ছোটগল্প
হলুদ শাড়ি
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
গল্পকার হলেও কবিতার প্রতি তাঁর টান অন্তরের।এপার বাংলা ওপার বাংলা জুড়ে তিনি লিখে চলেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনসহ বানিজ্যিক পত্রিকাতেও।শিক্ষাশ্রী ও রাষ্ট্রপতি সম্মানে ভূষিত এবং তিনি সকলের বড্ড কাছের মানুষ।
হস্টেলে এসে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হচ্ছে সান্ত্বনার অন্যান্যদের সঙ্গে সে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারছে না। শত চেষ্টা স্বত্তেও ক্রমশ সে যেন পিছু হটে যাচ্ছে। অন্যের থেকে হয়ে পড়েছে আলাদা। পৃথক, একাকী। মনের যাবতীয় প্রফুল্লতা যে যেন হারিয়ে ফেলেছে।
এই বয়সটায় একটা যুবতী মনে ছুঁয়ে থাকে কত স্বপ্ন, কত না ঘোরলাগা আবেগময়তা—যা তার চঞ্চলতা এবং উচ্ছ্বলতা নিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু সান্ত্বনার সে সব কিছু নেই। কী একটা অদৃশ্য চাপের কাছে যেন রুদ্ধ হয়ে পড়েছে তার সে হৃদয়ের আবেগ। সে হীনমন্যতায় ভুগছে, একটা আত্মগ্লানি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে-সে যেন হস্টেলে এসে বিরাট একটা অপরাধ করে বসেছে। সবাই ঠিক আছে-কিন্তু সে বড্ড বেমানান।
অথচ সান্ত্বনার বুদ্ধি বা মেধাশক্তি অন্যের থেকে যে কম তা কিন্তু নয়। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। আর বুদ্ধি তো তার আছেই—তা না হলে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক, অনার্স সহ বি. এ. পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগড়ায় পৌঁছালো কি করে? শুধুমাত্র নম্বরের ভিত্তিতেই এম. এ. –তে ভর্তি হওয়া এ তো আর চাট্টিখানি কথা নয়-অন্তত-আজকের এই যুগে। এক কথায় পড়াশোনাতে সে বরাবরই ভালো। এদিকে দেখতে শুনতে যে খারাপ-তাও নয়। যথেষ্ট সুশ্রী; মাঝরি গঠন-রঙ ফর্সা। রোগা সে মোটেই নয়। তা ছেলেদের নজর কাড়বার মতো চেহারা বটে।
এদিকে কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম-টেম করে-প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার দরুণ সে যে মানসিক দুশ্চিন্তায় টলছে তাও নয়। না-এরকম ঘটনা সান্ত্বনার জীবনে এখনো ঘটেনি। তবু কি যেন একটা ভয়ানক চিন্তায় আচ্ছন্ন সে সারাক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন চত্ত্বরে এসে যেখানে স্বচ্ছন্দে হেসে বেড়ানোর কথা; হাসি-গল্পে-গানে শরতের রোদ্দুরের মত আপন মহিমায় নিজেকে মেলে ধরার কথা-কিন্তু সান্ত্বনার তা হচ্ছে না। মেলে ধরা তো দূরের কথা সে যেন শামুকের খোলের ভিতর গুটিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ-চঞ্চলতা নেই; আছে একটা বিরাট অস্থিরতা। অস্থিরতা কি তাও মনের ভিতরে-অপ্রকাশ্য। প্রথম যখন হস্টেলে ভর্তি হোল-তখন কিন্তু এরকম ছিল না। অন্য পাঁচজনের মতই দুর্নিবার আবেগ আর খুশির ঢেউ তুলে এসেছিল এখানে। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে ততই যেন তার খুশির ঢেউয়ে ভাটা পড়েছে। ক্লাস পিরিয়ডে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কিন্তু বেশ আমেজ নিয়েই থাকে। ফুটে উঠতেও দেখা যায় তার স্বত:স্ফুর্ততা। কিন্তু হস্টেলের রুমে পা দেওয়া মাত্রই কেমন যেন মুষড়ে পড়ে, শুরু হয়ে যায় নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পালা।
