প্রদীপ্ত খাটুয়ার গুচ্ছ কবিতা

প্রদীপ্ত খাটুয়ার গুচ্ছ কবিতা

কবি প্রদীপ্ত খাটুয়া
জন্ম : ২৭ নভেম্বর,১৯৭৩
শিক্ষা: বি.এসসি., বি.এড.(প্রথম শ্রেণী)
এম.সি.এ. (ইগনু)
পেশা : স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনভেস্টিগেটর, জেলা গ্রামোন্নয়ন দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
কাব্যগ্রন্থ : নৈঃশব্দ্যজাত (২০১১); হর্ষজ্যোতি (২০১৩)
সম্পাদিত গ্রন্থ : আবহমান প্রেমের কবিতা (২০১১়, প্রিয়তমাসু (প্রেমের কবিতা সংকলন)
সম্পাদিত পত্রিকা : শব্দপথ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬)

ক্ষণজন্মা


জানালার ওপাশে মুখ : কার মুখ!
ছায়া প্রলম্বিত। হাওয়া ধীর।

খসখস খসখস পাতার শব্দদ্বৈত
কিছুক্ষণ … কিছুক্ষণ …


অকাল বিকেল! অথবা সন্ধ্যা।
খেচর ডানায় আলোরং লাগেনি অস্তের
বেপাড়ার সমূহ ক্রোধ
পুষে রেখেছে
আষাঢ়স্য মেঘ।
এসময় এক কাপ চা চাই। দুধহীন।
সুগার ফ্রী…
আহা উষ্ণতা!

আরোগ্য

অন্ধকার আসছে। আচ্ছে দিন নয়।
ব্লগে লেখো যত কিছু, মেয়েরা কিন্তু আজও বিকোয়।

নির্মাণে ঝুলে আছে ব্রিজ। কবির মুদ্রালিপি।
দুবেলার রুটিরুজি- রিক্সার দেখা নেই
সারি সারি পিঁপড়ের মত শব্দহীন টোটো

উত্তাপ কতটা দিতে পারে রোদ!
কতটা অমানবিক হলে, নার্সিংহোমের পথে
বসে থাকে শ্মশানবন্ধু; ফ্ল্যাশহীন ফটো!

কত ঘরে উঠেছে ফসল! আর কতটা অপচয়
এ-দেশ আরোগ্য চাইছে, অসীম তুমি, হে করুণাময়…

অভিমুখ-৩

হাওয়া আসে ফিরে যায় ঝড় হয়ে।
যেন উড়ে গেছে চালা, ছুটছে মানুষ প্রবল ধন্দ নিয়ে।

পড়শীর দেওয়ালে ঘুঁটে, পোস্টার তালগাছে।
পাড়ার পুকুরের ছোট-বড় মাছে, দশ-বারো ভাগ আছে।

আমাদের গ্রামীণ বাঁচা, ছায়া পড়ে পল্লীউঠোনে।
স্থানীয় ক্রোধ জমে জমে থাকে, বারুদের মতো, ঈশান কোণে …

চিঠি

মুখ টিপে ফিরে গেছো, হওয়া নির্ভর গতিপথ
সেনা ছাউনির নম্র আলোয়, যথেষ্ট কী বিষয় উদ্ধার!
বুলেট ফিরে এলে, গ্রেনেড, তাক করো কালাশনিকভ
চিঠি লিখবে তো, কবে! চিঠি শুশ্রুষা যোদ্ধার …

এতটা কঠিন ছিল যাওয়া! পথ ভাঙে সেতুর দুপাশে
দূরে গিয়ে থামে স্রোত, ঢেউ ফেরে স্তব্ধ পাড়ায় !
বিধবার হাত ছুঁয়ে, নদী, ভাসে কোন দেশে
আগুন ধুয়েছে স্নান, শিশুটিকে, সৎকার প্রথায় …

গার্হস্থ্য

অনেকটা পাথরকুচির মতো
উঁচু-নিচু গার্হস্থ্য জীবন।
পথের দুপাশে নিবিড় তরুছায়া, আমার মা-বাবা।
একযুগ পাতাবাকল খসাতে খসাতে
আজ হতশ্রী, পর্ণমোচী।

হাঁটতে-হাঁটতে গলা ফেটে রক্ত ঝরছে ।
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে ভাদ্রের রোদ;
গনগনে কামাগ্নির জ্বলন …

দিশেহারা আমি। সর্বস্ব খুইয়ে বসে পড়ি
পুকুর ঘাটে। টুপটাপ খেলা করে মৌরলা, ফলুই।
মাঝে মাঝে ঘাই মারে রাঘববোয়াল ।

সাতভাই শালিকের খুনসুটি দেখি।
আজ আমার জন্মদিন ।

ডাকঘর

জ্যোৎস্নার আলো ফেলে
কী খুঁজছো শুয়ে থাকা মাটিতে ?
মাটি-জড়িয়ে-থাকা ঘাস লতাগুল্মের পাতায় ?
কিংবা পুকুর, নদী, আর দিগন্ত বিস্তৃত
সমুদ্র জলদেশে?

