পূর্ব মেদিনীপুরের ডায়েরি ( তৃতীয় কিস্তি )
লেখা ও ছবি- রাকেশ সিংহদেব
দরিয়াপুর
বেরিয়ে পড়েছি দরিয়াপুর এর উদ্দেশ্যে। শ্যামচক থেকে পেটুয়াঘাট যাওয়ার পথে (প্রায় 5 কিমি পরে ) ডানদিকে পথ বেঁকে সোজা চলে গিয়েছে দরিয়াপুর। পথের হাল বেহাল। পিচের রাস্তা ভেঙে গিয়ে পাথর বেরিয়ে পড়েছে। এভাবে প্রায় 4 কিমি চলার পর রাস্তার ডানদিকে চোখে পড়ল সাদাকালো ডোরাকাটা বাতিঘর। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। তারপর বাতিঘরের গোল প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে গলদর্ঘম হয়ে সোজা উপরে। উপরে রেলিংযুক্ত দাঁড়ানোর জায়গা আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে দারুন লাগলো। অনেক ছবি তোলা হলো। জানলাম ইংরেজরা এই বাতিঘর বানিয়ে ছিল।পাশের সমুদ্র পথ দিয়ে নির্বিঘ্নে তাদের জাহাজ পারাপার করানোর জন্যে। তখন এতে তেলের আলো জ্বলতো। তারপর.স্বাধীনতার পরে হলো ব্যাটারীর আলো। আর এখন উন্নত সোলার লাইটে আলোকিত হয় বাতিঘর এর শিখর।
এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলতে লাগলাম৷ লক্ষ্য কপালকুন্ডলা মন্দির। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কালজয়ী রচনা ” কপালকুন্ডলা ” র আঁতুড়ঘর। বাতিঘর থেকে প্রায় 3 কিমি চলবার পর এসে পৌঁছালাম মন্দিরের সামনে। কিন্তু এ কি! প্রায় 250 বছরের পুরনো মন্দিরের এ কি হাল! শুনলাম সরকার মন্দিরকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে তাই কিছু উজবুক প্রত্নতাত্ত্বিক ও সংরক্ষণকারি মন্দিরের গায়ে ইচ্চেমত চুন সুর্কি রং চাপিয়ে তাকে একেবারে হরিনামের চালা বানিয়ে ছেড়েছে।গ্রামের এক প্রবীন এর মুখে শুনলাম ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত মেদিনীপুর এর ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এখানে আসেন। তখন এই এলাকা গভীর গহিন অরণ্যে ভর্তি ছিল। অরন্যের গভীরে এই কপালকুন্ডলা মন্দিরে ছিলো কাপালিকদের বাস। এই জায়গা নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত ছিল আশেপাশের গ্রামগুলোতে। শুনতে পাওয়া যায় এখানে তন্ত্র সাধনার পাশাপাশি নরবলিও হতো। সাধারণ মানুষ এই মন্দিরের ধারেকাছে ঘেঁষত না। বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয় এখানে এসে এই এলাকার পরিবেশ ও এই মন্দিরের গল্প এবং মিথের পটভূমিতে সৃষ্টি করলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ” কপালকুন্ডলা “।পথভোলা নবকুমারের আশ্চর্য রোমাঞ্চকর উপাখ্যান। আর সেই মন্দিরের এই দশা দেখলেই বুকের মধ্যে কষ্ট জমে। কি আর করা যাবে!
সেখান থেকে একটু হেঁটে গেলেই বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি মন্দির। মন্দিরের ভেতরে সাহিত্য সম্রাটের একটি শ্বেতপাথরের আবক্ষ মর্মর মুর্তি রয়েছে। স্মৃতি মন্দিরের একপাশে একতলা পুরাতন এক বাড়ি, তার উঠানে গুলঞ্চ গাছ। জানা গেল এই এলাকায় ভ্রমণ কালে বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয় এখানে রাত্রি বাস করেছিলেন। সংস্কার ও যত্নের বড়ই অভাব, দেখলে কষ্ট হয়।মন হাহাকার করে ওঠে, হায়রে! অভাগা বঙ্গবাসীগণ তোমরা মহাপুরুষ এর স্মৃতি এভাবে নষ্ট করছ!