আসলে সমস্যাটা তার হয়েছে অন্য জায়গায়। একটি অতি সাধারণ পরিবার থেকে আসা মেয়ে সে। যে পরিবারে লেগে আছে নিত্য-অভাব-অনটন; নাই-নাই আর নাই-এর হাজারো সমস্যা। তার বাবা একজন সাধারণ চাষি। কয়েক বিঘা জমি আছে। তাতে করে দশজন মানুষের ঠিকমত খাওয়া-পরাই জুটে না। এর তার কাছে ধার-দেনা করে, চেয়ে-চিন্তে কোনোরকমে তার সংসারটা চলে। এমন একটি পরিবারে পড়াশোনা করা মানে বিলাসিতা। একটা বাড়তি বোঝা। তবু সেই পরিবার থেকেই সান্ত্বনা উঠে এসে পা রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িতে। নিজের গ্রামের মধ্য থেকে উঠে আসা একমাত্র মেয়ে—সে গ্রাজুয়েট হয়ে এম. এ. পড়ছে। সেদিক দিয়ে সান্ত্বনা একটা দৃষ্টান্ত বৈকি।
শুধু সামান্য দৃষ্টান্ত বললেই কম বলা হবে সে-অজ্ঞাতপূর্ণ গ্রাম্য সমাজ মানসিকতায় একটা চমক জাগিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ করে দিয়েছে—মেয়েরা কেবল পিছিয়ে পড়ার পাত্রী নয়। সামান্য-সুযোগ সুবিধা পেলে-বিশেষ করে মা-বাবা কিংবা তার পরিবারে সাহচর্য ও আনুকূল্য পেলে ছেলেদের মতো করেই গড়ে উঠতে পারে।
২
মেয়ে তার লেখা পড়া শিখুক, সত্যিকারের মানুষ হোক-এই মহতী ইচ্ছা তার গরীব বাবার কাছ থেকে বরাবরই পেয়ে এসেছে সান্ত্বনা। পরিবারও তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে বড় হতে। যদিও তার মা একবার বলেছিল-মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে আর কাজ নেই। এবার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক। সান্ত্বনাকে কিছু বলতে হয়নি। তার বাবাই প্রতিবাদ করেছিলেন সে কথার। বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন-‘দেখ, হেঁসেলে হাঁড়ি ঠেলবার জন্য তোমার মেয়ের জন্ম হয়নি। ও মেয়ে একদিন চাকরি করবে দেখে নিও। তাই ওর বিয়ের ব্যপারে পাত্র দেখবার আমার কে?’ সান্ত্বনার মনে পড়ে বাবার এই কথার জবাবে তার মা আর কিছু বলেননি। কেমন যেন চুপ করে গিয়েছিলেন। তার উজ্জ্বল আভাই যেন বলে দিচ্ছিল-তিনিও এই চান। মেয়ে তার চাকরি করুক। তিনি তো সারা জীবন হাঁড়ি ঠেলে এলেন-এতটুকু সুখ তিনি কবে পেয়েছেন?
বাবার প্রতিবাদ দৃপ্ত কথা, মাযের মুখে তৃপ্তির হাসি-এই দেখে সান্ত্বনার বুকটাও আনন্দে নেচে উঠেছিল সেদিন। তার আরও জেদ বেড়ে গিয়েছিল পড়া ভালোভাবে শেষ করে বাবা-মায়ের আশা সে পূর্ণ করবে, নিজেও প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই সান্ত্বনার হঠাত্ই হল কি-হস্টেলে এসে ঠিক শান্তি পেল না। মনটা সব সময় কেমন যেন মনমরা। ঝরে যাওয়ার আগে পাতা যেরকম ধূসর-হলুদ বর্ণ ধারণ করে ঠিক সেরকমই হয়েছে মনের অবস্থা।
সান্ত্বনার রুমমেট নমিতা এবং নীলিমা। দু’জনে বড়ো ঘরের মেয়ে। তথাকথিত ফ্যাসান আর আভিজাত্য নিয়ে মানুষ হয়েছে। নমিতার বাবা বিরাট ইঞ্জিনিয়ার। কি একটা অফিসে চিফ একজিকিউটিভ অফিসার। বড় দাদাও বাবারই পথ বেছে নিয়েছে। সেও ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশ-লন্ডনে না কোথায় থাকে। মাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়ে। বনেদী ঘরে বিয়ে হয়েছে বলে চাকরি-বাকরি করে নি। আর দাদু নাকি ছিলেন তত্কালীন যুগের বিখ্যাত লোক। দাদুর এক ভাই স্বদেশী করতে গিয়ে কোথায় যেন প্রাণ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে নমিতা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বড় আদরে মানুষ হয়েছে। অভাব কি-সেটা বুঝতে পারেনি। তবে কি-বই পড়ে হোক, কিংবা আর পাঁচজন বন্ধুদের সাথে মিশেই হোক দেশে যে অগণিত গরিব মানুষ আছে, দু’মুঠো অন্নের জন্য হাহাকার করে মরছে-সেটা সে বোঝে। তেমন করে কাউকে সাহায্য করতে না পারলেও গরিব মানুষগুলোর প্রতি বরাবরই একটা সহানভূতি তার আছে।