শহরের গায়ে লেগে আছে জটিল হিসেব
গ্রামের মাটি ভাগ হয়ে গেছে দশ দিক

শ্মশানের থেকে ঠিকরে আসা দ্যুতি
অবিকল গ্রামীন ডাকঘর

সম্পর্ক ভেঙে গেলে
পড়ে থাকে চিঠির মাধ্যম, আর –
অক্ষরগুলি যেন স্বর্ণাভ দাঁত …

লাল কাঁকরের ছায়া

মেঘলা খুঁজছে অদিনের মেঘ;
আলো করে পাঠিয়েছো যাকে,
সম্বৎসরের দেখা
জলকণা উড়ছে, ভারী বাতাস

একলা এক ঘণ শালবন
লাল কাঁকরের ছায়া
চেটে নিচ্ছে উতল হাওয়া…

চালাঘর ভাঙাচোরা, শতং সরেন
বুকের আদল

হাসিখুশি ম্লান, দিনের ধরন
মেঘলা খুঁজছি ;
মুষড়ে পড়ে হৃদয়গত দেখা
বিষাদ ঝরে পড়ে …. সহস্রবিন্দু …

আলো হচ্ছে দিলু সরেন
খোল করতাল, আর মুহুর্মুহু বজ্রপাত …

কোরাস

হারিয়েছি অনেক কাছের বন্ধুবৎ, আলোর হরফ
গাছের ঝোপের লুকিয়ে রাখা অমনস্কতার রিক্ত খাঁচা
দৃশ্য ছিল নীরব কোরাস, কৃষ্ণকায় নগ্ন বরফ
উড়ছে ডানা মগজাস্ত্রে, মনের টানেই পৃথক বাঁচা।

শিস্টে ছিলাম, কষ্ট ফুড়ুত ! আগুন রাখে শীতের লাঠি
গুড় আনতে ফুরোয় রুটি, আড়ষ্টতায় পিছল পথ
সভ্য জীবন বুনছে যারা মাটির রং-এ শীতলপাটি
হারিয়ে যাওয়া অগাধ জলে মৎস্যশ্রেণী যেমন শ্লথ!

এমন অনেক বৃষ্টি দিনে কান্না ছাড়া কি আর জোটে
হিসেব যখন বাবায় মেলায়, আদর খুঁজি মায়ের কোল
বাজবে বলে একতারাটি ভীষণ দুটি আঙুল ছোটে
বেহাগ হয়ে পড়ছে ঝরে অভিন্নতার খঞ্জখোল।

সীমান্তে আজ রুদ্ধ বাতাস, আমদানিতে করের ফাঁকি
বন্ধুরাই জীবন জুড়ায়, বন্ধু কুলেই বাঁচতে শিখি।

সাঁতরাগাছি

কি দেখি?
পায়ে পায়ে ব্যস্ততার সকাল নটা।
হিসেব মতো 8:50 এর লোকাল ঢুকেছে পাঁচ নম্বরে-
নামছে মানুষ। স্রোতের মতো এগোচ্ছে।
বাসস্টপে যাওয়ার দু মিনিটের এই পথ-
গরম কচুরি, আলু ছেচকি, ডিম-টোস্ট, চা
দু-তিন-চার হাতের ব্যস্ততা
পরিশ্রম আর পরিবেশনে তৃপ্ত খদ্দের।
সংসারও চলে একভাবে-
পাশের গাছে দোলনায় শিশু
মাঝে মাঝে কেঁদে উঠলে
মা ঝুঁকে পড়ে সন্তানের মুখে।

ভীড়ে হাঁটছে চলমান বাস-স্টপেজ সাঁতরাগাছি
সময়কে হারিয়ে এ-শহর বলে-
আমি আছি, আমি আছি …

জাতীয় ভোটার দিবস

ছোট ছোট ঘর । ছোট ছোট মুখ।
টিমটিম জলে সদ্য গ্রামে আসা বিদ্যুৎ।
কারো হাতে নেই বই শ্লেট। কাগজের ঠোঙায় মুড়ি।
সন্ধ্যে ঘণ হয়েছে এইমাত্র।
প্রতিবেশি বউ-এর কব্জির জোরে ঘুরছে পাথর চাকা।
ভাঙ্গা হচ্ছে বিউলি কলাই অড়হর়।
ঝিঁঝিঁ ডাক শুনতে শুনতে পেরোচ্ছি সময়, দূরত্ব।
রাস্তাধারের উনুনে ফুটছে ভাত বেগুন শিম টমেটো।
কানে আসে সুর, বেঁচে থাকার গুঢ় কথা।
নির্জনতা জুড়ে জুড়ে প্রায়ান্ধকার রাসমঞ্চ।
অদৃশ্য অনাবশ্যক প্রাচীর আমাদের গ্রামঘরে।
মিটিং-মিছিল কথা বলছে মাইকের শব্দে
প্রতিবাদ উচ্চারিত মুষ্টিবদ্ধ হাতে।
যে-ভাষায় কথা বলে সুর, ক্ষয়িষ্ণু জীবন
হতচ্ছাড়া মানুষের হাততালি ছাপিয়ে যায় ছেঁড়া কাঁথার অশ্রুজল

টলতে টলতে ঘরে ফেরা যুবক রাতবিরেতে
বাঁশের দলমায় সজোরে ধাক্কা দিলে
রাষ্ট্র উদযাপন করে জাতীয় ভোটার দিবস।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *