই কি অমায়িক ভদ্রলোক। ভেবেছিলাম কেমন না জানি রাশভারি আর গাম্ভীর্য পূর্ণ হবেন ভদ্রলোক। কিন্তু তার চিহ্নমাত্র নেই। চোখে মুখে যেন একটা শিশুর মতো সারল্য খেলে বেড়াচ্ছে। চেহারায় তেমন জৌলুস নেই। কিন্তু চোখ দুটি বড়ো বেশি উজ্বল। সূর্যের তীব্র আলোকের মতো। সে আলোভরা চোখ দিয়ে যেন কিছু একটা খুঁজে চলার কষ্টহীন অফুরন্ত প্রয়াস। সব বড়ো লেখকদেরই কি এটা হয়—সজলবাবুর জানা নেই।
চার
শেষ বিকেলে সূর্যশেখরবাবু এসে বসেছেন তাঁর কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের নিয়ে-নদী ধারে। গল্পে মেতেছেন।
সূর্যটা ডুবেছে। তার শেষ রশ্মিছটা আবির গলা রঙ নিয়ে গোধূলি বেলাকে করে তুলেছে বড়ো সুন্দর-মহিময়। এক টুকরো কালো জমাট বাঁধা মেঘের আড়ালে সূর্যের অর্ধেকটা ঢাকা পড়েছে। বাকি অর্ধেকটা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে আলোর বিচ্ছুরণ। যেন কোন নব বিবাহিতা বধূ তার আধখানা মাথাকে আলতো ঘোমটার আড়ালে ঢেকে লাজনম্র মুখে হাসছে।
ভারি অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে সজলবাবু জানতে চাইলেন-‘আচ্ছা সূর্যশেখরবাবু, দেখলাম একেবারে একটা প্রত্যন্ত এলাকাতে আপনি থাকেন। এখান থেকে আপনার লেখার কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি? অর্থাত্ আপনি কোন অসুবিধা বোধ করেননি?’
সজলবাবু আচমকা এই প্রশ্নে সূর্যশেখরবাবু হঠাত্ কেমন যেন হয়ে গেলেন। তাঁর মুখের হাসিটা হঠাত্ই মিলিয়ে গেল। একরাশ বিপদ যেন এসে চেয়ে ধরল তাঁকে। একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সূর্যশেখরবাবু বললেন, ‘অসুবিধা প্রতি মুহূর্তে। দেখছেনই তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা। যাতায়াতে অতিরিক্ত পরিশ্রম যেমন করতে হয়-তেমনি বাড়তি সময়ও অনেকটা চলে যায়। তবু সেকথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এই যে আমি লেখালেখি করি-এটা এখানে কয়জনই বা বোঝে। আপনারা বোঝেন এর মূল্য দেন। এখানে এসবের দাম নেই কোনো। সারা দিন খাটা-খাটনি করে বিকেলে সন্ধ্যায় ভিডিও দেখে এখানকার মানুষের সময় কাটে। এর বাইরে কিছু বুঝতে চায়না। এক এক সময় নিজেকে বড়ো নি:সঙ্গ আর বন্ধুহীন বলে মনে হয় সজলবাবু।’
-‘আপনি কলকাতা বা অন্য কোন শহরে চলে যান না কেন। সেখানে তো অনেক সুবিধা পাবেন।’
বিষণ্ণ ভাবটা কিছুটা কাটিয়ে এবার সূর্যশেখরবাবু বললেন–‘দেখুন কলকাতা গিয়ে বসবাস করার সুযোগ বেশ কয়েকবারই এসেছে। কিন্তু কেন জানি না মনের দিক থেকে সেরকম কোন তাগিদ অনুভব করিনি চলে যাওয়ার। একেবারে যে ইচ্ছে করেনি তা নয় কিন্তু কি যেন অমোঘ আকর্ষণে গ্রামকে ছাড়তে পারিনি। আপনার আমাকে গ্রামকুনো আখ্যা দিতে পারেন।’
-‘না না, তা বলব কেন? গাঁয়ের প্রতি, গাঁয়ের মানুষের প্রতি এ হয়তো আপনার অতিরিক্ত টান বা ভালোবাসা।’ সজলবাবু বললেন।
সূর্যশেখর বাবু বললেন—‘টান না ভালোবাসা তা বলতে পারব না। সবাই দেখি সামান্য একটুখানি সুযোগ পেলেই শহরে চলে যায়। গাঁয়ের হতভাগ্য দীনহীন মানুষগুলি পড়ে থাকে অন্ধকারে-নিচে। এদের কথা আমি ভাবতে চাই। ওরা আমায় না বুঝুক-আমি অন্তত ওদের বুঝতে চাই।’
-‘কিন্তু এত শুধু ক্ষত বিক্ষত হওয়া, নিজের সঙ্গে নিজে অহরহ যুদ্ধ করে রক্ত ঝরিয়ে যাওয়া।’
-হ্যাঁ ঠিক তাই’।
মণিময়বাবু এতক্ষণ চুপ করে থেকে লেখক বন্ধুর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলেন। এবার তিনি বললেন—‘লোকে যে বলে গঙ্গার হাওয়া না পেলে এখনকার এখনকার দিনে বড়ো সাহিত্যিক হওয়া যায় না।’