অপরদিকে নীলিমার বাবাও বড়লোক। কিসের যেন একটা ব্যবসা করে। প্রচুর টাকা-পয়সা করেছে। করেছে বাড়ি-গাড়ি। মানুষের যে উঠতি সময় বলে একটা কথা আছে-সেটাই এখন চলছে নীলিমাদের। সাধারণভাবে বড়োলোকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত ইত্যাদির দিক দিয়ে নীলিমারা নমিতাদেরই প্রায় সমতুল্য। পার্থক্য বলতে নমিতারা শহরে থাকে আর নীলিমারা থাকে গ্রামে। নমিতার বাবা প্রাচীনকালের বড়লোক, আর নীলিমার বাবা হাল-আমলের। নীলিমার যেন গরবে ভুঁয়ে পা পড়ে না। রাস্তায় যখন হাঁটে হাত-পা দুলিয়ে হাঁটে। তার বাবার যে পয়সা আছে সেটা সে প্রতি পদক্ষেপে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চায়। অথচ দেখতে যে খুব সুন্দরী তা কিন্তু নয়। গায়ের রঙ চাপা ময়লা। কিন্তু বিভিন্ন রকমের স্নো-পাউডার, ক্রিম মেখে হরেক রকমের সাজ পোশাক পরে নিজেকে সুন্দরী বানানোর চেষ্টা করে। নমিতার একটা ঈশ্বরের দেওয়া স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও রূপ আছেই। তার ফলে সামান্য সাজগোজেই তাকে অপূর্ব সুন্দরী লাগে। নীলিমা এটা বুঝে নিয়েছে যে নমিতাকে সে রূপের বাহারে টেক্কা দিতে কোনমতেই পারবে না। তাই অন্তর্দাহের আগুনে সে পুড়ে মাঝে মাঝে। ভাবে-আহা নমিতার রূপটা যদি ভগবান তার দিত কী ভালোই না হত। কিন্তু তাতো হবার নয়। নমিতার কাছে নীলিমার তাই বরাবরই হার। পরাজয় স্বীকার করেও নিয়েছে সে মনে মনে। নমিতার সঙ্গে যে কোনদিনই পেরে উঠবে না-এটা সে ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে। তাই নমিতার সঙ্গে রূপচর্চা নিয়ে প্রতিযোগিতা করার আর সাহস দেখায় না। নমিতার কাছে প্রতিযোগী হিসেবে সে সান্ত্বনাকেই বেছে নিয়েছে। সান্ত্বনার রূপকে ছাপিয়ে সে কিভাবে উঠে যেতে পারে এই তার প্রতিনিয়ত চেষ্টা। বাজারে এ হেন ক্রিম নেই যেটা সে ব্যবহার করে না। দেহকে কিভাবে সুন্দর রাখা যায়, কোন জিনিসটা ব্যবহার করলে মুখের সৌন্দর্য বাড়ে, মসৃণ তকতকে হয়-তা সে যত দামই হোক-কেনে ব্যবহার করে।নতুন আবার কোন জিনিস আবিষ্কার হোল, বাজার মাত করল তা জানতে সে কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতা উল্টায়; সাপ্তাহিক-মাসিক-পত্র-পত্রিকা পড়ে। কিছুদিন আগে তাদের মেয়েরাই কোথায় যেন আলোচনা করছিল-বলাবলি করছিল-সান্ত্বনা নাকি নীলিমার চেয়েও দেখতে ভালো। যদি একটু যত্ন নিত-সৌন্দর্য আরও বাড়তো। নীলিমা এখথা আড়ালে কান পেতে শুনেছিল। আর একথা শোনার পরই রূপচর্চার মাত্রাটা তার আরও বেড়েছে। তার একান্ত জেদ-সান্ত্বনার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী এটা সে সবার সামনে প্রমাণ করে দেবে।
রূপচর্চার এই লড়াইয়ে সান্ত্বনা পা দেয় না। দেওয়ার কথাও নয়। কারণ নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোই ওয়াকিবহাল সে। সে জানে তার সীমা কতটুকু। ইউনিভার্সিটিতে থাকার মতো পোশাকই জোটে না। যেটুটু থাকলে নয়-
৩
সেটুকু আছে তার। দু’টো মাত্র শাড়ি। সেটাই কিভাবে জুটছে তাতো সে নিজেই জানে। একটা তার বাবা কিনে দিয়েছেন-অন্যটা বৌদির নিয়ে এসেছে। দেহের লজ্জা ঢাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে-তার উপরে আবার রূপের চর্চা। না-রূপের চর্চা করার মতো তত পয়সা তার বাবার কাছে নেই।
একদিন হয়েছে কি। কি একটা উত্সব উপলক্ষে সেদিন ছুটির দিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ। তিন বন্ধুই গল্পে মেতেছে। রুম বন্ধ। হাসি-ঠাট্টা আর তামাশার ফোয়ারা ছুটিছে যেন রুমের মধ্যে। নীলিমা তার বেডে আধশোয়া অবস্থায়। কথা বলছে-আর একটি ছোট্ট আয়না মুখের কাছে টেনে এনে নিজেকে দেখছে। কপালের সামনে ঝুলে পড়া দু’একটা চুল ঘাড়ের দিকে সরিয়ে ঠিক করে দিচ্ছে। নমিতা সান্ত্বনার বেডে। বালিশটাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে তক্তপোশের নিচে মুড়ির টিনে হাত ঢোকাচ্ছে। মুঠো মুঠো বের করে মুখে পুরছে-আবার নিচে হাত বাড়াচ্ছে। খেতে খেতে তারিফ করছে-সান্ত্বনার বাড়ির মুড়িটা কি মিষ্টি। রুমে এই একজনেরই মুড়ি আসে-সেটা সান্ত্বনাই আনে। যখনই বাড়ি যায় তখনই আনে। খায় কিন্তু তিনজনেই। বেশি খাই নমিতাই। রুমে থাকলেই সোজা মুড়ির টিনে হাত। সান্ত্বনা এর জন্য কিছু বলে না। কিছু মনেও করে না। বন্ধুরা একটু-আধটু দৌরাত্ম্য চালাবে না তো কারা চালাবে? নমিতার এ হেন ব্যবহার তার বরং ভালোই লাগে। নমিতার যে গুণটা সান্ত্বনাকে আরও মুগ্ধ করেছে তা হল তার খোলা-মেলা, সহজ-সরল ব্যবহার। মার-প্যাঁচ বলতে তার কিছু নেই।
অত্যধিক চঞ্চলতা আর ছটপটানিতে নমিতার বুকের কাপড় নেমে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। গল্প করা ও মুড়ি খাওয়ায় মত্ত। সান্ত্বনা ঠিক কাছে বসে ছুঁচের টোপ দিচ্ছে। ব্লাউজের একটুখানি জায়গা সেলাই খসে গেছে সেটা সেলাই করছে। কাজে মনযোগী বলে সে কথা কম বলছে।
নমিতার ছোটবেলা থেকে একটা অভ্যাস কার গায়ে গা দিয়ে বসা। কেউ কাছে বসে আছে দেখলেই সেও একেবারে তার গা ঘেঁষে বসবে। শুধু কি গা ঘেঁষে বসা! স্থির কিছুতেই থাকবে না সে। হাত দিয়ে তার দেহের উত্তাপ নেবে। পিঠে-ঘাড়ে আলতোভাবে চাপড় মারবে। টিপে টিপে মাংসপেশীর পরিমাণ অনুভব করবে। না-অনেক চেষ্টা করেও নমিয়া এই অভ্যাস শুধরাতে পারে নি। কারো শরীরের উপর অত্যাচার চালাতে নমিতা এই হস্টেলে সান্ত্বনাকেই বেছে নিয়েছে। সান্ত্বনাও তাকে এতে বাধা দেয় নি।
শুয়ে মুড়ি খাচ্ছিল নমিতা। হঠাত্ অভ্যাস মত সান্ত্বনার একেবারে গা ঘেঁষে এল। আজ একটু বাড়াবাড়ি করল। মাথাটা তুলে দিল সান্ত্বনার কোলে। তার শরীরের একটা ঘ্রাণ নেবে বলে মুখ গুজল। কিন্তু তক্ষুনি তড়িত্গতিতে মুখটা সরিয়ে নিল। বলল-‘সান্ত্বনা, শাড়িটা চেঞ্জ কর, বড্ড গন্ধ করছে। সাবান দিয়ে এক্ষুনি পরিষ্কার কর। এত গন্ধ করা শাড়িটা পরে আছিস কি করে?’
নমিতা মিথ্যে বলেনি। সত্যি যে শাড়িখানা সান্ত্বনা পরেছে সেটা থেকে বিদঘুটে একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। এ দুর্গন্ধ সান্ত্বনার নাকেও গেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে পরছে শাড়িটা। ঘাম ভিজে, ধুলো লেগে তাই এত দুর্গন্ধ। তাতে গত দু’দিন আবার রোদ বের হয়নি। তাই গন্ধ আরও বেড়েছে।
সান্ত্বনা বলল, ‘হ্যাঁ, এক্ষুনি শাড়িটা কাচব। আজ কয়েকদিন একটানা পরলাম তো।’ একটুক্ষণ থেমে আবার বলল-‘অন্য শাড়িখানার অবস্থাও তো দেখছিস, কাদার ছোপ লেগে একাকার। ওটাও না কাচলে নয়। পরশুদিন তো ওটাই পরে এলাম বাড়ি থেকে। রাস্তা একেবারে কাদায় কাদাময়। সেই মেঠো রাস্তা ধরে ভোরবেলা আসতে হয়েছে বাস ধরার উদ্দেশ্যে। ওটাও নোংরা। দুটোই কাচব আজ। কিন্তু কি যে করি-’
সান্ত্বনার শেষ কথাটা কেমন যেন একটুখানি জোরালো ভাবে প্রবেশ করল নমিতার কানে। ধড়পড় করে উঠে বসল সে। কোনো কিছু না ভেবে একেবারে সান্ত্বনার বিছানা ছেড়ে তার নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। তারপরে নীচু হয়ে তার নিজের ট্রাঙ্কের মুখটা খুলে একটা হলুদ রঙের ভাঁজ করা শাড়ি বের করল। শাড়িটা নতুনই, একবার মাত্র পরেছে সে। সেবার পরে হস্টেলে এসেছিল। আর পরে নি। দিব্যি পরিষ্কার-চকচকে আছে। সেটা সান্ত্বনার দিকে ঠেলে দিয়ে নমিতা বলল-‘নে, আমার এই শাড়িটা পরে তোর শাড়ি দুটো কেচে আন। অমন গন্ধ করা শাড়ি আবার পরে মানুষে।’
নীলিমা আড় চোখে একবার দেখল। কিন্তু কোনরূপ মন্তব্য করলো না। আয়নায় মুখ দেখতে লাগল খুশির টানে।
সান্ত্বনা বলল, ‘একি! আমার জন্য তুই নতুন শাড়িটা বের করলি? না, ওটা আমি ভাঙব না।’
