– গৌতম মাহাতো
অখণ্ড চুটিয়া নাগপুর জুড়ে যে জনজাতি সুদীর্ঘ কাল ধরে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন তারাই এই অঞ্চলের মূল আদিবাসী। তারা কুড়মি। আদিম জনজাতিগুলির মধ্যে কুড়মি উল্লেখ্যনীয় কারণটা অবশ্যই তাদের একান্ত নিজস্বতা, নিজস্ব রীতি নীতি, পরব-তেওহার ও নেগ-নেগাচার। বর্তমানে অবশ্যই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতির পর তা পঠনপাঠনের বিষয় হিসাবে চালু করে হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই জনজাতিটি রয়ে গ্যাছে সেই তিমিরেই। এদের রহন-সহন, খাদ্যাভ্যাস, আদব কায়দা এবং সর্বোপরী জীবনযাপনের একটা বড় অংশ জুড়ে বয়ে গ্যাছে প্রকৃতি প্রেম। এরা হিন্দু/আর্য নয়। অনেক গবেষকের মতে এই জনজাতিটিও অন্যান্য আদিম জনজাতির মতোই টোটেমিক। অর্থাৎ এরা গোত্রে বিবেচিত নন, এরা গোষ্ঠীতে বিশ্বাসী। তাই এদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতেও স্পষ্টভাবে ছাপ ফেলে প্রকৃতি। নানান ট্যাবু ও টোটেমদের মধ্যে প্রকৃতি তার গভীর প্রভাব আচ্ছাদিত করে রাখে। হাবার্ট একেই ‘প্রেতবাদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এই কুড়মি জনজাতির ভাষা ও জীবনের মতোই এদের পার্বণগুলিও ভিন্নতর স্বাদের এবং অদ্ভুত সুন্দরও। যেমন- ছাতা, জিতা,আখ্যান, টুসু, ভাদু, করম, বাঁদনা ইত্যাদি। এখানে আলোচনা করব এইসব পরব-তেওহার নিয়েই। যদিও সম্পূর্ণ পরব-পার্বণ ও নেগ নেগাচার সম্ভব হবেনা তবুও মূল কয়েকটি আলোচনার মাধ্যমে পরিচয় ঘটাব এদের সাথে।
কুড়মিদের জীবন জল, জঙ্গল ও জমির মধ্যেই আবর্তিত হয়। তাই পার্বণগুলিও এদের ব্যাতিরেকে নয়। মূল কথাটা হল এরা প্রকৃতি প্রেমিকের সাথে সাথে প্রকৃতি পুজারিও। তাই কুড়মিদের নেগ-নেগাচারে মূর্তিপূজার প্রচলন প্রায় নেই। যে কটা মূর্তিপূজার নিদর্শন দেখা যায় সেগুলি আসলে অর্বাচীন প্রথা বা বীরগাথার অংশ। তার মধ্যে পড়ে টুসু এবং ভাদু যা প্রতীকী সম্মান জ্ঞাপন। কুড়মিদের নিজস্ব ক্যালেন্ডারো বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রিন্টেড মেটিরিয়াল হিসেবে পাওয়া যায়। তবে সেটা যৎসামান্যই। তাছাড়া বাকী সব কিছুই স্মৃতি ও পরম্পরায় প্রায় তিনহাজার বছর ধরে বহন করে আসছেন এরা। কোন প্রামাণ্য কোনও লিখিতরূপ ছাড়াই।
আখ্যাইন যাত্রা :
১লা মাঘ অনুষ্ঠিত হয় আখ্যাইন যাত্রা। যাতরা ধরেই শুরু হয় সবটুকু। এই দিনটি হল বছরের প্রথমদিন (কুড়মি ক্যালেন্ডার হিসাবে)। আখ্যাইন শব্দটির উৎপত্তি ডঃ বঙ্কিম চন্দ্র মাহাত তাঁর ঝাড়খন্ডি বাংলা ‘শব্দকোষ’ এ ‘ওক্ষ-অয়ন’>আখ্যান>আখ্যাইন এভাবেই বিশ্লেষণ করেছেন। আ-ক্ষণ থেকেও এসে থাকতে পারে বলে অনেকের অভিমত। তবে শব্দটি যেভাবেই সৃষ্টি হয়ে থাকুক না কেন, এই দিনটি যে একটি শুভদিনেরই পরিচায়ক তাতে কোনও দ্বিমত নেই। বছরের প্রথম দিনের যেভাবে আমরা স্বাগত আপ্যায়ণ দেখি এক্ষেত্রে সেটা একটু ভিন্ন। যেহেতু এ উৎসব রাঢ় বাংলার কৃষিজীবি আপামর মানুষের তাই এই দিনটিও আবর্তীত হয় কৃষিকে কেন্দ্র করেই। সারাদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় নানান প্রতীকি কৃষি ক্রিয়াকলাপ। এই ত্রিভূমের ‘হড়-মিতানের’ কাছে এটি পূণ্যদিন পুণ্যতিথি। আর একে কেন্দ্র করেই প্রতিটি চাষি পরিবারে শুরু হয় ভোর থেকে কর্মতৎপরতা। ঘর-দুয়ার উঠোন পরিষ্কার পরিপাটি করে তাতে গোবরজল ছড়িয়ে আলপনা এঁকে দেয় বাড়ির মেয়েরা। বাড়ির ছেলেরা ব্যস্ত থাকে দড়ি-অঁদ পাকাতে। কারণ এই দিনটি শুরু হয় নতুনভাবে হাল চালানোর মাধ্যমে। এই রীতিকে বলা হয় হালপুইন্যাহ্। এটি পালন করে বাড়ির বড় ছেলে যে নিজের জমিতে আড়াই পাক প্ততীকি লাঙল কর্ষণ করে। এ দিনের এই লাঙলটি হতে হবে নতুন। তবে নতুন লাঙলের অভাবে পুরানো লাঙল দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করা যাবে সেক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে লাঙলের ফলাটি হতে হবে নতুন। এছাড়া দড়ি-অঁদ, বেউনি, জৎ এগুলি সবই নতুন আবশ্যিক। পরিবারের বড় ছেলে সকাল থেকে উপোস থাকবে; সে স্নান করে নতুন হাল জুতে নিজের জমিতে প্রতীকী কর্ষণের পর ফিরে এলে বাড়ির বউ, বোন, মা কুলোয় করে নতুন ধান দুর্বা সিঁদুর নিয়ে সেই হাল বহনকারী গবাদিকে বরণ করবে। তাঁর শিং-এ মাখিয়ে দেবে তেল ও সিঁদুর। খেতে দেওয়া হবে সে বছরের নতুন ধান।
কৃষি সংস্কৃতি হল যৌথ সংস্কৃতি। তাই এই দিনই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় তাদের কাজের সূত্র সম্পর্ক নতুন করে পুর্ণনবীকরণের জন্যো এদিনটি যথাযথ বলে মনে করা হয়। যেমন গ্রামের নাপিত এই যাত্রার দিন এসে বাড়ির সকলের নখ চুল দাড়ি ইত্যাদি কেটে দিয়ে তার বাকী পাওনাগন্ডা নিয়ে ন্তুন বছরে নতুন করে চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন। একই ভাবে ধোপা, কামার, মুচি, জেলে…সকলেই যথাপূর্বক একই নিয়মে চুক্তিবদ্ধ হবেন। এটাই রাঢ় বাংলা তথ কুড়মিদের অলিখিত নিয়ম।
এদিনটিতেই গ্রাম্যদেবতা ‘গরাম’ থানে সবাই সামর্থ্যানুসারে নৈবেদ্য নিয়ে আসবে। এই পূজা করেন গ্রামের লায়া। বিভিন্ন স্থানে গ্রাম দেবতাও বিভিন্ন হয়ে থাকে। কোথাও ‘বড়াম থান’, কোথাও ‘যাতরা বুড়ি’ ইত্যাদি। সকলের মঙ্গলকামনাই সর্বশেষ উদ্দেশ্য। আগামী বছর যেন হয় সুখ ও সমৃদ্ধিময়, সেই জন্যি গ্রাম রক্ষাকারী দেবতার কাছে নিজের ভক্তি অর্ঘ্য সমর্পণ। আর এর নৈবেদ্য! আতপ চাল, ঘি, মধু ও গুড়। অর্থাৎ সবই জঙ্গলের আহরণ এবং কৃষিজ।
রহৈন :
এই রহৈন বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১৩ই জ্যৈষ্ঠ্য অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির ব্যাপ্তিকাল সবচেয়ে বড়। তাই অনুষ্ঠানটি কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। ‘বার অনি’ যা ১২ই জ্যৈষ্ঠ্য ‘বার’ বা প্রস্তুতির দিন এবং ১৩ই জ্যৈষ্ঠ্য ‘রহৈন’ দিন।
এই রহৈন উৎসব চলে এক সপ্তাহ জুড়ে। ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠেই দিনাদি কর্ম না করেই গোবর দিয়ে ঘরের সীমানুযায়ী দেওয়ানল বেড়ি টানতে হয় (রেখা টানা)। আকাশ আর একটু পরিস্কার হলে ঘর দোর উঠোন খামার পরিস্কার করে গোবর লরানো হয় (গোবর লেপা)। এরপর প্রবেশদ্বারে ও তুলসী থানে, চৌকাঠে, খামারে, চালের গুঁড়ি গুলে আলপনা দিতে হয়। বেলা বাড়লে বীজধান বেছে রাখেন বাড়ীর মহিলারা। সন্ধ্যার মুখে গৃহকর্তা সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে নতুন টোঁকায় (বাঁশের তৈরি ঝুড়ি) করে নির্বাচিত বীজধানগুলি নিয়ে নিজের জমিতে ‘আখ্যাইন যাত্রা’-র দিন যেখানে হাল পুইন্যাহ্ করেছিলেন সেখানকার মাটিতে প্রতীকি বীজবপন করে। ফিরে এসে বাড়ির সকলের সাথে রহৈন ফল, রহৈন পিঠা ও রহৈন মাটি ভক্ষন করে। তাদের বিশ্বাস এই মাটি তাদের মা, আর এই মাটি পচন নিবারক। রহৈন ফিল বিষক্ষয়ী, এই উৎসবে মেয়েরাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তারা বিকেলে রহৈন মাটি সংগ্রহ করে এনে খামার গোয়াল সহ নানা জায়গায় রেখে দেয় আর বীজধানে মিশিয়ে দেয়। আর এই রহৈন মাতি যে টুপাতে (বাঁশের তৈরি ছোট ঝুড়ি) করে আনা হয় সেটিরও বিশেষত্ত্ব লক্ষণীয়। এই টুপাটিকে সিঁদুর মাখিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তারপর তাতে লোহার পেরেক বিঁধিয়ে দেওয়ার রীতি। যাতে অন্য কারোর নজর বা কু-দৃষ্টি না পড়ে।
এর এক সপ্তাহ পর থেকে অর্থাৎ ২০শে জ্যৈষ্ঠ্য থেকে সাতদিন চলে বিশ্রাম পর্ব। যাকে বলা হয় ‘ডা’। এই ‘ডা’ এর সময়পর্ব দুপুরথেকে। তার আগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুর অবধি চলে মাঙ্গন। এই মাঙ্গন হল সময়ের যাচ্ঞা। অতিরিক্ত সময় চাওয়া বা প্রার্থনা করা। এই রীতি চলে টানা এক সপ্তাহ। এর পরের সপ্তাহ অর্থাৎ ২৬শে জ্যৈষ্ঠ্য থেকে শুরু হয় ‘কোৎকাহ ই’। এই শব্দটি এসেছে ক্ষেতকারী শব্দ থেকে। এই সময়কালটি ক্ষেত প্রস্তুতের জন্য সুবর্ণ সময়। কারণ এর কয়েকদিন পর থেকেই আষাঢ় মাস অর্থাৎ বর্ষার সমাগম। তাই এই দৈনন্দিন কাজটিও প্রথা মেনে কুড়মিরা করে থাকেন উৎসব উদ্যাপনের মাধ্যমে, সানন্দে। এই সম্পূর্ন প্রারম্ভিক কৃষি পার্বনের নাম হল রহৈন।