পূর্ব মেদিনীপুরের ডায়েরি ( চতুর্থ কিস্তি )
বাঁকিপুট
কপালকুন্ডলা মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লাম বাঁকিপুট এর উদ্দেশ্যে। মন্দির থেকে প্রায় 8 কিমি রাস্তা। নিয়মিত ট্রেকার চলে রাস্তা দিয়ে। রাস্তার হাল ভালো নয়। রাস্তার একপাশে উঁচু মাটির বাঁধ, আর একপাশে চিংড়ির চাষ আর নোনা জলের ভেড়ি। জল শুকিয়ে গিয়ে অনেক জায়গায় সাদা নুনের স্তর পড়েছে। এভাবে পৌঁছে গেলাম বাঁকিপুট। উঁচু মাটির বাঁধ তার ওপারে বিশাল বটগাছ আর তার নিচে সিমাহীন নিল জলের রাশি। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে কংক্রিট আর বোল্ডার বাঁধানো ঘাটে।জলে নামা নিরাপদ নয় কিন্তু ঘাটে বসে সমুদ্রের এই রূপসী রূপ দেখে মন ভরে যায়। জায়গাটা খুব নির্জন দুরে বাঁধের নিচে কিছু ঘর আছে। এদিকে দিনের আলো কমে আসছে। হঠাৎ দেখি দুরে সাগরের জলে এক অস্পষ্ট আলোর রেখা আড়াআড়িভাবে চলে গিয়েছে বহুদূরে। স্থানীয় মানুষদের কাছে জানলাম এটা জলের নাব্যতা নির্দেশ করছে। সামনে হলদিয়া বন্দর, তাই কোনো জাহাজ যেন এই আলোর রেখা পেরিয়ে ঘাটের দিকে না চলে আসে, তাহলেই বিপদ। এদিকে সন্ধ্যা প্রায় হয়হয় তাই এবার ফিরবো বলে বাইকে চাপলাম।
ফেরার পথে এক কাকুর বাড়িতে গেলাম।তিনি দির্ঘ 6 বছর ধরে ব্যবসায়িক ভাবে রঙ্গিন মাছ বা Ornamental fish এর চাষ করছেন। বিরাট কাঁচের বক্স এর ভেতরে ডিম পোনার হ্যাচিং হচ্ছে। কলকাতার সেলার দের কাছে অর্ডার নিয়ে তিনি মাছের সাপ্লাই করেন। এই মুহূর্তে বক্স গুলিতে গরামি প্রজাতির কিছু মাছ ছিলো। এই চাষের ব্যাপারে অনেক কথা ও তার অভিজ্ঞতা তিনি আমাকে জানালেন
পূর্ব মেদিনীপুরের ডায়েরি ( পঞ্চম কিস্তি )
বর্তমানে চিংড়ির চাষ পুর্ব মেদিনীপুর জেলায় তুমুল জনপ্রিয়। কাঁথি মহকুমার শ্যামচক, রসুলপুর, পেটুয়াঘাট, বাঁকিপুট প্রভৃতি সমুদ্রের কাছাকাছি জায়গায় চাষাবাদের বিকল্পধারা হিসেবে চিংড়ি প্রতিপালন করা হচ্ছে। ধানের জমিকে কেটে সেই মাটি আলের উপর ফেলে উঁচু করার ফলে জমির গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এই পুকুরের গভীরতা 5_6 ফুট পযর্ন্ত হয়। এবার বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে মাটি শোধন করে সেই পুকুরে নালা দিয়ে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকানো হয়। এবার সেই জলে রোটার মেশিন বসিয়ে চিংড়ির পোনা ছাড়া হয়। এখানে বাগদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে। পোনা পুকুরে ছাড়বার থেকে বিক্রির জন্য তোলা পযর্ন্ত.মোট 140দিন মত সময় লাগে, এই সময়ে মাছের ওজন 30-35 গ্রাম হয়। কিন্তু এই দিনগুলো কি চরম পরিশ্রম আর উৎকন্ঠায় কাটে তা বলার নয়। দিনে চার থেকে পাঁচ বার খাবার দেওয়া, মেসিন চালানো, মাছ খাবার খাচ্ছে নাকি দেখা, পাখি তাড়ানো, নিয়মিত জল পরীক্ষা ও ওষুধ দেওয়া প্রভৃতি কাজ করতে কালঘাম ছুটে যায়। চাষীরাও পুকুরের পাশেই ছোট ঘর করে দিনরাত পড়ে থাকে। এই চাষ খুব লাভজনক। এই চাষ এখানকার মানুষদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। তবুও মাঝে মাঝে ঘটে যায় অঘটন! রোগের আক্রমণে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ব্যাপক লোকসান হয়। তবুও মানুষ হার না মেনে আরও নতুন উদ্যমে নেমে পড়ে এই জুয়ায় ( এখানকার চাষিদের মতে চিংড়ির চাষ জুয়ার সামিল। )!
কিন্তু এই চাষের একটি ক্ষতিকারক দিক আছে।কমসময়ে অধিক লাভের আশায় এখানকার চাষীরা তাদের চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে চিংড়ির চাষ করবার ফলে জমি পরবর্তী সময়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে এখানকার কৃষিব্যবস্থা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চাষের জমির পরিমাণ খুব দ্রুতগতিতে কমছে।এই ব্যাপারে সতর্কতা,সাবধানতা, ও সচেতনতার প্রসার প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে এখানকার চারদিকে অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু কিছু জিনিস সব দিনের জন্য মনে হয় এক রয়ে যায়। দোকান বাজার ঝাঁ চকচকে হয়েছে তবু পাকা রাস্তার ধারে বসা বিকেলের মাছের বাজারের আবেদন সেই একইরকম রয়ে গেছে।
আজও পাশের গ্রামের মেয়ে বউরা রসুলপুর নদী থেকে মাছ ধরে এনে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে রাস্তার ধারে ঝুড়ি নিয়ে বসে বিক্রি করে। বিভিন্নরকম চিংড়ি, কাঁকড়া, ফিতে মাছ, লট্যা মাছের নোনা আঁশটে গন্ধে বাতাস ভারি হয়।খুব কম দামে মাছ বিক্রি করে সেই টাকায় বাজার করে রাতে তারা বাড়ি ফেরে । ক্রমে রাত্রি গাঢ় হয় আর অন্ধকারে তাদের তেলের কুপি টিমটিম করে জ্বলতে থাকে পরিশ্রম আর দুখের জীবনে সন্ধ্যাতারার মতো।
★★★