ধমকে উঠল নমিতা। -‘একদম না বলবি না। পরতে বলছি পর।’ বলেই শাড়ির ভাঁজটা খুলে সান্ত্বনার গায়ে একেবারে জড়িয়ে দিল। আর তার দেহের ময়লা শাড়িটা টেনে খুলে ফেলল প্রায়।
অগত্যা সান্ত্বনা উঠে দাঁড়িয়ে নমিতার দেওয়া হলুদ শাড়িটা পরল। একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
৪
এতক্ষণ পিছন ফিরে ছিল সান্ত্বনা। নমিতার দিকে ঘুরে তাকাতেই নমিতা সোত্সাহে চিত্কার করে উঠল। ‘উ:! সান্ত্বনা, কি দারুণ মানিয়েছে তোকে। অপূর্ব! ফ্যানটাসটিক।’
-‘আ-কি যে বলিস। তোর থেকে কী আবার আমাকে মনাবে?’ মুখ টিপে হাসতে হাসতে উত্তর দিল সান্ত্বনা।
-‘সত্যি বলছি সান্ত্বনা। দারুণ মানিয়েছে তোকে।’ পুনরুক্তি করলো ভালোলাগা উচ্ছ্বাসে।
কিন্তু নমিতার এই সহজ-সরল কথাটা পাশেই শুয়ে থাকা নীলিমার কাছে যেন শেলের মতো বিঁধল। চোখ ঠারিয়ে একবার দেখে নিল সান্ত্বনাকে। একবার পরখ করে নিল তার রূপের চেয়ে সান্ত্বনার রূপ ছাপিয়ে গেল নাকি। বাস্তবিকই সান্ত্বনাকে খুবই সুন্দর লাগছিল। তাই নীলিমা বেশিক্ষণ সান্ত্ব্বনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। পাছে সান্ত্বনার সৌন্দর্যের কাছে তার সৌন্দর্য খাটো হয়ে যায় – এই ভয়ে মুখটা সরিয়ে নিল দ্রুত।
নমিতার কিন্তু কথা থামে না। তাকিয়েই আছে সে একদৃষ্টে সান্ত্বনার দিকে। সান্ত্বনার কি জানি কেমন একটা লজ্জাবোধ হল। মুখটা নিচু করল সে। নমিতা বলে উঠল – ‘দেখ সান্ত্বনা, তোকে এই বেশে দেখলে যে কোন ছেলেরই মাথা ঘুরে যাবে। আমি যদি ছেলে হতাম, তাহলে এই মুহূর্তে তোকে বিয়ে করব বলে অফার দিয়ে বসতাম।’
-‘সবটাতেই তোর ফাজলামো। মুখে তোর কিছু আটকায় না।’ লজ্জাসুলভ একটা আভা ফুটে উঠল সান্ত্বনার মুখে।
-‘ফাজলামো কী রে? আয় আমার কাছে আয় বলছি’ – বলেই দু’হাত বাড়িয়ে নমিতা সান্ত্বনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর বিছানায় ফেলে দিয়ে সান্ত্বনার মুখে ও বুকে গভীরভাবে চুমু খেল দুষ্টুমি করে।
সান্ত্বনা নমিতার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। এক টুকরো হাসি খেলে গেল তার মুখে। মেয়ে মানুষের রূপের প্রতি এত যখন লোভ, তোর কিন্তু মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়েই জন্মানো উচিত ছিল নমিতা।’ বলেই হাসতে হাসতে ময়লা শাড়ি দুটো আর সাবানটা নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল সান্ত্বনা। যদি তার সন্দেহভরা একটা চোখ থাকত তাহলে সে অবশ্যই বুঝতে পারত, কিংবা ধরতে পারত-রুমের তৃতীয় জন অর্থাত্ নীলিমা তাদের এই রঙ্গ-ভঙ্গি দেখে হিংসায় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে।
এরপর দিন পনেরো কেটে গেছে। কি একটা ছুটিতে নমিতা এবং নীলিমা বাড়ি গিয়েছিল। কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে বলে সান্ত্বনা এবার যায়নি বাড়ি। রুমে একাই ছিল। ইউনিভার্সিসিটি খোলার দিন নমিতা এবং নীলিমা ফিরল হস্টেলে। নীলিমা কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। সবে মাত্র রুমে এসে বসেছে। সান্ত্বনা ক্লাস করে ঢুকল। নমিতার দেওয়া দেই হলুদরঙা শাড়িটা তার পরনে। দেখেই নীলিমার গা’টা জ্বলে গেল। ঐ হলুদরঙা শাড়িতে সান্ত্বনার দৃষ্টিকাড়া রূপটা কিছুতেই নীলিমার সহ্য হল না। না, মুখে কিছু বলতে পারে না তবু চুপ করে রইল নিজেকে সামলে। বাড়ির কে কেমন আছে খোঁজ-খবর নিয়ে সান্ত্বনা শাড়িটা ছেড়ে বাথরুমে গেল। ঠিক এমনি সময়ে ফিরল নমিতা।
সুযোগটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করল নীলিমা। নমিতা ঢুকতেই গলাটা নামিয়ে ফিসফিস করে সে বলল –‘নমিতা শোন, একটা কথা বলবো। কাছে আয়।’
নমিতা নীলিমার কাছে মুখ রাখল। ‘কী বল?’