জাওয়া / করম : চুটিয়া নাগপুরের একটি অন্তরের পরবগুলির মধ্যে এটিই অন্যতম। এটা মূলত শিশুদের উৎসব। আসলে কুড়মিরা কিন্ডারগার্ডেন অনেককাল আগেই স্থাপন করেছিল তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে। বা বলা যায় নীতিশিক্ষার পাঠ তারা প্রতিফলিত করে তাদের উদযাপনের ভেতর। ঔচিত্য অনৌচিত্যের পাঠ তথা প্রকৃতির সাথে মাখামাখি হতে শেখায় এই পরব। শিশুদের আনন্দ উদযাপনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আসল শিক্ষা যা তারা না জেনে না বুঝেই সম্পৃক্ত হয়ে যায় লোকপশিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার শেকড়ে। তারা ভালবাসতে শেখে প্রকৃতিকে। তারা গায় –
“আজ রে করম ঠাকুর ঘরে দু-আরে রে
কাইলরে করম ঠাকুর শাঁখ লদির পারে।”
প্রাচীন ভারতে যেমন নীতি শিক্ষার জন্য লেখা হয়েছিল গল্প সাহিত্য, ইংরেজিতে ফোক্ টেল, ফেব্লস তেমনি কুড়মিরা আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রুতিকে মাধ্যম করে এই অনুষ্ঠান। এই উতসবটি দুটি ভাগ করে নিলে সুবিধা। একটি জাওয়া অন্যটি করম। করম তিথি নির্ভর। ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীর দিন মানে পার্শ্ব একাদশীতে এই উৎসব পালন হয়। এটি মূলত শিশু ও কিশোরী মেয়েদের উৎসব হলেও ছেলেরাও অংশ নেয়। নির্জলা উপবাস করে তারা বন থেকে পাতা দাঁতন সংগ্রহ করে আনা, করম ডাল আনা, করম ডাল পোঁতা এসব কাজে নিযুক্ত হয়। কিন্তু মেয়েরা মেতে ওঠে আসল উৎসবে। সেটা একসপ্তাহ আগে থেকেই। মূলতঃ অবিবাহিতরাই এর উপাসক।
গ্রামের কিশোরীরা এক সপ্তাহ আগে নতুন বোনা টুপা বা ডালা (বাঁশের বোনা বাটির মত আদলের ঝুড়ি) নিয়ে নদী বা খালের ধারে তারা জড়ো হয়। স্নান করে সঙ্গে নিয়ে আসা বিভিন্ন শস্যবীজ টুপাতে বালি ভর্তি করে ভক্তি সহকারে বপন করে। তারপর শুরু হয় গোল হয়ে হাতে হাত ধরে সমবেত কন্ঠে গান আর নাচ। এই নাচের রিদম অনন্য। এতে আনন্দ আছে তবে অত্যধিক উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ নেই। শান্ত, ধীর ও লালিত্যময়। এই গানে শুধু করম ঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনা নয় বরং এই গানে থাকে তাদের নিজস্ব দুঃখ, দুর্দশা ও আক্ষেপের কথা। এই সময় করম ঠাকুর হয়ে ওঠে তাদের সখা, যাঁকে মনের সবটুকু উজাড় করে বলা যায়।
১) “একদিনকার হলৈদ বাটা তিন দিনিকার বাসি গ
মা-বাপকে বল্যেঁ দিবি বড়ই সুখে আছি
হবক-ডবক ঢালা মাড়ে বাঁটে শাসুই ভাত গ
নিগাইতরা পেটটাকে মারে খটা দিন রাত।”
২) “ কুল্হি মুড়ায় কুল্হি মুড়ায় এক ঝুপড়ি গ
হুলকি হুলকি বহিন কাঁদে।
তথায় সে বড় দাদা আসিয়ে বসিল গ
