ও
লিটল ম্যাগাজিনের অন্তর বাহির
******************************************
গৌতম মাহাতো
কবি, সম্পাদক – পুর্নবৃত্ত
———————————–
লিটল ম্যাগাজিন মানে শুধু পত্রিকা প্রকাশ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশেষ দর্শন। আত্মজিজ্ঞাসায় সে নিরপেক্ষ হতে চায়। সেখান থেকেই জন্ম নেয় হাজারো বিতর্ক।
যেমন নিরপেক্ষ বলে সত্যিই কি কিছু হয়? নাকি সে শুধুই সোনার পাথর বাটি! না এই প্রশ্ন কোনও ভূতপূর্বশ্রুত অভিভাষণের উদ্গার নয়,বরং উপলব্ধির ব্যুৎকারই বলা শ্রেয়।
‘লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির’- এ লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব ও সমস্যার সূত্র ধরেই এসেছে ধর্ম, রাষ্ট্র, ভাষা,স্বাধীনতা, ইত্যাদি প্রসঙ্গ। লিটল ম্যাগাজিন আসলে মুক্ত, স্বাধীন।স্বাধীন মানে স্বাধীনই।স্বদেশ থেকেও স্বাধীন।সমস্ত মত পন্থা চর্যার থেকেও স্বাধীন। এই সমস্ত বিতর্ক উসকে সম্প্রতি কলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলার আঙিনায় আত্মপ্রকাশ করল ঋত্বিক ত্রিপাঠীর ‘লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির’।
আমরা যারা নিজেদের অতি সামান্য লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী ভাবতে ভেতরে ভেতরে শ্লাঘা অনুভব করি তারা প্রত্যেকেই এই কাজটির প্রয়োজনীয়তা এক কথায় স্বীকার করব তাতে কোনও দ্বিমত নেই। তার কারণ কোনও উন্মাদনাই নির্দিষ্ট দর্শনের ব্যতিরেকে আসে না। হয়তো তা নথিভুক্ত অথবা নয়। কিন্তু নথিভুক্ত নেই মানে যে তার কোনও দর্শন নেই তা তো নয়,বরং তার দর্শন আর গভীরে। ব্যাপক।শেকড়ে জড়িয়ে তার হাড় মজ্জা। তবে এটাও ঠিক নিয়ম/সংজ্ঞায় দর্শন অনেক সীমায়িত হয়। যারা দীর্ঘ সময় এই কাজের সাথে বা দর্শনের সাথে বসবাস করেছেন বা করছেন তাঁরা প্রত্যেকেই হয়তো এই মতামতের সাথে সহমত হবেন কিন্তু আমার বক্তব্য তাদের জন্য নয় বরং আমার অভিপ্রায় তাদের জন্য যারা এই দর্শনে নতুন দীক্ষিত হতে চাইছেন বা হচ্ছেন। তাদের কাছে হাত মকসো করার জন্য কিছু তো একটা থাকা দরকার। এই বই সেই খোরাক জোগাবে।
এই লেখাটি যখন প্রায় প্রথম অবস্থায় সেই সময় থেকেই আমি এর সাথে পরিচিত। প্রুফ দেখা বা ভাবনার নতুন সংযোজন বিয়োজন নিয়েও অনেক কথার আদান প্রদান হয়েছে।বিতর্কও। তবে অবশ্যম্ভাবী ভাবে লেখক তা চেয়েছিল বলেই হয়েছে। কারণ আমার মতো ঋত্বিক ত্রিপাঠীও বিশ্বাস করে গঠনমূলক আলাপ ও বিতর্কের মাধ্যমেই সঠিক দিশায় পৌঁছানো সম্ভব।আর সেই দিশা এই লেখা যে পেয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।যখন এক দৈনিক পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এই লেখাটি ছেপে চলেছে সেই সময় থেকেই লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের সাড়া ও তাদের উচ্ছ্বাস লেখককে অক্সিজেন প্রদান করেছে এইটুকু অনুধাবন করেছি বৈকি।তাই লেখকও অনেক সাবধানী হয়েছেন। হোঁচট খেয়েছেন, উঠেছেন, এগিয়েওছেন। আর তারই প্রমাণ তাঁর এই বই।আর ধন্যবাদ ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’কেও। তারা যে অতুলনীয় সাহস দেখিয়েছেন এই ক্ষেত্রে তা বলাই বাহুল্য। তবে বাংলা সাহিত্য তাদের এই কাজকে দীর্ঘদিন মনে রাখবে এটুকু আশা করাই যায়।
তবে এই কাজটিতে আমিও যে ষোলআনা সহমত এমনটাও সঠিক নয়। বেশ কয়েকটি স্থানে দ্বিমতও আছে। তারচেয়েও বলা ভালো সংশয় আছে। লিটল ম্যাগাজিনের কৌলিন্য নিয়ে আজ আর কারুর কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই তাই এর মধ্য দিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে বাঁধা হয়ে যাচ্ছে না তো ? বা তার পরিসর কমিয়ে আনা হবে কি না এ নিয়ে আশঙ্কা দানা বাঁধছে।
পথ যেমন মন্দ বা ভালোর ফারাক করে না,সকলেই ব্যবহার করে যার যার মতন করে,লিটল ম্যাগাজিনেরও তেমনই দর্শন। একটা সময় ছিল যখন বানিজ্যিক পত্রিকার থেকে নিজেকে স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল লিটল ম্যাগাজিন আজ কিন্তু সেই বিষয়টা অনেকটাই লঘু হয়ে উঠেছে বর্তমান বিকেন্দ্রীকরণের অাঙিনায়। তাই এর প্রয়োজনীতাও অনস্বীকার্য। এই বাতাবরণে বানিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকাগুলিও অস্তিত্ব-সংকটের একটা পরিবেশ হয়তো বেশ ঠাহর করছে,হয়তো কাটিয়েও উঠবে। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের এই সংকট আজকের নয়, বলা যায় চিরন্তন। তাই তার এই নিয়ে ভাবনাও নেই। যারা এই নিয়ে ভাবিত, হয় তারা লিটল ম্যাগাজিন কর্মীই নন অথবা তারা তার দর্শন আত্তীকরণ করে উঠতে পারেননি।
তবে লেখকের কাছে একটা ছোট্ট প্রশ্ন রেখে এই লেখা শেষ করব(জানি না তিনি পরবর্তীতে এই পয়েন্টের সংযোজন করেছেন কিনা)
লিটল ম্যাগাজিন বিগত ১০০ বছরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে বিভিন্ন রূপ পরিবর্তন করেছে (সত্তা নয়)।আগামী যে সময়টা আসছে সেই সময়টাকে অ্যাডপ্ট করে তার ভবিষ্যৎ রূপ কি হতে পারে, নাকি এই একই রূপ নিয়েই সে তার গতিপথ নির্ধারণ করবে? লেখকও ভাবুন আমরাও ভাবি। কারণ লিটল ম্যাগাজিন ভাবতেও শিখিয়েছে। নতুন ভাবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। হয়তো সেই কারণেই সে আজ স্বতন্ত্র সত্তা,একটি ভিন্নতর পন্থা ও দর্শনও। যা এই ‘লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহিরে’ বারবার কড়া নাড়বে আপনার অন্তর বাহিরে।
——————