নীলিমা বলল আগের মতোই নিচু স্বরে – ‘সেই যে তুই বলেছিলি না-তোর ঐ হলুদ রঙা শাড়িটাতে সান্ত্বনাকে দারুণ মানিযেছে। সেই কারণে সান্ত্বনার ঐ শাড়িটার প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গেছে। জানিস আমরা তো কেউ নেই। তোর সেই শাড়িটা পরেই আজ সান্ত্বনা ক্লাস করে এল। এইমাত্র ছেড়ে বাথরুমে গেছে।’
-‘এ তো ভালো কথা।’ নিস্পৃহভাবে জবাব দিল নমিতা।
-‘ভালো কথা! তোর শাড়ি – তোকে পর্যন্ত জিজ্ঞেস না করে’-
-‘তাতে কী হয়েছে? শাড়িটা তো ওকে পরার জন্যই আমি দিয়েছি।’ এমন সহজভাবে উত্তর দিল যে কোন রকম ভাবান্তর ফুটে উঠল না নমিতার চোখে। বরং কিছুটা খুশি হয়েছে এটাই বোঝা গেল।
নীলিমা কিন্তু এমনটা আশা করে নি। সে ভেবেছিল শাড়ির কথাটা লাগালে নমিতা সান্ত্বনার প্রতি রুষ্ট হবে। এমন কিছু কথা বলবে – যাতে করে ঐ শাড়িটা পড়ার সাহস সান্ত্বনার আর যেন কোনদিন না হয়। তাহলেই সে মনের দিক থেকে কিছুটা শান্তি পাবে। সান্ত্বনার রূপ তার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু তা আর হল না। নমিতাটা এমন ভাব করল তাতে তারই দোষটা ধরা পড়ে গেল। শাড়ির কথাটা তুলে নীলিমা নিজেই অন্যায় করে ফেলেছে। একটা অপরাধবোধ তাকে এসে গ্রাস করল। হিংসার পোকাটা তার মাথার ভিতরে কামড়াতে শুরু করল। মুখে আর তখনকার মতো কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইল। করতে লাগল আর একটা সুযোগের অপেক্ষা। সান্ত্বনাকে যে কোনো প্রকারে অপদস্থ করতেই হবে। নইলে শান্তি নেই তার। সান্ত্বনার রূপের দেমাক সে ভেঙে দেবেই – এই তার দুর্যোধনী জেদ।
৫
মানুষের যখন দুর্মতি আসে তখন তার আর সাধারণ বোধ থাকে না। বিচার, জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক - সব হারিয়ে ফেলে। অল্পেতেই ধৈর্য হারায়। কারণে-অকারণে রেগে ওঠে। প্রয়োজনে পায়ে পা লাগিয়েও ঝগড়া করে। এরকমই একটা অবস্থার স্তরে পৌঁছে গেল নীলিমা। হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে বিবেকটুকুও হারিয়ে ফেলল সে। এমন কিছু মারাত্মক কারণ ছিল না। তাতেই নীলিমা তার ধৈর্যের সমস্ত বন্ধ ভেঙে দিয়ে ভিতরের কদর্য রূপটাকে প্রকাশ করে ফেলল সান্ত্বনার কাছে। সান্ত্বনা তো দেখলই-দেখল নমিতাও। সেদিন সন্ধ্যার ঠিক কিছু আগে নীলিমা হঠাত্ সরাসরি আক্রমণ করে বসল সান্ত্বনাকে। সান্ত্বনা নমিতার দেওয়া সেই হলুদরঙা শাড়িটা পরে বিকেলে একটু বেরিয়েছিল। সেই অপরাধেই নীলিমার এই আক্রমণ। ঘটনাটা হয়েছে এইরকম – তিনজনেরই বেরুবার কথা ছিল। কিন্তু বের হওয়ার সময় সান্ত্বনা সেই হলুদ রঙা শাড়িটা পরেছে দেখে নীলিমা আর বের হয়নি। রুমে থেকে গিয়েছিল বই পড়ার কারণ দেখিয়ে। আসলে বইয়ে কিন্তু মন ছিল না তার। নমিতা এবং সান্ত্বনা বেরিয়ে যেতেই জানালার ধারে চুপটি করে বসে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। বিশেষ করে লক্ষ্য ছিল সান্ত্বনার প্রতি। ইদানিং হলুদ শাড়িটা পরার পর থেকে সান্ত্বনার রূপ ও সৌন্দর্য নিয়ে একটা কথা উঠেছে। সেটা নীলিমার কানে এসেছে। তাই সবটুকু রাগ ও ঈর্ষা ঐ সান্ত্বনার উপর।