চইখ্যের লর পুঁছাতে লাগিল
না কাঁদ্যো না কাঁদ্যো হামার বহিনী গ
বনায়ঁ দিব দালান কঠা ঘর।”
এভাবেই তারা জাওয়া পাতায়। এই জাওয়া তাদের আগামী সাতদিনের সই। তারা জাওয়া ডালা নিয়ে এই কদিন ঠিক সন্ধ্যা হলেই গ্রামের আখড়ায় বা কুলহি মুঢ়ায় (যেখান থেকে রাস্তা ভেঙে গ্যাছে) জড়ো হয়ে চলে গান এবং হাত ধরাধরি হয়ে নাচ। আর জাওয়া ডালাগুলিকে মাঝে রেখে প্রদক্ষিণ।
“ আইসঅ লো সঙ্গতি সবাই হাত ধর্যেঁ নাচি লো
এক মনে জাওয়া দিব জাওয়া যেমন
রাঢ়েহ লো
হামদের জাওয়া উঠে যেমন শাল ধুঁধের পারা লো।”
এই জাওয়া ডালায় জাওয়া পাতানোর পর থেকেই চলে তাদের নিষ্ঠা ভরে নিয়ম পালনের ব্রতও। এই জাওয়া ডালার শুচিতা বজায় রাখতে ঐ সাতদিন তারা শাক খাবেনা, খাটিয়ায় ঘুমোবে না ইত্যাদি। এর অন্যথা হলে জাওয়া ফুঁবদে যাবেক(বৃদ্ধি ব্যাহত হবে)। এক সপ্তাহ কঠিন সাধনার মধ্যে কাটিয়ে ঠিক পার্শ্ব একাদশীর দিন তারা জঙ্গলে গিয়ে ফুল ফল পাতা সংগ্রহ করে আনে। ঐদিন নিরম্বু উপবাস। তারা সারাটা দিন জঙ্গলে এই কাজ করে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে এসে করম ডালায় আতপ চাল, ঘি, গুড়, মধু , ধুনো ইত্যাদি নিয়ে পোঁতা করম ডালের কাছে যায়। ইতিপূর্বেই গ্রামের কিশোর যুবকেরা লায়াকে (গ্রামীন কুড়মি পুরোহিত) নিয়ে করম গাছের ডাল এনে আখড়ায় পুঁতে রাখে। সেই বেদিমূলে গাঁয়ের মেয়েরা তাদের নৈবেদ্যর সাথে একটা কাঁকুড় (শশা) এবং একগাছি ধানগাছ নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা করম ডালটি ঘিরে বৃত্ত করা প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে। মাঝে করম ঠাকুরের পাদদেশে বসে লায়া। এরপর শুরু হয় গল্প। করম ঠাকুরের গল্প। করমু আর ধরমু দুই ভাই এর করম ঠাকুরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার গল্প। এই গল্পগুলি নীতিশিক্ষামূলক। যা ব্রত পালনকারীদের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সামাজিক করে তোলে। ঐ ব্রতীরা যে কাঁকুড়টি নিয়ে আসে সেটি তারা তাদের ব্যাটা (পুত্র) রূপে কল্পনা করে। যদিও একাদশী সাধারণত হয় বিধবাদের। কিন্তু এই পার্শ্ব একাদশীর ভিন্নরূপ প্রতিফলিত হয় আপামর জঙ্গলমহল জুড়ে। এই একাদশী কুমারী কিশোরীদের। তারা প্রার্থনা করে স্বামী পুত্র সংসারের। তারা মঙ্গল কামনা করে পরিবারের তথা সমাজের। তারপর সারারাত ধরে চলে নাচ গান।
পরের দিন ব্রতচারিনীরা তাদের সব নৈবেদ্যের সাথে তাদের কল্পিত পুত্র সেই কাঁকুর এবং জাওয়া ডালাকে জলাশয় বা নদীতে বিসর্জন দ্যায়। জাওয়ার কিছু কিছু বাড়ীর আনাচে কানাচে গুঁজেও রাখা হয় পরিবারের মঙ্গলার্থে। সে বছরের মত তারা করম ঠাকুরকে বিদায় জানায় গানে গানে।