সূর্যশেখর বাবু তত্ক্ষণাত উত্তর দিলেন—‘কিন্তু এখানেও –এই শীলাবতীর হাওয়ার মধ্যেও তো লেখার কম উপকরণ পড়ে নেই। এগুলোকে তুলে ধরবে কে? কাউকে না কাউকে চাই তো। মনে কর না—তোর এই বন্ধুই সেই কাজ করছে।’
সজলবাবু এতদিন কলকাতায় বসে শুধু সূর্যশেখরবাবুর লেখা পড়েছেন। কতসব বেদনাময় যন্ত্রনাকাতর দু:খী মানুষদের ছবি সেখানে। কত দরদ দিয়ে তাদের এঁকেছেন তিনি। আজ এখানে এসে সূর্যশেখরবাবুর নিজের বুকের গভীরে
লুকিয়ে থাক যন্ত্রনা বেদনাকে চাক্ষুস করলেন সজলবাবু। যা কেউ জানে না। অবাক যেমন হলেন—তেমনি মুগ্ধ হলেন সূর্যশেখরবাবুর অনমনীয় দৃঢ়চেতা এক উদার অন্তর দেখে।
পাঁচ
সূর্যশেখরবাবুর বাড়িতে দু’দিন ছিলেন সজলবাবু। এই দু’দিনে কত গল্প কত কথা। সময়টা কথা দিয়ে কখন পেরিয়ে গেছে তার টেরই পাননি তাঁরা। ওদের আসাতে সূর্যশেখরবাবু খুব খুশি হয়েছেন। বারে বারে তিনি একটা কথা বলেছেন-‘আপনারা এসেছেন, কী ভালোই না লাগছে। মাঝে মধ্যেই সময় করে চলে আসবেন। আপনারা এলেতবু তবু দু’টো মনের কথা খুলে বলা যায়।’
বাস্তবিকই তাই। সজলবাবু বুঝেছেন। সূর্যশেখর বাবু তাঁর জেদী একরোখা মনোভাব নিয়ে গ্রামে পড়ে আছেন ঠিকই–কিন্তু একটা কষ্ট দু:খ তাঁর অন্তরকে তীব্র দহনে পুড়িয়ে মারছে। তাঁকে চেনা জানা বোঝার লোকের বড়ই অভাব এখানে। কিছু লেখালেখি করেন কাগজে, পত্র পত্রিকাতে ছাপা হয়।এ ইটুকুই শুধু এখানকার কিছু কিছু মানুষ জানে। কিন্তু এই সৃষ্টিশীল মানুষটাকে উত্সাহদানের ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ নেই–সাড়া নেই। তাই তাঁর সমঝদার লোক বাইরে থেকে কেউ এলে সূর্যশেখরবাবু খুবই খুশি হন, আনন্দ পান।
আরো কিছুদিন এখানে থাকার ইচ্ছে সজলবাবুর ছিল। কিন্তু কাজের চাপ, অফিসের তাড়া আছে। থাকলে চলবেনা। এই হাইটেক ব্যবস্থার যুগে সময় নষ্টের অবকাশ কোথায়? ফিরতেই হল তাই গন্তব্যস্থলে। ফেরার দিন সকালে মণিময় ও সজলবাবুকে নদী ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছেন সূর্যশেখর নিজে। কথাবার্তার মাঝে সূর্যশেখরবাবু একসময় বললেন—‘মণি, তুই আমার ছেলেবেলার বন্ধু। তোকে তো আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু সজলবাবু, আপনাকে আমার বলা, আপনি নতুন এসেছিলেন। আমরা গ্রামে থাকি। অনেক কিছুতেই আমাদের ত্রুটি হয়তো আপনার চোখে পড়েছে। পারলে ক্ষমা করে দেবেন।’
অত্যাশ্চর্য হওয়ার মতো আরো কিছু মনে হয় এখানেই বাকি ছিল। ঐ বিশাল মাপের মানুষটা বলেন কি? শুধু মাত্র কথার কথা নয়—যেন একরাশ বিনয় আর ঔদার্ঘ ঝরে পড়ল সূর্যশেখরবাবুর কণ্ঠ থেকে। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে সজলবাবুর মাথাটা যেন নিচু হতে চাইছে। লজ্জাবনত কন্ঠে বললেন—‘না না, এ আপনি বলেন কি? ত্রুটি তো আপনার নয়, ত্রুটি আমাদের, আমরা যারা আপনার মত মহত মানুষের দাম দিতে পারি না। শত অসুবিধা, বাধা সয়েও বলা যেতে পারে এক প্রকার যুদ্ধ করেই এই যে আপন সাহিত্য চর্চা করছেন—আপনার এলাকার লোক বোঝে না, খোঁজ খবর নেয় না আপনার ভিতরের ব্যাথা যন্ত্রনার। আমার কলকাতার কতজনই বা বুঝবেন-একটা নতুন সৃষ্টি করতে কত কঠিন লড়াই করতে হয় আপনাকে, কত ঘাম ঝরাতে হয়। আপনি সূর্য। সত্যিই সূর্য। বাঁশবনের ভিতর থেকে উঠে আসা সূর্য। আপনি আমার অন্তরশুদ্ধি ঘটিয়েছেন, ভ্রান্ত ধারনা দূর করেছেন। আপনার উত্তাপের আঁচ প্রাণভরে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আপনাকে আমার অন্তরগাঢ় নমস্কার।’
বলতে বলতে নদীর জলে নামলেন সজলবাবু। ওপারে গিয়েই সূর্যবাবুর দিকে হাত নাড়ালেন। সূর্যশেখরবাবুও হাত নেড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঘরের দিকে মুখ ফেরালেন।
★★★