নীলিমা প্রায় প্রস্তুত হয়েই বসেছিল। সান্ত্বনা রুমে পা দেওয়া মাত্র সে রাগে ফেটে পড়ল। চিত্কার করে বলে উঠল – ‘জয়দীপের কাছে তুই কেন গিয়েছিলি? উত্তর দে বলছি।’
কথার কোনো শুরু নেই। আচমকা এরকম একটা প্রশ্নে প্রায় থতমত খেয়ে গেল সান্ত্বনা। বিশেষ করে নীলিমার দু’চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা রোষানল দেখে ভয়ও পেল কিছুটা। তবু শান্ত-সংযতভাবেই উত্তর দিল সান্ত্বনা – ‘রাস্তায় দেখতে পেয়ে জয়দীপ ডাকল। তাই গিয়েছিলাম। একটা নোট নিয়ে আলোচনা হল।’
-‘জয়দীপ তোকে ডেকেছিল? না-তুই গিয়েছিলি তোর রূপের দেমাক দেখাতে?’ কালনাগিনীর মতো ফুঁসে উঠল নীলিমা।
-‘ এ তুই কী বলছিস নীলিমা?’
-‘চুপ! একটাও কথা বলবি না। ভেবেছিস কী তুই? ভেবেছিস-তোর ঐ রূপের মোহজাল দিয়ে আমার জীবন থেকে আমার জয়দীপকে কেড়ে নিবি? পারবি না তুই বলে রাখছি। জয়দীপকে ভালোবাসবার মতো কী ক্ষমতা-যোগ্যতা আছে তোর? জানিস ও কত বড়লোক বাড়ির ছেলে? ওর নোখের যোগ্যও তুই নোস। অথচ কোন সাহসে যাস আমার সেই ভালোবাসার পাত্রে বিষ ঢালতে?’
-‘ছি: ছি: নীলিমা! এত নিচ, জঘন্য-হীন প্রবৃত্তি তোর? ঐ কদর্যময়-ঘৃণ্য কথাগুলো উচ্চারণ করতে জিভে আটকালো না?’ লজ্জায়-ঘৃণায় কানে হাত চাপা দিল সান্ত্বনা।
কথাটা আগুনের মুখে যেন বারুদ ঢেলে দিল। আরো ভয়ঙ্করভাবে জ্বলে উঠল নীলিমা। সাপের হিস হিস শব্দ তুলে বলে উঠল – নিচ কে দেখ, আমি না তুই? আমি তো আর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি না-অপরে কখন একটা শাড়ি দেবে তবে পরবো আর পাঁচজনকে দেখিয়ে বেড়াব। অপরের জিনিস নেবার জন্য যে এরকম হ্যাংলামো করে বেড়ায় তার মুখে নিচ-অনিচের বিচার করাটা শোভা পায় না বুঝলি?’
-‘নীলিমা!’ এইটুকু বলেই থেমে গেল সান্ত্বনা। সান্ত্বনার কোনকালেই ঝগড়া করার অভ্যাস নেই। আর সে পছন্দও করে না এটা। স্বাভাবিকভাবেই নীলিমার তোপের মুখে পড়ে থমকে গেল সে। মুখ দিয়ে কথা বের হল না। শুধু চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল তার।
এমন সময় রুমে ঢুকল নমিতা কথা বলতে বলতে। -‘এই তোরা কী পেয়েছিস বলতো? এটা ইউনিভার্সিটির হস্টেল না অন্য কিছু? রুমটাকে একেবারে দুলে-বাগদিপাড়া বানিয়ে ফেললি? মনেই হচ্ছে না-তোরা ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ে। পাশের মেয়েরা কী ভাববে বলতো?