১) “জাহু জাহু করম রাজা জাহু ছয় অ মাস
আওতঅ ভাদর মাস, আনবঅ ঘুরাঞ।”
২) “যাছে যাছে করম ঠাকুর যাছে লো ছাইড়্যেঁ
ঝিঙ্গা পড়াআ বাসি ভাত যাছে লো খাঁয়েঞ।”
৩) “তুঁঞ ত রে করম রাজা যাবি হাঁসিঞ হাঁসিঞ
মুঁঞ ত রে করম রাজা যাব কাঁদিঞ কাঁদিঞ।”
ইঁদ : ইঁদ প্রতিপালিত হয় করমের ঠিক পরের দিন। অর্থাৎ শুক্লা দ্বাদশীর দিন। এটি একটি প্রথা টোটেমিক কুড়মি সম্প্রদায়ের দলপতির প্রতি আস্থা জ্ঞাপনের নাম ইঁদ। কিন্তু কালক্রমে এই প্রথা রূপান্তরিত হয়ে ঐশ্বরিক চেতনার রূপ নিয়েছে। নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিজয়ধ্বজা উত্তোলনের মাধ্যমে তারা ইঁদ উদযাপন করত।
এই উৎসবের প্রায় মাস দুয়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় তার তোড়জোড়। তখনই জঙ্গলে গিয়ে বাছা হয় ইঁদ ডাং (দন্ড)। এর কয়েকটি নিয়ম আছে।
১) ইঁদ ডাং হতে হবে সোজা, লম্বা ও নীরোগ।
২) এই গাছে কোনও পাখির বাসা থাকলে চলবে না।
৩) বাজ পড়া গাছ ‘ইঁদ ডাং’ এর যোগ্য নয়।
শুক্লা দ্বাদশীর দিন এই ইঁদ ডাং জঙ্গল থেকে কেটে এনে তার ছাল চাড়িয়ে সমস্ত কান্ডে সাদা থান কাপড় পেঁচিয়ে প্রস্তুত করা হয়। তার মাথায় বাঁশের তৈরি ছাতা যা নতুন সাদা থানে সুসজ্জিত থাকে তা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর ইঁদ ট্যাঁড়্যে (মাঠে) পর্যাপ্ত গর্ত করে এই ইঁদ ডাং এর গোড়ার দিকটা গর্তের মুখে এনে নতুন দড়ি বেঁধে সমবেত প্রচেষ্টায় সোজা দাঁড় করিয়ে পোঁতা হয়। এই কর্মকান্ড চলার সময় সমবেত জনতা সমস্বরে গর্জে ওঠে “জয় ইঁদ রাজার জয়”। এবং পাশাপাশি চলতে থাকে পূজার্চনা, নৈবেদ্য নিবেদন।
১) “ইঁদ দেখ দৌড় দৌড়
আর ছাতা দেখ রসে হে
এমন মানুষ জনম নায়ঁ আইসবেক ঘুর্যেঁ হে।”
২) “ বিলের আইড়্যে টাঁড়্যে বনে কে কইল্যঅ ডহর লো
এরা ঠিক্যেই বঠে ইঁদ দেখা লক লো।”
৩) “ বরাবাজারের ইঁদ, আর চাকোইলতড়ের ছাতা হে
কাশীপুরের দশদুজ্ঞা নাই হল্য দেখা হে-”
বলা যায় ইঁদ ও ছাতা প্রায় একই ধরনের উৎসব শুধু সময়কালটা ব্যাতিরেক। তাই ‘ছাতা’ সম্পর্কে আর আলোচনা করলাম না।ছাতা পরব অনুষ্ঠিত হয় ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে।
জিতা ঃএই উৎসব প্রধানত ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে অষ্টমী তিথিতে হয়। এটি মূলত সধবা বিবাহিত মহিলাদের সন্তান কামনার্থক উৎসব। বিশ্বাস সন্তানহীন মহিলারা এই ব্রত পালন করলে সন্তান লাভ করে থাকেন। এর আচার অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট রয়েছে এবং এর কিছু জনশ্রুতিও পাওয়া যায়। তবে সে সব অর্বাচীন জোরপূর্বক সাযূজ্য খোঁজা বলেই মনে হয়।
ক্রমশ