নমিতা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রুমের পরিবেশটা কিছুটা শান্ত হয়ে গেল। দু’দিকের তরফ থেকেই আর কথা বের হল না। বোধহয় দু’জনেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। কিছুক্ষণ পরে কান্নাভেজা গলায় সান্ত্বনা বলে উঠল, - ‘নমিতা, তুই তো আমার সাথে ছিলি। নোটের বিষয় ছাড়া জয়দীপের সঙ্গে আর কিছু কথা হয়েছে?’
-‘চুপ, একদম কথা বলবি না। শান্ত হয়ে বসে থাক। আমি সব শুনেছি।’ সান্ত্বনাকে প্রায় ধমকে থামিয়ে দিল নমিতা। পরক্ষণেই বলল, -‘ শোন, আমি একটু বেরুচ্ছি। আবার যেন ঝগড়া লেগে না যাস।’ সান্ত্বনাকে উদ্দেশ্য করে বলল –‘আর হ্যাঁ, তুই যেন আবার রাগ করে ঐ শাড়িটা খুলে না ফেলিস। ঐ শাড়িটা পরেই আজ তুই থাকবি। ঘণ্টাখানেক আমার দেরি হবে ফিরতে। চিন্তা করিস না।’ – বলেই নমিতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল তা সান্ত্বনা এবং নীলিমা কেউ-ই জিজ্ঞেস করল না।
৬
ব্যাপারটা জানা গেল পরের দিন সকালে। মুখ-হাত ধুয়ে বাথরুম সেরে নমিতা সান্ত্বনাকে বলল – ‘তোর এ রুমের যা কিছু আছে চটপট ব্যাগে গুছিয়ে নে।’
-‘কেন? গুছিয়ে কী হবে?’ অবাক চোখে প্রশ্ন করল সান্ত্বনা।
-‘সব বলবো। আগে যা বলছি কর। ভয় নেই, নমিতা তোকে খারাপ জায়গায় কোথাও নিয়ে যাবে না।’
নীলিমা পাশেই বসেছিল। কিন্তু মন-মরা অবস্থায়। বোধ হয় আগের রাতের ঘটনাটা তাকে পীড়া দিচ্ছিল। নরম-মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করল – ‘সান্ত্বনাকে তুই কোথায় নিয়ে যাবি’?
কিছুটা গম্ভীর স্বরে নমিতা জবাব দিল –‘নিবেদিতা হস্টেলে, মায়াদি’র রুমে।’
-‘মায়াদি’র রুমে!’
-‘হ্যাঁ, আজ থেকে সান্ত্বনা ওখানেই থাকবে। সুপারিণ্টেন্ডেন্ট-এর সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা পাকা করে এসেছি।’
-‘কিন্তু মায়াদি’র রুমে তো-’
-‘হ্যাঁ, মাধবী থাকে। ওকে এখানে আনবো।’
-‘এর কী সত্যিই দরকার ছিল নমিতা?’ গলার স্বর বেশ নেমে এসেছে নীলিমার।
নমিতা একটু বেশ ভারিক্কী চালে হাসল। বলল – ‘দরকার আছে কি নেই, আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? তোর মনকে জিজ্ঞেস কর। আমি অবাক হয়ে গেছি নীলিমা এমন হীন প্রতিযোগিতা করার নেশা মানুষের আসে কি করে? তাও করলি-করলি, সান্ত্বনার মতো একটা গরিবের মেয়েকে বেছে নিলি? মাধবীকে আনছি। যত পারিস ওর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিস। তোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ওর অন্তত আছে। ওর বাবা তোর বাবাকে কম করে হলেও দশবার কিনে নিতে পারবে।’ বলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে সান্ত্বনাকে বললো – ‘কিরে, তোর হল? ঠিকমতো সব ব্যাগে ভরেছিস তো? চল।’
নমিতা সান্ত্বনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। নীলিমা বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। পা দু’টো কেমন যেন অসম্ভব ভারী হয়ে উঠেছে তার। সারা দেহে কেমন একটা দুর্বল-নিস্তেজ ভাব। বহু কষ্টে পা ফেলে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সান্ত্বনা নমিতার পিছু পিছু নিবেদিতা হস্টেলে মায়াদি’র রুমে গিয়ে ঢুকল। কি একটা অসীম যাতনায় মুখটা ফিরিয়ে নিল নীলিমা। পিছনেই দেওয়ালে আটকানো বড়ো আয়নাটায় চোখ পড়ল। চমকে উঠল। আয়নার ভিতর একটা কালো মুখ। অসম্ভব রকমের কালো। লাজ-লজ্জার সমস্ত মাথা খেয়ে বেরিয়ে পড়েছে দু’টো হিংসাতুর চোখ। সারা মুখমণ্ডল জুড়ে যেন চরে বেড়াচ্ছে কতকগুলো পাশবিকতার পোকা। নিজেই নিজের মুখের ছায়া দেখে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে শিউরে উঠল নীলিমা। ভয়ে চোখ বন্ধ করল।
★★★